চাঁদের অদেখা ওপাশে কী আছে

সে সময়ে মানুষ প্রথমবারের মতো দেখল চাঁদের উল্টোপিঠ। দেখে হতবাক হয়ে গেল। ছবির মান খারাপ, তবে সেজন্য নয়

প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মহাজাগতিক প্রতিবেশী চাঁদ। সাদামাটা এই উপগ্রহ নিয়ে কোনোকালেই মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না। মাস গণনা, জোয়ার-ভাটার প্রস্তুতি নেওয়া বা ভাগ্যগণনা—সবই হয়েছে চাঁদকে ঘিরে। এখনও পৃথিবীর মানুষ জোছনার আলোয় আপ্লুত হন, কবি-সাহিত্যিকেরা রচনা করেন গল্প-গাঁথা-কাব্য-গান। এত কিছুর পরেও মাত্র এক শতাব্দী আগে চাঁদ সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানত না।

শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা তাঁদের মতো করে টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদ দেখেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন উপগ্রহটির আসল রূপ। কিন্তু সফলতা আসেনি। তার অবশ্য কারণ আছে। গোলাকার হলেও পৃথিবী থেকে চাঁদের মাত্র একটা দিক দেখা যায়। অন্যপাশটা সবসময়ই থাকে আড়ালে।

গোলাকার মহাজাগতিক বস্তু, তাও আবার পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। হিসেবে তো চাঁদের সম্পূর্ণটাই দেখা যাওয়ার কথা সময়ের সঙ্গে। কিন্তু যায় না। কারণ, চাঁদ তার নিজ অক্ষের ওপর এক চক্কর সম্পন্ন করতে এবং পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে প্রায় সমান সময় নেয়। শুধু চাঁদ নয়, মহাবিশ্বের অনেক গ্রহ-উপগ্রহই এ কাজ করে। এর পেছনে কারণও কাছে। তবে সেদিকে এখন যাব না। ইংরেজিতে ঘূর্ণনের এই বিশেষ ব্যবস্থাকে বলে ‘টাইডাল লক’।

টাইডাল লকের কারণে পৃথিবী থেকে চাঁদের শুধু একপাশ দেখা যায়
উইকিমিডিয়া

যাহোক, টাইডাল লকের কারণে পৃথিবী থেকে কোনোভাবেই চাঁদের উল্টোপিঠ দেখা যায় না। এ অংশটি দেখতে হলে যেতে হবে চাঁদের উল্টোপাশে। সেটা হতে পারে সশরীরে, কিংবা রোবোটিক নভোযানে করে ক্যামেরা পাঠিয়ে।

দ্বিতীয় এ কাজটিই করেছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত একাডেমি অব সায়েন্সেসের একদল বিজ্ঞানী। ১৯৫৯ সালে তাঁরা ক্যামেরা বসিয়ে একটি রকেট পাঠিয়ে দিলেন চাঁদের অন্যপাশে। রকেটটির নাম ছিল লুনা ৩। সে সময়ে মানুষ প্রথমবারের মতো দেখল চাঁদের উল্টোপিঠ। দেখে হতবাক হয়ে গেল। ছবির মান খারাপ, তবে সেজন্য নয়। হতবাক হওয়ার কারণ, চাঁদের দুপাশের ছবিতে বলতে গেলে কোনো মিলই নেই।

চাঁদের এপাশটা জুড়ে আছে নানা খানাখন্দ, গভীর গর্ত। ফলে চাঁদের বুকজুড়ে দেখা যায় আঁকাবাঁকা কালো দাগ। চাঁদের কলঙ্ক হিসেবেও এসব চেনেন অনেকে। চাঁদের দৃশ্যমান অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কালোদাগের আরেক নাম মারিয়া। লাতিন ভাষায় ‘mare’ শব্দের অর্থ সমুদ্র। এই ‘মারে’ শব্দটিই ইংরেজিতে এসে হয়ে গেছে ‘মারিয়া’। আগের দিনে বিজ্ঞানীদের কাছে যখন ভালো দুরবিন ছিল না, তখন এসব খানাখন্দ দেখে তাঁরা সমুদ্র বলে ধরে নিতেন। নামকরণটা সে কারণেই। তবে চাঁদে পানির সমুদ্র না থাকলেও ছিল ম্যাগমার সমুদ্র। সেটা অবশ্য চাঁদের জন্মলগ্নের কথা। এই ম্যাগমার সমুদ্র শীতল হয়ে গভীর কালো দাগের সৃষ্টি করেছে। সে দিক থেকে বিজ্ঞানীদের নামকরণকে ভুল বলার সুযোগ নেই।

অদেখা পাশটার মাত্র ১ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে আছে মারিয়া। অথচ দৃশ্যমান পাশে মারিয়ার পরিমাণ ৩১.২ শতাংশ

