পৃথিবীর ঘূর্ণন হঠাৎ থেমে গেলে কী ঘটবে

এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হলো, অধিকাংশ মানুষ মারা যাবে। সেই সঙ্গে মারা যাবে পৃথিবীর প্রায় সব জীবজন্তু। তবে এরপর ঘটতে পারে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা। বিষয়গুলো একটু খুলে বলা যাক।

সৌর অধিপতি সূর্যের চারপাশে অনবরত ঘুরছে আমাদের পৃথিবী। এর ঘূর্ণন হুট করে থেমে গেলে ফলাফলটা হবে ভয়াবহ। বিশেষ করে বিষুবরেখার কাছাকাছি। হয়তো জানেন, পৃথিবীর মাঝ বরাবর একটা রেখা কল্পনা করা হয়, যা সমান দুই ভাগে (উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে) ভাগ করেছে নীল এই গ্রহটিকে। এই রেখাটাই বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা।

বিষুবরেখায় ভূপৃষ্টের বেগ সেকেন্ডে প্রায় ৪৭০ মিটার। ঘণ্টায় এক হাজার মাইলের (প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার) একটু বেশি। পৃথিবী যদি থেমে যায়, কিন্তু বাতাস যদি না থামে, তাহলে গতি জড়তার কারণে ভূপৃষ্ঠে হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে থাকবে। এর গতিবেগ হবে ঘণ্টায় প্রায় হাজার মাইল। অর্থাৎ পৃথিবীর বেগের প্রায় সমান। তখন বাতাসের বেগ বিষুবরেখার কাছে হবে সর্বোচ্চ। সে কারণে পৃথিবীর ৪২ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে এবং ৪২ ডিগ্রি দক্ষিণে যা কিছু আছে, তার সব কিছু এই তীব্র ও ঝড়ো বায়ুপ্রবাহের মুখোমুখি হবে।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশের বাস এই এলাকায়। সুতরাং ফলাফলটা সহজেই অনুমেয়। তুলনা করার জন্য বলে রাখি, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যেসব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ রেকর্ড করা হয়েছে ঘণ্টায় ২৫৪ মাইল। ১৯৯৬ সালের ১০ জুন অস্ট্রেলিয়ায় আঘাত হানা সাইক্লোন ওলিভিয়া ছিল ওই গতিবেগের কারণ। সে তুলনায় প্রায় সাড়ে ৪ গুণ গতিবেগের বাতাসের ভয়াবহ পরিণতি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

তবে বাতাসের এই সুপারসনিক বেগ স্থায়ী হবে মাত্র কয়েক মিনিট। এরপর ভূপৃষ্ঠের বাধার কারণে এ বেগ ক্রমে কমতে থাকবে। কথাটা শুনে অনেকে হয়তো স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে জেনে রাখুন, পৃথিবীতে মানুষের বানানো যা কিছু আছে, তার প্রায় সব লন্ডভন্ড করে ধ্বংসস্তুপ করে দেওয়ার জন্য এই মাত্র কয়েক মিনিটই যথেষ্ট।

এই সুপারসনিক বাতাসের এলাকা থেকে বাইরের এলাকাগুলোতে (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা) বায়ুপ্রবাহের বেগ হবে তুলনামূলক কম। তবে সেখানে এখন পর্যন্ত ঘটা সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের দ্বিগুণেরও বেশি হবে সেটা। তাতে ওসব এলাকার আকাশচুম্বী ভবনগুলো ভেঙেচুরে যাবে স্রেফ গাছের মতো। দেখে মনে হবে, সেগুলোকে মাটির নিচের ভিত্তি থেকে টেনে তুলে সজোরে আছড়ে ফেলা হয়েছে।

জেনে রাখুন, পৃথিবীতে মানুষের বানানো যা কিছু আছে, তার প্রায় সব লন্ডভন্ড করে ধ্বংসস্তুপ করে দেওয়ার জন্য এই মাত্র কয়েক মিনিটই যথেষ্ট
এই সুপারসনিক বাতাসের এলাকা থেকে বাইরের এলাকাগুলোতে (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা) বায়ুপ্রবাহের বেগ হবে তুলনামূলক কম। তবে সেখানে এখন পর্যন্ত ঘটা সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের দ্বিগুণেরও বেশি হবে সেটা। তাতে ওসব এলাকার আকাশচুম্বী ভবনগুলো ভেঙেচুরে যাবে স্রেফ গাছের মতো

অন্যদিকে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলগুলোতে বাতাসের বেগ হবে আরও কম। তবে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কোনো শহরই বাঁচতে পারবে না, টিকতে পারবে না এর তোড়ের মুখে। বিশ্বের সবচেয়ে উত্তরের শহর নরওয়ের সোভালবার্ড দ্বীপের লংইয়ারবিন শহর। উত্তর মেরু থেকে এ শহরের দূরত্ব খুব বেশি নয়। মাত্র ১ হাজার ৩১০ কিলোমিটার (৮১৪ মাইল)। বাতাসের প্রবল বেগ এখানেও সর্বোচ্চ বেগের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও বেশি বেগে আঘাত হানবে।

তবে আপনি যদি আশ্রয় নেওয়ার জন্য ভালো কোনো জায়গা খোঁজেন, তাহলে সেটি হতে পারে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি। অবশ্য ৬০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের এই জায়গাটিও বাতাসের প্রবল ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পাবে না। এ শহরে পাথুরে মাটির নিচে ভূগর্ভস্থ কিছু টানেল আছে। সেখানে আছে শপিংমল থেকে শুরু করে আছে অত্যাধুনিক আরও অনেক কিছুই। কোনোভাবে সেখানে আশ্রয় নিলে হয়তো বেঁচেও যেতে পারবেন।

আগেই বলেছি, এই অবস্থায় কোনো ভবনই নিরাপদ নয়। মানবনির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠামোও টিকে থাকতে সমস্যার মুখে পড়বে। তবে ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগের বাতাসের ধাক্কা সামলাতে সক্ষম কোনো বস্তু দিয়ে যদি বড় ধরনের বাঙ্কার তৈরি করে তাতে আশ্রয় নিতে পারেন, তাহলে হয়তো বেঁচে যেতে পারবেন।

পৃথিবীর মেরু অঞ্চলগুলোতে বাতাসের বেগ হবে আরও কম। তবে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কোনো শহরই বাঁচতে পারবে না, টিকতে পারবে না এর তোড়ের মুখে
আরও পড়ুন

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এত বড় ধ্বংসলীলাতেও মানবজাতি বিলুপ্ত হবে না। ভূপৃষ্ঠের খুব কম মানুষই বেঁচে থাকতে পারবে। উড়ন্ত ধ্বংসাবশেষ সবকিছু গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবে। তবে মাটির নিচে আশ্রয় নেওয়া কিছু মানুষ বেঁচে যাবে। বিশেষ করে, ঘটনার সময় যারা ভূগর্ভস্থের অনেক নিচে থাকবে, তাদের টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর বাইরেও কিছু ভাগ্যবান মানুষ কোনোভাবে টিকে যেতে পারেন। দক্ষিণ মেরুর আমুন্ডসেন-স্কট রিসার্চ স্টেশনের কয়েক ডজন বিজ্ঞানী এই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবেন। এই সংকটের প্রথম লক্ষণ হিসেবে তাঁরা হঠাৎ খেয়াল করবেন, বাইরের বিশ্ব হঠাৎ নিরব হয়ে গেছে। রহস্যময় নিরবতায় কিছু ব্যাপারে বিভ্রান্ত হলেও শিগগিরই তাঁরা আরও অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করবেন। দেখা যাবে, সূর্য এক জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে।

দক্ষিণ মেরুর আমুন্ডসেন-স্কট রিসার্চ স্টেশনের কয়েক ডজন বিজ্ঞানী এই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবেন। এই সংকটের প্রথম লক্ষণ হিসেবে তাঁরা হঠাৎ খেয়াল করবেন, বাইরের বিশ্ব হঠাৎ নিরব হয়ে গেছে। রহস্যময় নিরবতায় কিছু ব্যাপারে বিভ্রান্ত হলেও শিগগিরই তাঁরা আরও অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করবেন। দেখা যাবে, সূর্য এক জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে

এরপর ঘটতে থাকবে আরও ভয়ানক সব ঘটনা। বাতাসের প্রচণ্ড দাপাদাপি থামার পর, চারপাশের সবকিছু অস্বাভাবিক ভুতুড়ে হয়ে উঠতে থাকবে। বাতাসের ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হতে না হতেই শুরু হবে তাপের বিস্ফোরণ। সাধারণত তীব্র বেগে চলা বাতাসের গতিশক্তি এত কম যে তা তুচ্ছ করা যায়, কিন্তু একে সাধারণ বাতাস বলা যায় না। কারণ বাতাস হঠাৎ থেমে গিয়ে তা অগ্নিদগ্ধ হতে শুরু করবে। ফলে ভূমিতে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ব্যাপক হারে। যেসব জায়গায় বাতাস ভেজা, সেখানে বিশ্বজুড়ে বজ্রপাত শুরু হবে। একই সময়ে সাগর-মহাসাগরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাস উত্তেজিত হয়ে পানির ওপরের পৃষ্ঠতল বাষ্পীভূত করে ফেলবে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হবে, মহাসাগরের কোনো পৃষ্ঠতল নেই। এটি কখন শেষ হবে, তা বলা মুশকিল।

মহাসাগরগুলো সাধারণত শীতল থাকে। ওপরের পাতলা স্তরের পর নিচের অংশে প্রায় সুষমভাবে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখা যায়। এই বাষ্পীয় ঝড় গভীর থেকে শীতল পানিকেও বাষ্পীভূত করতে থাকবে। শীতল পানি থেকে অতি উত্তপ্ত বাতাসের অবিরাম প্রবাহে এমন আবহাওয়া সৃষ্টি হবে, যা পৃথিবীতে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। বাতাস, উত্তপ্ত বাষ্প, কুয়াশার প্রবল ঘূর্ণিপাক এবং অতিদ্রুত পরিবর্তনশীল তাপমাত্রা দেখা দেবে।

পৃথিবীর সবজায়গার সাগর-মহাসাগরে দেখা যাবে বিশাল ঢেউ। সেগুলো পুব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হবে। পূর্বমুখী সৈকতে বড় আকারের ঝড় বয়ে যাবে
আরও পড়ুন

নিচ থেকে তাজা পুষ্টি উপাদান ওপরে উঠে আসার কারণে কিছু কিছু জীবের জন্য ভালোই হবে। একই সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপসহ অনেক সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণী মারা যাবে। কারণ সাগরের গভীরে পানিতে কমে যাবে অক্সিজেনের পরিমাণ। সেখানে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চালাতে পারবে না ওসব প্রাণী। তিমি ও ডলফিনের মতো যেসব প্রাণীর পানির ওপরে উঠে শ্বাস নিতে হয়, বিক্ষুদ্ধ এই সাগরপৃষ্ঠে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

পৃথিবীর সবজায়গার সাগর-মহাসাগরে দেখা যাবে বিশাল ঢেউ। সেগুলো পুব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হবে। পূর্বমুখী সৈকতে বড় আকারের ঝড় বয়ে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাসে সেগুলোই হবে সবচেয়ে বড় ঝড়। সাগর থেকে উঠে আসা বিপুল আকৃতির ঢেউগুলো প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়বে সৈকতে। তার পেছনে ছুটে আসবে অনেক উঁচু বিক্ষুব্ধ জলরাশি। সেটাকে পানির দেয়াল বলাই ভালো। সেই সুনামি সাগরতীর থেকে স্থলভাগের কয়েক মাইল পর্যন্ত ছুটে ভাসিয়ে নেবে সব।

ঝড়ের কারণে বিপুল পরিমাণ ধুলিকণা আর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়বে বায়ুমণ্ডলে। একইসঙ্গে সাগর-মহাসাগরের ওপর তৈরি হবে ঘন কুয়াশার চাদর। সাধারণত এর কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমে যায়। এভাবে পৃথিবীর অন্তত একপাশের তাপমাত্রা কমে যাবে।

আরও পড়ুন
পৃথিবীর যেদিকে দিন থাকবে, সেখানকার পৃষ্ঠ অবিরাম সূর্যের আলোয় ভাজা ভাজা হয়ে যাবে। অন্যদিকে যেপাশে রাত, সেখানে তাপমাত্রা কমে যাবে চরমভাবে। দিনের দিকে সরাসরি সূর্যের নিচের এলাকায় বিশাল আকৃতির ঝড়ের সৃষ্টি হবে

ওদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে যাবে দিন ও রাতের সাধারণ চক্র। তবে আকাশে সূর্যের চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হবে না। বরং প্রতিদিন একবার সূর্য ওঠা ও অস্ত যাওয়ার বদলে বছরে একবার সূর্য উঠতে ও অস্ত যেতে দেখা যাবে। দিন ও রাত প্রতিটি হবে ছয় মাস দীর্ঘ। এমনকি বিষুব অঞ্চলেও তা ঘটবে। পৃথিবীর যেদিকে দিন থাকবে, সেখানকার পৃষ্ঠ অবিরাম সূর্যের আলোয় ভাজা ভাজা হয়ে যাবে। অন্যদিকে যেপাশে রাত, সেখানে তাপমাত্রা কমে যাবে চরমভাবে। দিনের দিকে সরাসরি সূর্যের নিচের এলাকায় বিশাল আকৃতির ঝড়ের সৃষ্টি হবে।

এই থমকে থাকা পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডল সঞ্চালিত হবে বেশ দ্রুত। ফলে দিন ও রাতের দিকের তাপমাত্রা প্রায় একই থাকবে। দিনের দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হলেও মাসের দৈর্ঘ্য বদলাবে না। চাঁদ তখনও পৃথিবীর চারপাশে ঘুরবে। পৃথিবীর ঘূর্ণন না থাকার কারণে চাঁদ টাইডাল এনার্জি পাবে না। তাই চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যেতে পারবে না। ধীরে ধীরে চাঁদ আমাদের দিকে ফিরে আসতে শুরু করবে।

চাঁদ আমাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী। বর্তমানে চাঁদের চেয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি বেশি। পৃথিবীর টাইডাল এনার্জি চাঁদকে যখন আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তখন পৃথিবীর গতি কমে যায়। পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে গেলে আমাদের কাছ থেকে চাঁদের দূরে সরে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। সেটা পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর করার বদলে তার টাইডাল এনার্জি আমাদের ঘূর্ণন ত্বরান্বিত করবে। খুব ধীরে ধীরে চাঁদের মহাকর্ষ আমাদের গ্রহকে টানতে থাকবে। এভাবে একসময় পৃথিবী আবারও ঘুরতে শুরু করবে।

র‍্যান্ডাল মানরোর হোয়াট ইফ? অবলম্বনে