সহজলভ্যতা, বহুমুখী ব্যবহার, স্বল্পমূল্য, হালকা ওজন ও উচ্চস্থায়ীত্বের ফলে নানা ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী—যেমন প্লাস্টিক ব্যাগ, ফিল্ম, সিন্থেটিক পোশাক, কার্পেট, থালাবাসন, ঘটি-বাটি, বোতল, টায়ার, খেলনা, প্যাকেটজাত দ্রব্য, সার, যন্ত্রপাতি, যানবাহনের বডি ও যন্ত্রাংশ ইত্যাদি—পরিণত হয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অনিবার্য উপাদানে। নিত্যব্যবহার্য এসব প্লাস্টিক সামগ্রী, সিন্থেটিক টেক্সটাইল ও কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে। পরে তাপমাত্রা, অণুজীব এবং পরিবেশে বিভিন্ন ক্রিয়া-বিক্রিয়ার কারণে এ সব প্লাস্টিক ভেঙে পরিণত হয় বিভিন্ন আকারের প্লাস্টিকে; যা আবারও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ও সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ক্ষয় হয়ে পরিণত হয় ছোট ছোট প্লাস্টিক কণা, পাউডার কণা বা অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এসব অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক বা মাইক্রোপ্লাস্টিক ফাইবার।
প্লাস্টিক মূলত চার ধরনের—অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা (ন্যানোপ্লাস্টিক, ১-১০০০ ন্যানোমিটার), ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক, ১-১০০০ মাইক্রোমিটার), মাঝারি আকারের প্লাস্টিক কণা (মেসোপ্লাস্টিক, ১-১০ মিলিমিটার) এবং বড় প্লাস্টিক কণা (ম্যাক্রোপ্লাস্টিক, ১ সেন্টিমিটারের বেশি)। এ সব প্লাস্টিক কণা মাটিতে বা পরিবেশে টিকে থাকতে পারে ৪০০ বছরেরও বেশি। আর এরই ফলাফল বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে প্লাস্টিক দূষণ। বাতাস, মাটি ও পানির ওপর প্লাস্টিকের দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে, জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এ ছাড়াও প্লাস্টিক ও পলিথিন পোড়ানোর ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে বায়ু ও মাটি দূষণ। প্লাস্টিক কণাকে তাই এখন ক্ষতিকর দূষক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
প্রাথমিকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎস সাতটি। সিন্থেটিক টেক্সটাইল, টায়ার, সামুদ্রিক/মেরিন কোটিং, রোড মার্কিং, প্রাইভেট কেয়ারিং পণ্য, প্লাস্টিক বড়ি (পিলেট) এবং সিটি ডাস্ট (টায়ার, গৃহস্থালি প্লাস্টিক বর্জ্য, টেক্সটাইল বর্জ্য ইত্যাদি)৷ এর ভেতর টেক্সটাইল, টায়ার এবং সিটি ডাস্ট—এই তিনটি উৎসই শতকরা ৮০ ভাগ দূষণের জন্য দায়ী৷ সমুদ্রিক দূষণের শতকরা ৩৫ ভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক আসে টেক্সটাইল ও পোশাক থেকে৷ এ সবই মূলত পলিয়েস্টার, নাইলন ও অ্যাক্রিলিক ফাইবারের (অনেকে অ্যাক্রাইলিকও বলেন) তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, প্রযুক্তিগত টেক্সটাইল, মেডিকেল টেক্সটাইল ইত্যাদি৷
সাধারণত শিল্পকারখানায় লং-চেইন সিন্থেটিক পলিমার (যেসব পলিমার অণুতে বিপুল সংখ্যক পরমাণু থাকে)—পলিয়েস্টার, অ্যাক্রিলিক, লাইক্রা, স্প্যানডেকস, নাইলন ইত্যাদির তৈরি পোশাক ধোয়া এবং রং করার সময় পানিতে প্রচুর পরিমাণ মাইক্রোফাইবার বিমুক্ত হয়। পরে এই মাইক্রোফাইবার ছড়িয়ে যায় পানির সর্বস্তরে৷ আর পলিয়েস্টার বা সিন্থেটিক ফাইবারের পোশাক তৈরি ও ব্যবহারের সময় ঘর্ষণে ভেঙে বাতাস ও ধোয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে৷ এ ছাড়াও বর্তমানে ওষুধ শিল্প, সাবান ও ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, ক্রিম, লোশন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসাধনীর মতো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানা পণ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণ।
বিশ্বের প্লাস্টিক রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯তম৷ রপ্তানিকৃত প্লাস্টিকের প্রায় ৮০% কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় পোশাক কারখানায়
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি জার্নালের নভেম্বর ২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত অ্যালগালিটা (Algalita, ২০১২) নিবন্ধ অনুসারে, একটি পলিয়েস্টার পোষাক প্রতিবার ওয়াশিংয়ে বিমুক্ত ফাইবারের সংখ্যা ১৯০০-এরও বেশি। পরীক্ষার ফলাফল থেকে আরও দেখা যায়, প্রতি লিটার বর্জ্য পানিতে নিষ্কৃত মাইক্রোফাইবারের সংখ্যা ১০০-এর ওপরে৷ গবেষকদের মতে, পলিয়েস্টার কাপড় ধোয়া পানি সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম কারণ হতে পারে৷ এ গবেষণা-কাজে সারা বিশ্বের মোট ১৮টি উপকূল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রতিটিতেই মাইক্রোফাইবারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর প্রায় পুরোটাই পলিয়েস্টার।
বাংলাদেশ প্রতিবছর প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি ও প্লাস্টিক ফ্লেক্স রপ্তানি করে৷ বিশ্বের প্লাস্টিক রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯তম৷ রপ্তানিকৃত প্লাস্টিকের প্রায় ৮০% কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় পোশাক কারখানায়৷ পোশাকখাতে প্লাস্টিক দূষণে মূল ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিকের তৈরি বোতাম, হ্যাঙ্গার, প্যাকেট, কলার ক্লিপ, ইলাস্টিক ইত্যাদি৷ এ ছাড়াও বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার (পোশাক, হোম ফার্নিশিং, প্রযুক্তিগত টেক্সটাইল ইত্যাদি) এবং পলিয়েস্টার-মিশ্রিত কাপড় রপ্তানিকারক দেশ। ২০২২ সালে দেশের ২ হাজার ৯২৫টি আমদানিকারক সংস্থাকর্তৃক আমদানিকৃত পলিয়েস্টার কাপড়ের পরিমাণ প্রায় ৮৫.১ হাজার টন (Volza’s Bangladesh Export Data, ২০২২), যা পোশাকখাতে পলিয়েষ্টার পোশাকের চাহিদা পূরণে মুখ্য ভূমিকা রাখে৷
খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে প্লাস্টিক সংশ্লেষিত হয়। এ ধরনের প্লাস্টিক একধরনের দীর্ঘ পলিমার চেইন, যা সহজে পঁচনশীল নয়। শীতল তাপমাত্রার কারণে সমুদ্রের তলদেশে এর পঁচন ঘটে আরও ধীর গতিতে৷ আর সিনথেটিক মাইক্রোফাইবার বায়োডিগ্রেডেবল না হওয়ায় পরিবেশে টিকে থাকে দীর্ঘ সময়৷ এ ছাড়া মাইক্রোফাইবার দূষণের প্রভাব পড়ছে বাতাস, ভূপৃষ্ঠ, এমনকি সমুদ্রের ওপরও৷ আবার মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ পরিবেশে টিকে থাকা অপঁচনশীল মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে শ্বাস-প্রশ্বাস ও খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে প্রবেশ করে মানবদেহে৷
বাস্তুতন্ত্র (ইকোসিস্টেম) ও মাইক্রোপ্লাস্টিক
জলাশয়, নদী, সমুদ্র, মাটি, বাতাস—বর্তমানে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ব্যাপ্তি সবখানে। গত কয়েক বছরে প্লাস্টিক দূষণ পরিবেশগত সব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। জলজ প্রাণী ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাবের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে প্লাস্টিক কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) বিবেচিত হচ্ছে ক্ষতিকারক দূষক হিসেবে৷ বায়ু প্রবাহ, বৃষ্টির পানি, বন্যা ও নদীর স্রোতে প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে ভূপৃষ্টের উপরিভাগের বিভিন্ন জলাশয় ও সমুদ্রে। সমুদ্র এবং ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য পানির উৎসে এভাবেই ঘটছে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ। উচ্চঘনত্বের মাইক্রোপ্লাস্টিক জুপ্ল্যাঙ্কটন (ছোট এবং আণুবীক্ষণিক জীব, সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়) ও প্রবালের দেহের সঙ্গে মিশে যায়। পরে সামুদ্রিক মাছ ও জলজ প্রাণী এগুলো খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে এবং জলজ উদ্ভিদ এগুলো শোষণ করে। ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ প্রভাব ফেলছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রেও৷ এ সব মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার অংশ হওয়ায় মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের খাদ্য-পিরামিডে (খাদ্যশৃঙ্খলের স্তরে) প্রবেশ করছে সহজেই৷
ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক থেকে নির্গত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ এবং প্লাস্টিকের ভাঙনে সৃষ্ট বিসফেনলস মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক৷ বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের (বাংলাদেশ, ২০২২) এক গবেষণায় দেখা যায়, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের গড় পরিমাণ ২৩২ (১৮০-২৮৪), যা বিশ্বের বেশির ভাগ বালুকাময় সৈকতের তুলনায় অনেক বেশি৷
ঢাকার স্থানীয় বাজারের চিনি এবং টি-ব্যাগের ওপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের করা দুটি পৃথক গবেষণায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উদ্বেগজনক মাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ এ গবেষণা অনুযায়ী চিনি এবং টি-ব্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশে বছরে গড়ে ১০.২ টন মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করছে ১৭০ মিলিয়ন বা ১৭ কোটি মানুষের দেহে৷ এর আগে বাংলাদেশে মিঠা ও লোনা জলের মাছ এবং লবণের মতো খাদ্য দ্রব্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উদ্বেগজনক উপস্থিতি পাওয়া গেছে৷ এ ছাড়া ঢাকার বাতাসেও মিলেছে বিষাক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক।
২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত করতে সক্ষম হন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের রক্তে এই ক্ষুদ্র কণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়
পরিবেশের ওপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রতিক্রিয়া
বর্তমানে বায়ুমণ্ডল, ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের জলাশয় থেকে শুরু করে সমুদ্র—অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে পরিবেশের সব স্তরেই। মানব খাদ্যশৃঙ্খলে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা প্রবেশ করে মূলত দুভাবে। এক, সামুদ্রিক মাছ, অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে; আর দুই, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণায় দূষিত খাবার পানি গ্রহণের মাধ্যমে।
ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ফিল্টার করার পরও খাবার পানি থেকে এ সব প্লাস্টিক কণা আলাদা করা সম্ভব হয় না। ফলে খাবার পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, শুধু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ ছাড়াও পরিবেশে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিকের সঙ্গে শোষণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র এ সব প্লাস্টিক কণা মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। প্রাণী টিস্যু থেকে সহজে আলাদা করা না যাওয়ায় মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের প্রভাব প্লাস্টিক দূষণের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদী ও অধিক বিপজ্জনক হতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা।
মানবদেহ ও জীবজগতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব
খাদ্য, পানি ও শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। এ সব মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মানুষের লালা, রক্ত ও মলে পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয়, মানুষ খুব সম্ভবত নিয়মিতভাবে এ সব কণা গ্রহণ করে। মানুষের সংস্পর্শে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎসগুলো হলো বিভিন্ন প্রসাধনীসামগ্রী এবং সিন্থেটিক পোশাক৷ সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মানবস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক৷ বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা প্লাস্টিক কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুস হয়ে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে ক্যানসারসহ স্নায়ুজনিত রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কারণ হতে পরে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক সাধারণত নিউক্লিওফিলিক (নিউক্লিয়াসআকর্ষী) ম্যাক্রোমলিকিউলের (ডিএনএ, আরএনএ) সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে ডিএনএ শৃঙ্খল ভেঙে দেয়৷ ডিএনএ, লিভার, থাইরয়েড গ্রন্থি, ত্বক এবং কিডনি মাইক্রোপ্লাস্টিকের ‘টার্গেট’ অঙ্গ৷ প্লাস্টিক পদার্থে ব্যবহৃত রাসায়নিক রঞ্জকগুলো কারসিনজেন হিসেবে কাজ করে, যা লিভারের কার্সিনোমা, রক্তাল্পতা, গুরুতর স্নায়বিক ঘাটতি, শিশুদের মোটর দক্ষতার ঘাটতি, থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা হ্রাস এবং এপস্টাইন বার (Epstein Barr) ভাইরাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়৷ নারীদের ক্ষেত্রে, ইস্ট্রোজেনিক অনুকরণকারী রাসায়নিক স্তন ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে৷ ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত করতে সক্ষম হন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের রক্তে এই ক্ষুদ্র কণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়৷
সামুদ্রিক খাবার বা সি ফুডে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সম্ভাব্য মাত্রা বৃদ্ধি মানবস্বাস্থ্যের ওপর হুমকিস্বরূপ৷ কাঁকড়া, লবস্টার, লবণ এবং মাছের মতো সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহ ও খাদ্যশৃঙখলে প্রবেশ করে৷ এ সব কণা এক ন্যানোমিটারের মতো ক্ষুদ্র হতে পারে৷ এই অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা জৈবিক বাধা পেরিয়ে টিস্যুর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সহজেই৷ জল, স্থল, বায়ুমণ্ডল—প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সর্বস্তরে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়ছে মানব ও প্রাণিজগতে৷
প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর প্লাস্টিকের চাহিদা বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ৷ বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৫ সালে ঢাকার বাইরে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি। ২০২০ সালে এটা এসে দাঁড়ায় মাথাপিছু ৯ কেজিতে৷ ঢাকা শহরে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ কেজিতে৷ ইউরোপের দেশগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, সে সব দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজিরও বেশি৷
বাংলাদেশে সারা বছর যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশই প্লাস্টিক পণ্য৷ এ সব প্লাস্টিক বর্জ্য দ্বারা সৃষ্ট দূষণ জনস্বাস্থ্যকে ফেলছে হুমকির মুখে। আর প্লাস্টিকদূষণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে, যার মূল কারণ প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা। সারাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার (রিসাইকেল) করে প্লাস্টিক ফ্লেক্স তৈরিকারক রিসাইক্লিং কারখানার সংখ্যা তিনশটির ওপরে৷ প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিকের পরিমাণ ৯ লাখ ৭৭ হাজার টনেরও বেশি। উৎপাদিত প্লাস্টিক থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার অর্ধেকই পুনর্ব্যবহার সম্ভব হয় না৷ প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ০.৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৩৬% রিসাইকেল করা হয় এবং ৩৯% ল্যান্ডফিল, অর্থাৎ ভাগাড়ে ফেলা বা মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়৷ সারা বিশ্বে প্রতি বছর তৈরি প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় এক কোটি টন।
প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিটিএমএর (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন) তথ্য অনুসারে, দেশে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল থেকে ফ্লেক্স তৈরির জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৬৭০ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা। এ ছাড়াও সারাদেশে স্থাপন করা হয়েছে সাতটি প্ল্যান্ট , যা থেকে রিসাইকেলড সুতা, কাপড় এবং পোষাক তৈরি হচ্ছে৷ বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক বাজারে অ্যাক্টিভওয়্যার, আউটারওয়্যার, প্যাডিং এবং কুইল্টিংয়ের মতো উচ্চ মূল্যের পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত এ সব রিসাইকেলড সুতা, কাপড় ও পোশাকের প্রধান সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠছে৷
বাংলাদেশে সারা বছর যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশই প্লাস্টিক পণ্য৷ এ সব প্লাস্টিক বর্জ্য দ্বারা সৃষ্ট দূষণ জনস্বাস্থ্যকে ফেলছে হুমকির মুখে। আর প্লাস্টিকদূষণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে, যার মূল কারণ প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা
তবে প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি৷ যেমন প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও নিরাপদস্থানে ফেলার দ্বায়িত্ব গ্রহণ, প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক বোতলজাত পণ্য ইত্যাদি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং পঁচনশীল বা বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগ ও পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা, পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সমসাময়িক ফ্যাশনের ওপর সতর্ক দৃষ্টি আরোপ ইত্যাদি৷
ফ্যাশন মার্কেটে পলিয়েস্টারের অত্যাধিক চাহিদার ফলে বিশ্বজুড়ে পলিয়েস্টারের উৎপাদন ত্বরান্বিত হচ্ছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে৷ পরিবেশ বাঁচাতে পুনর্ব্যবহৃত সুতা থেকে তৈরি পোশাকের চাহিদা পশ্চিমা বাজারে দিন দিন বেড়েই চলছে৷ ফলস্বরূপ, প্লাস্টিক বোতলের পুনর্ব্যবহারও বাড়ছে দিনদিন। পলিয়েস্টার পোশাক তৈরিতে মাইক্রোফাইবারের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ এবং পলিয়েস্টার পোশাকের পুনঃব্যবহার মাইক্রোপ্লাস্টিক, তথা প্লাস্টিক দূষণ অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়।