ডিজিটাল ডিভাইস তো বটেই, কাঁটাওয়ালা হাত ঘড়িতেও সেকেন্ড ধরে সময় মাপা যায়। কিন্তু আজ থেকে ৫০০ বছর অতীতে যদি যান, তাহলে দেখবেন, ‘সেকেন্ড’ জিনিসটা কেউ চিনছেই না
‘বন্ধু, ৩০ সেকেন্ড দাঁড়া, আমি আসছি।’ দৈনন্দিন জীবনে বন্ধুকে হয়তো এমন কথা আপনিও বলেছেন। আমরা সবাই বলি, কথার কথা। বাস্তবে ত্রিশ সেকেন্ডে আসলে হয় না। তবু এমন বলার কারণ, এই কথা বলা খুব সহজ। ডিজিটাল ডিভাইস তো বটেই, কাঁটাওয়ালা হাত ঘড়িতেও সেকেন্ড ধরে সময় মাপা যায়। কিন্তু আজ থেকে ৫০০ বছর অতীতে যদি যান, তাহলে দেখবেন, ‘সেকেন্ড’ জিনিসটা কেউ চিনছেই না। গত পাঁচশ বছরে সৌরঘরি থেকে যেমন যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরি হয়েছে, তেমনি সেকেন্ডের সংজ্ঞায় এসেছে বহু পরিবর্তন।
সেকেন্ড হলো সময় পরিমাপের একক। পৃথিবীজুড়েই এটি ব্যবহৃত হয়। দৈনন্দিন জীবনে প্রচলিত সময়ের সবচেয়ে ছোট একক। ৬০ সেকেন্ড পেরোলে আমরা সেটাকে বলি এক মিনিট। আবার ৬০ মিনিটে হয় এক ঘণ্টা। চব্বিশ ঘণ্টায় এক দিন। ছোটবেলাতেই সময় মাপার এ এককগুলো সম্পর্কে আমরা শিখেছি।
এখান থেকে সেকেন্ডের মজার একটা সংজ্ঞা দেওয়া যায়। ৬০ সেকেন্ডে যদি এক মিনিট হয়, তবে ১ ঘণ্টা বা ৬০ মিনিট সমান হবে ৬০ × ৬০ = ৩,৬০০ সেকেন্ড। ২৪ ঘন্টায় হয় ৩৬০০ × ২৪ = ৮৬,৪০০ সেকেন্ড। দেখা যাচ্ছে, এক সেকেন্ড হলো এক দিনের ৮৬ হাজার ৪০০ ভাগের এক ভাগ। সেকেন্ড যেহেতু সময় পরিমাপের একক, তাই সেকেন্ডকে ব্যাখ্যা করতে পারা মানে, বলা যায়, সময়কে ব্যাখ্যা করা। আপনি চাইলে এভাবে ব্যাখ্যা করেই শান্তি পেতে পারেন। তবে চাইলে আরেকটু গভীরে ডুব দিতে পারেন, অনুসন্ধান করতে পারেন এর সত্যিকারের মানে।
বর্তমানে সেকেন্ড একটি সর্বজনীন একক। সর্বজনীন মানে, পৃথিবীর সবখানে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি সারা পৃথিবীতেই এক সেকেন্ড বলতে সমপরিমাণ সময়কে বোঝায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে এক সেকেন্ড আর নরওয়ের এক সেকেন্ড আলাদা নয়, একই। সময় পরিমাপের ক্ষুদ্র এই একক কিন্তু সব সময় এমন ছিল না। শতাব্দীজুড়ে কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে সেকেন্ডের সংজ্ঞা।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ফিজিকস ল্যাবরেটরির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী পিটার হুইবারলি। তিনি বলেন, ‘এক কালে সেকেন্ড নির্ধারিত হতো দিনের দৈর্ঘ্যর ওপর ভিত্তি করে। মানুষ মাটিতে সূর্যের ছায়ার স্থান পরিবর্তনের হার মাপত সূর্যঘড়িতে। এই যন্ত্র ব্যবহারের পুরোটাই নির্ভর করত আকাশে সূর্যের অবস্থানের ওপর। এ জন্য একে দৃশ্যমান সৌরসময় বলা হয়।’
সূর্যঘড়ির কিছু সমস্যা ছিল। এরকম একটি সমস্যার কথা বলেন হুইবলার, ‘পৃথিবীর ঘূর্ণন সবসময় একরকম থাকে না। সময়ের সঙ্গে কমে-বাড়ে। এর কারণ, দশকের পর দশক ধরে ঘটা পৃথিবীর কোর বা কেন্দ্রের বড় পরিবর্তন, ঋতুবৈচিত্র্য এবং জোয়ারভাটা—এমন নানা কারণে ধীর হয়ে আসে পৃথিবীর গতি। তাই সময় নির্ণয়ের জন্য পৃথিবীর ঘূর্ণন বা সূর্যের অবস্থানের ওপর নির্ভর করা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না।’
ষোড়শ শতকেই এটা বুঝেছিল মানুষ। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তখন প্রথমবারের মতো উদ্ভাবিত হয় যান্ত্রিক ঘড়ি। নেদারল্যান্ডসের আমর্স্টাডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক সুমিত সরকার বলেন, ‘যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরির মূল উদ্দেশ্য হলো সময় পরিমাপের জন্য সূর্যের ওপর নির্ভরশীলতা দূর করা। এমন এক অসিলেটর বা ত্বরক যন্ত্র তৈরি করা, যার প্রতিটি চক্রকে এক সেকেন্ড হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
প্রথমদিকের যান্ত্রিক ঘড়ি নিয়ে বলতে গেলে পেন্ডুলাম ঘড়ির কথা আসে। এগুলোতে পেন্ডুলাম দুলত নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য মেনে। অর্থাৎ এখানে পেন্ডুলাম ছিল ত্বরক যন্ত্র। এর প্রতি দোলনের সময়কে ধরা হতো এক সেকেন্ড। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যাগত সেকেন্ডের সঙ্গে মিল রেখে ঠিক করা হতো পেন্ডুলামের দোলনকাল। আকাশে সূর্যের অবস্থান কিংবা দিনের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী যে সেকেন্ড নির্ধারিত হতো, তাকে জ্যোতির্বিদ্যাগত সেকেন্ড বলা হয়। কিছুক্ষণ আগে যে সূর্যঘড়ির কথা বললাম, সেটাও একধরনের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যাগত ঘড়ি। যেহেতু বছরজুড়ে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেকেন্ড বদলাত, তাই এর গড় পরিমাপ আমলে নিয়ে বিজ্ঞানীরা পেন্ডুলাম ঘড়ি তৈরি করেন।
দেখা যায়, এক (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল) সেকেন্ডে সিজিয়াম পরমাণুতে ৯১৯,২৬,৩১,৭৭০টি কম্পন তৈরি হচ্ছে।
পরবর্তী একশ বছরের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানীরা আরও ভালো ও নিখুঁত ত্বরক যন্ত্র তৈরির কাজ করেছেন। গিয়ার ও স্প্রিং-এর মতো বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে তৈরি করেছেন সময়ের হিসাব রাখার নানা ব্যবস্থা।
১৯৪০ সালের দিকে কোয়ার্টজ ঘড়ি হয়ে ওঠে সময় পরিমাপের আদর্শ মানদণ্ড। কোয়ার্টজের টুকরোয় ভোল্টেজ প্রয়োগ করলে তা কাঁপতে শুরু করে। এই কম্পন নিখুঁতভাবে মাপা যায়। কম্পন সব সময় সমান হওয়ায় সেকেন্ডের দৈর্ঘ্যও প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য এই কোয়ার্টজ ঘড়ি যথেষ্ঠ। কিন্তু ইন্টারনেট, জিপিএস সিস্টেম বা বিভিন্ন গবেষণার জন্য এগুলোকে আদর্শ বলা যায় না।
চাপ, তাপমাত্রার মতো পরিবেশগত অবস্থার কারণে প্রতিটি কোয়ার্টজের টুকরো আলাদাভাবে কাঁপে। ফলে নিখুঁত ঘড়ি তৈরির জন্য স্বাধীন ও অপরবর্তনীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা যায়। এখানেই সামনে আসে আণবিক ঘড়ির বিষয়টি।
