জানা-অজানা
বাংলাদেশে ঈদ সৌদি আরবের একদিন পরে হয় কেন
সৌদি আরবের একদিন পর সাধারণত ঈদ হয় বাংলাদেশে। সৌদি আরব বাংলাদেশের পশ্চিমে, আর জাপান পূর্বে। দুই দেশেই বাংলাদেশের একদিন আগে ঈদ হয় কীভাবে? কেন ঠিক একদিন পরেই আমাদের দেশে ঈদ হয়, জেনে নিন...
সৌদি আরবে ঈদের চাঁদ দেখা গেলে তারপর দিন বাংলাদেশে ঈদ—এটা এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু মানচিত্রে তাকালে দেখবেন, সৌদি আরব আমাদের পশ্চিমে। সময়ের পার্থক্য মাত্র ৩ ঘণ্টার। যেহেতু পশ্চিমে, তাই বাংলাদেশের ৩ ঘণ্টা পরে সৌদি আরবে দিন হয়। তাহলে আমরা কেন একদিন পরে ঈদ পালন করি? আমাদের তো আরও ৩ ঘণ্টা আগে ঈদ পালন করার কথা! আসলে এখানে একটু রহস্য আছে। সে রহস্যের সমাধান করতে হলে একটুখানি বিজ্ঞান জানতে হবে।
রহস্যের জট খোলার আগে বুঝতে হবে সৌরবর্ষ ও চন্দ্রবর্ষ কী। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন। সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে আবার নিজেই নিজের চারপাশে ঘোরে পৃথিবী। অনেকটা লাটিমের মতো। লাটিম নিজে ঘোরে এর ভেতরের গজালটিকে কেন্দ্র করে, পাশাপাশি আবার ঘুরতে থাকে বৃত্তাকারে। এভাবে নিজের চারপাশে ঘুরতে পৃথিবীর সময় লাগে প্রায় ২৪ ঘন্টা, অর্থাৎ ১ দিন। এগুলো সৌরবর্ষের হিসাব।
চাