অদ্ভুতুড়ে সব গবেষণার রাজ্যে

ক্ষেপণাস্ত্রের ভেতরে জীবিত কবুতর রেখে ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যে পাঠানোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দেওয়া হয়েছে ইগ নোবেল

নামে ‘নোবেল’ আছে ঠিকই, কিন্তু এটা সত্যিকারের নোবেল পুরস্কার না। কেউ একে বলেন নোবেলের বিদ্রূপাত্মক রূপ। ইংরেজিতে বলে ‘প্যারোডি’। তবে সত্যিকারের গবেষণা বা আবিষ্কারের জন্যই দেওয়া হয় এই পুরস্কার। গবেষণাটি বিচিত্র বা হাস্যকর হলেই কেবল এ পুরস্কার কপালে জোটে। উঁহু, কথাটা ঠিক হলো না, সে ক্ষেত্রে গবেষণাটি এই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয় কেবল। তারপর যাচাই-বাছাই করে দেওয়া হয় পুরস্কার। বুঝতেই পারছেন, বলছি ‘ইগ নোবেল’-এর কথা।

অক্টোবর মাসে ঘোষণা করা হয় নোবেল পুরস্কার। এর একমাস আগে ঘোষণা আসে ইগ নোবেলের। বিজয়ীদের হাতে এ বছর ইগ নোবেল তুলে দেন ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী নোবেল জয়ী এসথার ডাফলো। মঞ্চে আরও ছিলেন ২০২৩ সালে রসায়নে নোবেল জয়ী ফরাসি বিজ্ঞানী মুঙ্গি বাওয়েন্ডি।

ইগ নোবেল জিতলে পুরস্কার হিসেবে স্মারকের সঙ্গে বিজয়ীরা পান ১০০ ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন = ১০০০ বিলিয়ন, আর ১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি) জিম্বাবুয়েন ডলারের একটি একক ব্যাংক নোট। এই নোটের মূল্যমান মাত্র ৪০ মার্কিন সেন্ট। বুঝতেই পারছেন, এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয় একরকম রসিকতা করে। 

অ্যানালস অব ইমপ্রোবাবল রিসার্চ নামের একটি পত্রিকা ইগ নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর বেশ ঘটা করে এই পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) একটি অনুষ্ঠানে ২০২৪ সালের ইগ নোবেল বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে পুরস্কার। এবারের তালিকায়ও আছে অদ্ভুত সব আবিষ্কার ও গবেষণা।

এবারের ইগ নোবেলের থিম ছিল মার্ফিস ল বা মার্ফির নীতি। এই নীতি অনুযায়ী, কোথাও যদি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে ভুল হবেই। এ বছরের হাস্যকর বা ব্যঙ্গাত্মক ইগ নোবেল কাকে কী কারণে দেওয়া হলো, চলুন, দেখে নেওয়া যাক।

উদ্ভিদবিজ্ঞান

যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকব হোয়াইট এবং জার্মানির ফিলিপ ইয়ামাশিতা এই বিভাগে পুরস্কার জিতেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার উদ্ভিদ বোকিলা ট্রাইফোলিওলাটা (Boquila trifoliolata) নিজের আশপাশে থাকা প্লাস্টিকের গাছের পাতার আকৃতি নকল করতে পারে! এই পর্যবেক্ষণ থেকে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, গাছেরও দৃষ্টি বা চোখ আছে।

অ্যানাটমি

প্যারিসের নেকার-অ্যানফ্যান্টস ম্যালাডেস ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের অধ্যাপক রোমান খন্সারি ও তাঁর সহকর্মীরা মাথার চুল কোন দিকে প্যাঁচানো থাকে, তা নিয়ে গবেষণা করে অ্যানাটমি বা দেহের গঠনতন্ত্র বিভাগে ইগ নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। উত্তর গোলার্ধে বেশির ভাগ মানুষের মাথার চুল ঘড়ির কাঁটার দিকে প্যাঁচানো থাকে কি না এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বেশির ভাগ মানুষের চুল ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে প্যাঁচানো থাকে কি না—তা নিয়েই ছিল তাঁদের গবেষণা।

শারীরতত্ত্ব

যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের একদল গবেষক আবিষ্কার করেছেন, অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী মলদ্বার দিয়ে শ্বাস নিতে সক্ষম! ইঁদুর ও শূকরের ওপর একাধিক পরীক্ষা করা হয়েছে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য। এসব প্রাণীর মলদ্বারে অক্সিজেন সরবরাহ করে দেখা গেছে, এর মাধ্যমে অক্সিজেন শোষণ হয়। এই পদ্ধতি শ্বাসযন্ত্র বিকল হলে বিকল্প হিসেবে কাজ করে কি না, তার একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও হয়েছে। 