চাঁদের অন্যপাশটায় এত কালো ছায়া মারিয়ার মতো এত বিশাল নয়। খানাখন্দ যে কম অন্যপাশে, বিষয়টা তা নয়। বরং টেলিস্কোপে তোলা ছবিতে আরও বেশি দাগ দেখা যায় অন্যপাশে। তবে সেসব দাগ মারিয়ার মতো এত ঘনকালো নয়। সূর্যের আলোও বেশি প্রতিফলিত হয় ওপাশে। কিছু কালো অঞ্চলও আছে চাঁদের অন্যপাশে, কিন্তু সেটার পরিমাণ কম। অদেখা পাশটার মাত্র ১ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে আছে মারিয়া। অথচ দৃশ্যমান পাশে মারিয়ার পরিমাণ ৩১.২ শতাংশ। সহজ কথায়, চাঁদের দৃশ্যমান অঞ্চলের চেয়ে অদৃশ্য অঞ্চলের পৃষ্ঠের মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য।

চাঁদের দুপাশ কেন দুরকম, বিজ্ঞানীদের কাছে সেটা দীর্ঘদিন এক রহস্য হয়েই ছিল। সেই রহস্য এখনও পুরো কাটেনি। তবে তাঁদের কাছে এখন কিছু গ্রহণযোগ্য ব্যাখা আছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখাটির কথাই বলা যাক।

বিজ্ঞানীরা চাঁদের মাটি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন। সেটা ১৯৬৯ সালের কথা। নীল আর্মস্ট্রং যখন প্রথম চাঁদে নেমেছিলেন, তখনই ফেরার সময় নিয়ে এসেছিলেন প্রায় সাড়ে ২১ কেজি মাটি। পরেও বিজ্ঞানীরা চাঁদের গঠন বুঝতে আরও নানা রকম যন্ত্র পাঠিয়েছেন। গত অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সংগ্রহ করেছেন নানারকম তথ্য উপাত্ত। এসব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চাঁদের গাঢ় অঞ্চলের রাসায়নিক গঠন উজ্জ্বল অঞ্চলের চেয়ে বেশ আলাদা। তেজস্ক্রিয় মৌল থোরিয়ামের উপস্থিতি এখানে অনেক বেশি। তা ছাড়াও এ অঞ্চলে আছে পটাশিয়াম, ফরফরাস, এমনকি ইউরোনিয়ামসহ পৃথিবীতে দুষ্প্রাপ্য কিছু মৌল। এসব মৌলের উপস্থিতি জানা যায় নাসার লুনার প্রসপেক্টর মিশনে গামা-রে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে তৈরি মানচিত্র থেকে।

অজস্র আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে চন্দ্রত্বকে ম্যাগমার সমুদ্র তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অতিকায় এই অগ্ন্যুৎপাতের কারণ ছিল থোরিয়াম ও ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় মৌলের উপস্থিতি। এসব মৌল প্রচুর পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে। ফলে, দীর্ঘ সময় ধরে চাঁদের পৃষ্ঠে জমে ছিল ম্যাগমার সমুদ্র। একসময় তা ঠান্ডা হয়ে পাতলা চন্দ্রত্বকে পরিণত হয়। এ কারণে দেখা যায়, চাঁদের অন্যপাশের ত্বক আমাদের দৃশ্যমান অংশের চেয়ে গড়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার পুরু।

প্রশ্ন হলো, চাঁদের একপাশেই কেন এসব মৌল বেশি করে জমা হলো? পুরো পৃষ্ঠে কেন সমভাবে বন্টিত হলো না?

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে চাঁদের জন্ম প্রক্রিয়ায়। চাঁদের উৎপত্তি নিয়ে অনেকগুলো অনুকল্প আছে। যার একটি বলে, পৃথিবী গঠিত হওয়ার সময় মঙ্গল গ্রহের আকারের একটি প্রোটোপ্ল্যানেট বা আদিগ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা সেই আদিগ্রহটির নাম দিয়েছেন থিয়া। বিশাল এই সংঘর্ষের ফলে জন্ম হয় চাঁদের। উত্তপ্ত চাঁদ ও পৃথিবীর গতি একসময় কমে আসে। ফলে, চাঁদ পৃথিবীর সঙ্গে পুরোপুরি টাইডালি লকড হয়ে যায়। এ সময় পৃথিবীও অনেক উত্তপ্ত ছিল। তাপমাত্রা ছিল প্রায় ২ হাজার ৭০০ কেলভিনের মতো। এই তাপের কারণেই চাঁদের দৃশ্যমান অঞ্চলের এসব মৌলের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। এমনটাই মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

আগেই বলেছি, চাঁদের ভিন্নরূপের পেছনে এটি একটি ব্যাখা। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। যদিও বোঝার জন্য একে যত সহজভাবে বলা হলো, মূল ঘটনা তার চেয়ে অনেক জটিল। তবে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত চাঁদ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে এ ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, এভাবে সব হলে চাঁদ বর্তমান অবস্থায় আসতে পারে।

চাঁদের অদেখা পাশকে ইংরেজিতে ‘ডার্ক সাইড’ বলা হয়। মজার বিষয় হলো, এই ডার্ক মানে কিন্তু অন্ধকার নয়। চাঁদের পুরোটা জুড়েই সূর্যের আলো পড়ে। গড়ে প্রায় সমান আলোই পড়ে দুপাশে। কিন্তু পৃথিবী থেকে অন্যপাশটা দেখা যায় না বলে এমনটা বলা হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: বিগ থিংক, প্ল্যানেটারি সোসাইটি, উইকিপিডিয়া