হুইবারলি ব্যাখ্যা করেন, ‘প্রতিটি পরমাণুর একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক অনুরণন বা কম্পন থাকে। নির্দিষ্ট শক্তির অঞ্চলে অবস্থান করে এগুলো। অঞ্চল পরিবর্তন করতে এদের নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করতে হয়। এই শক্তির ফলেই তৈরি হয় নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্ক। এই কম্পাঙ্ককে আদর্শ ধরে সময়ের হিসেব করা যায়।
প্রথমবারের মতো ব্যবহার উপযোগী আণবিক ঘড়ি তৈরি হয় ১৯৫৫ সালে। সে জন্য সিজিয়াম পরমাণুর শক্তি পরিবর্তনের ফলে তৈরি মাইক্রোওয়েভ বা অণুতরঙ্গের কম্পাংক হিসেব করা হয়। এ জন্য ব্যবহার করা হয় সে কালে প্রচলিত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেকেন্ডের গড় মান। দেখা যায়, এক (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল) সেকেন্ডে সিজিয়াম পরমাণুতে ৯১৯,২৬,৩১,৭৭০টি কম্পন তৈরি হচ্ছে। এর প্রায় একযুগ পরে, ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহল এক হয়ে সেকেন্ডকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ঠিক করেন, সিজিয়াম পরমাণুর ৯১৯ কোটি ২৬ লাখ ৩১ হাজার ৭৭০টি কম্পন তৈরি হতে যে সময় লাগে, তাই এক সেকেন্ড।
তারপর থেকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সেকেন্ড বদলেছে বহুবার। কিন্তু আণবিক সেকেন্ড অপরিবর্তিত আছে আজও। অ্যাস্ট্রোনমিকাল সেকেন্ডের সঙ্গে মিল রাখতে কয়েকবছর পরপর আণবিক সময়ের সঙ্গে একটি লিপ সেকেণ্ড যুক্ত করা হতো। তবে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই লিপ সেকেন্ড বিলুপ্ত করার কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। ঠিক কীভাবে কাজটি করা হবে, তা অবশ্য এখনও ঠিক করেননি সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞানীরা কিন্তু আণবিক ঘড়ির সেকেন্ডের সংজ্ঞা নিয়েও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। এক সেকেন্ডের ১×১০-১৫ ভাগ পর্যন্ত সঠিকভাবে সময় বলা যায় এর সাহায্যে। পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীরা আরও নিখুঁত অপটিক্যাল অ্যাটমিক ক্লক বা আণবিক ঘড়ি তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এ জন্য স্ট্রনশিয়াম ও ইটারবিয়ামের মতো পরমাণুতে উচ্চশক্তির দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ ফেলা হয়। ফলে যে অ্যাটমিক ট্রানজিশন ঘটে, অর্থাৎ ইলেকট্রন আলো শোষণ করার ফলে উচ্চশক্তির কক্ষপথে চলে যায়—সেটা ব্যবহার করে সময় পরিমাপের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এতে প্রচলিত আণবিক ঘড়ির প্রায় ১০০ গুণ বেশি নির্ভুল সময় মাপা সম্ভব। তাই সময়কে মাইক্রোওয়েভের পরিবর্তে দৃশ্যমান ও অতিবেগুনি আলোর উৎস ব্যবহার করে নতুনভাবে সেকেন্ডের সংজ্ঞা দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে বৈজ্ঞানিক মহলে। তবে সেকেন্ডকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার আগে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আসলেই পরিবর্তন আসবে কি না, সে জন্য তাই তাকিয়ে থাকতে হবে ভবিষ্যতের পানে।