আরও পড়ুন

জীববিজ্ঞান

এই বিভাগে মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছেন ফোর্ডিস এলি ও উইলিয়াম পিটারসেন। ১৯৪০ সালে পশুর দুধ উত্পাদনে প্রভাব পড়ার কারণ অনুসন্ধান করেন তাঁরা। জার্নাল অব অ্যানিমেল সায়েন্স-এ সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। সেখানে তাঁরা লেখেন, একটি গরুর পিঠে একটি বিড়াল রেখে দেখা হয়েছে, দুধের প্রবাহ পরিবর্তন হয় কি না। পাশাপাশি বিড়াল বসিয়ে বারবার কাগজের ব্যাগ ফাটিয়ে দেখা হয়েছে—ইংরেজিতে অবশ্য বলা হয়েছে ‘কাগজের ব্যাগ বিস্ফোরণ’! গবেষকেরা দুই মিনিট ধরে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একটি কাগজের ব্যাগ ফাটিয়ে গরুকে ভয় দেখান। পরে পিঠে বিড়াল রাখা অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় বিড়ালকে পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ গবেষণায় দেখা গেছে, আতঙ্কিত গরু কম দুধ দেয়।

ওষুধ

কোন নকল ওষুধ বেশি কার্যকর, এটি খুঁজে বের করায় দেওয়া হয়েছে এবারের ওষুধ বিভাগের ইগ নোবেল। গবেষণায় দেখা গেছে, যে নকল ওষুধ যন্ত্রণাদায়ক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটি বেশি কার্যকর। যে নকল ওষুধ বেশি পার্শ্বপতিক্রিয়া দেখায় না, সেটি কম কার্যকর। সুইজারল্যান্ড, জার্মানি এবং বেলজিয়ামের একদল গবেষক ওষুধের এই প্রতিক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন।

পদার্থবিজ্ঞান

সাঁতার কাটতে সক্ষম মৃত ট্রাউট মাছের ওপর বিস্তৃত গবেষণা ও অনেকগুলো গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস লিয়াও জিতেছেন পদার্থবিজ্ঞানে ইগ নোবেল।

পরিসংখ্যান

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক জাদুকর পার্সি ডায়াকোনিসের দেওয়া একটি হাইপোথিসিস পরীক্ষা করার জন্য ৫০ জন গবেষকের একটি দল নিয়োগ করা হয়েছিল। হাইপোথিসিসটি কী? তাঁর দাবি ছিল, ওপরে ছুড়ে দেওয়া মুদ্রার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মুদ্রার যে পিঠ ওপরে রেখে ছোড়া হয়, নামার পরে সেই পিঠই ওপরে থাকার সম্ভাবনা বেশি। গবেষক দল ডায়াকোনিসের এই হাইপোথিসিস পরীক্ষা করতে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭৫৭টি মুদ্রা নিয়ে টস করেন। দেখা গেল, ডায়াকোনিসের হাইপোথিসিস সত্যি!

রসায়ন

নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামের একদল গবেষক জিতেছেন রসায়নে ইগ নোবেল। ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে তাঁরা কোন কৃমি মাতাল এবং কোনটি শান্ত (মাতাল নয়), তা আলাদা করার উপায় নিয়ে গবেষণা করেছেন।

জনসংখ্যা

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সাউল জাস্টিন নিউম্যান জনসংখ্যা নিয়ে অনুসন্ধানী কাজের জন্য পুরস্কার জিতেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, যেসব এলাকা থেকে খবর আসে যে সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী মানুষেরা বাস করেন, সেসব এলাকায় জন্ম-মৃত্যুর রেকর্ড ঠিকভাবে রাখা হয় না। এসব এলাকার মানুষের বেশি বয়সের খবর পাওয়া যাওয়ার কারণ, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ সঠিকভাবে না রাখা এবং পেনশন জালিয়াতি।

আরও পড়ুন

শান্তি

ক্ষেপণাস্ত্রের ভেতরে জীবিত কবুতর রেখে ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যে পাঠানোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য মার্কিন মনোবিজ্ঞানী প্রয়াত বিএফ স্কিনার পেয়েছেন এবারের ইগ নোবেল শান্তি পুরস্কার। তাঁর প্রকল্পের নাম ছিল ‘ক্র্যাকপট’। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি উপকূলরেখা চেনাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল একটি কবুতরকে। এই কবুতর ক্ষেপণাস্ত্রের দিক ঠিক রাখতে পারে কি না, তা যাচাই করেছিলেন স্কিনার।

সূত্র: অ্যানালস অব ইমপ্রোবাবল রিসার্চ ও দ্য গার্ডিয়ান

লেখক: সহসম্পাদক, কিশোর আলো