ঝাল খাওয়া কি দেহের জন্য ভালো

ঝাল খাবারের প্রতি অনেকেরই বিশেষ আগ্রহ। অনেকে ঝাল খাওয়ার মধ্যে বীরত্বও খুঁজে পান। এর বিপরীত মানুষও আছেন। ঝাল একেবারে পছন্দ করেন না তাঁরা। ঝালমুড়িতে থাকা মরিচও খুব যত্ন করে তুলে ফেলে দেন। তাঁদের কাছে ঝাল নিয়ে বাড়াবাড়ি অর্থহীন মনে হয়। তবে ঝালের উপস্থিতি যে কিছু কিছু খাবারের স্বাদ সত্যিই বাড়িয়ে দেয়, এ বিষয়ে সবাই একমত।

কে কতটা ঝাল খেতে পারে, তা যেমন ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে, তেমনি নির্ভর করে কী ধরনের ঝাল খাচ্ছেন, তার ওপরও। আমরা খাবারে ঝাল স্বাদ আনার জন্য যে মরিচ বা গোলমরিচ ব্যবহার করি, তাতে থাকে ক্যাপসাইসিন। এই ক্যাপসাইসিন মূলত জিবে ঝাল স্বাদ তৈরি করে। সাধারণত হোটেল বা রেস্তোরাঁর খাবারে যে পরিমাণ ঝাল খাওয়া হয়, সেটা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। এমনকি অনেক গবেষণা বলে, কিছুটা ঝাল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এ কথা অবশ্য স্বাভাবিক পরিমাণের জন্য প্রযোজ্য।

ক্যাপসাইসিন যৌগটি খুব একটা সাধাসিদে রাসায়নিক নয়। এটা আমাদের মুখে থাকা পলিমোডাল স্নায়ুকে (Polymodal Nociceptor Nerves) উত্তেজিত করে তোলে। ব্যথা, তাপমাত্রা ও ঝাল শনাক্ত করাই এ স্নায়ুর কাজ। পাশাপাশি এটা আমাদের মস্তিষ্কে অনুভূতির তীব্রতা সম্পর্কেও তথ্য পাঠায়।

মরিচে থাকা ক্যাপসাইসিন যখন স্নায়ুকে উত্তেজিত করে তোলে, তখন মস্তিষ্ক ঝালের কারণে সৃষ্ট ‘বার্নিং সেনসেশন’ বা ‘পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি’ শনাক্ত করে। এই ঝাল ঝাল অনুভূতি থেকে রক্ষার জন্য মস্তিষ্ক থেকে অ্যান্ডরফিন (Andorphine) নামে একধরনের রাসায়নিক নিঃসরিত হয়। এটি একধরনের নিউরোকেমিক্যাল, বাংলায় বলা যেতে পারে স্নায়বিক রাসায়নিক। এই অ্যান্ডরফিন ব্যথা কমিয়ে দেয়। শরীরে অ্যান্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ডোপামিন নামে আরেক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণ করে। ফলে আমাদের মধ্যে ভালো লাগা, খুশি থাকা ও সুখের অনুভূতি তৈরি হয়। ঝাল খেতে অনেকে কেন পছন্দ করেন, সে প্রশ্নের উত্তর রয়েছে এখানে।

তবে ক্যাপসাইসিন যেহেতু কিছুটা বিপদজনক যৌগ, তাই এটা একসঙ্গে অনেক বেশি খেলে বুক জ্বালাপোড়া করে। এমনকি পাকস্থলী ফুলে যেতে পারে। এ ছাড়া যাদের আগে থেকে ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রমের মতো সমস্যা আছে, তাদের অসুখ বাড়িয়ে তুলতে পারে এটি। ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রম (Irritable Bowel Syndrome—IBS) হলো পরিপাকতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী একটি সমস্যা। এর ফলে আমাদের অন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে বিভিন্ন সময় নানারকম অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। এটি কোনো মারাত্মক রোগ নয়, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বেশ প্রভাব ফেলে।

শিশুদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঝাল অনেক সময় প্রাণঘাতি হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার কারণে মারা যায়। আগে থেকে হৃদরোগজনিত সমস্যা ছিল তার। মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চালু হওয়া একটি চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে গিয়ে অতিরিক্ত ঝালযুক্ত টর্টিলা চিপ খাওয়ার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কতটা ঝাল খাবার বিপদজনক? এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। আপনার ঝাল খাওয়ার অভ্যাস থাকলে অসুবিধা নেই। তবে ঝাল খাওয়ার অভ্যাস না থাকলে শুধু শুধু নিজের জিবের স্বাদের তুলনায় বেশি ঝাল খেতে যাওয়া মোটেও উচিত নয়।

আরও পড়ুন

বলা হয়, সাধারণত কোনো একটি পদের জন্য ১ চা-চামচের এক-অষ্টমাংশের বেশি ঝাল খাওয়া উচিৎ নয়। এটি একটি গড়পড়তা হিসাব; অবশ্যই, যাঁরা ঝাল সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের জন্য। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে, মোটামুটি ০.৫ মিলিগ্রাম থেকে ১ মিলিগ্রামের মতো ক্যাপসাইসিন নিরাপদ বলা যেতে পারে। এই তথ্য জানিয়েছে জার্মান ফেডারেল ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট (বিএফআর)।

তার মানে, অতিরিক্ত ঝাল খাওয়া হয়তো সাময়িকভাবে ডোপামিন নিঃসরণ করে আপনাকে আনন্দ দেবে, কিন্তু সেই আনন্দের জন্য নিজের বিপদের পথ খুলে দেওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যতটুকু ঝাল সহ্য করতে পারেন, ততটুকুই খান। কোনো কারণে হঠাৎ অতিরিক্ত ঝাল খেয়ে ফেললে জিহ্বা শান্ত করার জন্য দুধ খেতে পারেন। দুধে থাকে ক্যাসেইন (Casein) প্রোটিন। ক্যাপসাইসিনের (Capsaicin) প্রভাব নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করে এটি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, উইকিপিডিয়া