এপ্রিলের শেষ কিছুদিন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীনের একাংশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। অসহ্য গরমে জনজীবন ছিল চরম বিপর্যস্ত। প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্রতার অভাবে দেশজুড়ে দেখা দিয়েছিল তীব্র খরা। অবশ্য মের শুরুতে বৃষ্টিতে খানিকটা স্বস্তি মিলেছে। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, মে মাসের শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক টানা বৃষ্টিপাতে উষ্ণতা কিছু কমলেও পরে আবার তাপপ্রবাহ শুরু হতে পারে।
কোনো স্থানের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে টানা কয়েক দিন বেশি থাকলে তাকে তাপপ্রবাহ বলে। গ্রীষ্মকালে নাতিশীতোষ্ণ ও মেরু অঞ্চলে এরকম তাপপ্রবাহ দেখা যায়।
আবহাওয়াবিজ্ঞানীদের মতে, উচ্চচাপের কারণে কোনো এলাকার বায়ুমণ্ডলে উষ্ণ বাতাস আটকে পড়লে সে অঞ্চলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। এই উষ্ণ বাতাস ওই অঞ্চলের বায়ুমণ্ডল ত্যাগ করতে পারে না। ফলে অন্য অঞ্চলে প্রবাহিত না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি থাকে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে দিনের চেয়ে রাতের দৈর্ঘ্য বড় হয়। ফলে সূর্যের আলো বেশি সময় থাকে।
তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং শহরাঞ্চলের অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে এই উচ্চ তাপমাত্রা দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে থেকে যায়। তাই অতিরিক্ত গরম হয়ে ওঠে পৃথিবী। অবশ্য যেসব এলাকায় বন, নদী ও জলাশয় আছে, সেসব এলাকা এই তাপ কিছুটা শোষণ করতে পারে। কিন্তু এসব পরিবেশ না থাকলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। অনেক বেশি অঞ্চলজুড়ে বাতাস উত্তপ্ত থাকলে ওপরের শীতল বাতাসের সঙ্গে ওই উত্তপ্ত বাতাস মিশে একটা বদ্ধ অবস্থা তৈরি করে। এই বদ্ধ অবস্থায় বায়ুর চাপ অনেক বেশি থাকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ভিন্ন হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন ভৌগোলিক অবস্থান, বায়ুমণ্ডলীয় প্রক্রিয়া, গ্রাম ও শহরাঞ্চলের পরিমাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের হার। বিশ্বব্যাংকের ক্লাইমেট নলেজ পোর্টালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এ দেশের কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা যখন টানা ৩ দিন সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে, তখন সেটাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে তা মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করলে তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়।
এপ্রিলের শেষ দিকে চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ওপর তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে।
গরম থেকে রক্ষা পেতে
যথাসম্ভব গরম থেকে দূরে থাকতে হবে। বাইরে বের হলে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হতে হবে মাঝেমধ্যে। আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হবে সারা দিনে। প্রয়োজনে গোসল করতে হবে একাধিকবার।
বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যেমন ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে দ্রুত। ইউনিসেফের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত এক নির্দেশিকায় প্রচণ্ড গরমে প্রয়োজন না হলে বয়স্ক, শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শিশুদের তরল খাবার খাওয়াতে হবে ও নবজাতকদের নিয়মিত মায়ের দুধ পান করাতে হবে। চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা দিনের প্রথম দিকে বা বিকেলে যখন তাপমাত্রা কম থাকে, তখন যেতে পারেন।
৭৬ বছরের টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভঙ্গ
চলতি বছরের এপ্রিলে টানা যত দিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে হয়নি। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে একটানা ১৬ দিন তাপপ্রবাহ হয়েছিল। এবার তাপপ্রবাহ পুরো এপ্রিলজুড়েই চলেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৮১ সাল থেকে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহের উপাত্ত আছে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর আগে ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল, তবে তা টানা ছিল না। কিন্তু এবার টানা ৩০ দিন তাপপ্রবাহ হলো। আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এমন প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের পেছনে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
এই অতি তাপের কারণে এবার অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প জমা হচ্ছে। আর তাতে চলতি বছর অতিবৃষ্টি হতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাপপ্রবাহের প্রকারভেদ
১. শুষ্ক তাপপ্রবাহ
মহাদেশীয় বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে শুষ্ক তাপপ্রবাহ সংঘটিত হয়। এ সময় আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং সূর্যের বিকিরণ থাকে তীব্র। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া প্রবাহিত হয়। তবে অতিরিক্ত গরমে এ ঝোড়ো হাওয়া গরমের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
২. আর্দ্র তাপপ্রবাহ
এই তাপপ্রবাহ দিনে গরম ও আর্দ্র পরিবেশ তৈরি করে এবং রাতে মেঘের উপস্থিতি তাপ বেরিয়ে যাওয়ার পথ আটকে দেয়। ফলে দিন-রাত সব সময় তীব্র অস্বস্তি অনুভূত হয়। সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ ও উপকূলীয় অঞ্চলে এ ধরনের তাপপ্রবাহ দেখা যায়।
৩. হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট
বড় শহরাঞ্চলে এ ধরনের তাপপ্রবাহ দেখা যায়। কারণ, শহরের রাস্তা, ভবন ও ফুটপাতে প্রচুর কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। কংক্রিট দ্রুত সূর্যের তাপ শোষণ করে এবং অনেক সময় তা ধরে রাখতে পারে। মাটি ও উদ্ভিদের তুলনায় এগুলো দ্রুত তাপ ছাড়তে পারে না। এর ফলে শহরাঞ্চল ঠান্ডা হতে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
দেহে তাপপ্রবাহের প্রভাব
তাপমাত্রা যেভাবে শরীরকে প্রভাবিত করে
২০° সেলসিয়াস
অবস্থা
স্বাভাবিক
হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক। আরামদায়ক তাপমাত্রা।
২৫° সেলসিয়াস
অবস্থা
এখনো স্বাভাবিক
হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক। সামান্য ঘাম দেখা দিতে পারে।
৩০° সেলসিয়াস
অবস্থা
হালকা অস্বস্তিকর
এ তাপমাত্রায় ঘাম হবে, যা বাতাসে বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় তাপ শোষণ করে। ফলে ত্বক ঠান্ডা হয়। তবে মনোযোগে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
৩৫° সেলসিয়াস
অবস্থা
হিট ক্র্যাম্প
হৃৎস্পন্দন ও ঘাম বাড়ে। দেখা দেয় পানি ও লবণের ঘাটতি। ফলে পেশিতে টান লেগে ব্যথা হতে পারে।
৪০° সেলসিয়াস
অবস্থা
ক্লান্তিবোধ
হৃৎস্পন্দন বাড়ে। শরীর ক্লান্ত ও দুর্বল লাগে। প্রচুর ঘাম হয়, সঙ্গে বমিভাব বা বমি হতে পারে।
৪৫° সেলসিয়াস
অবস্থা
হিটস্ট্রোক
তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বাড়লে ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, ত্বক শুষ্ক হয়। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতিসহ মৃত্যুর হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা
সূত্র: আবহাওয়া অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রথম আলো, হাউ ইট ওয়ার্কস
*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত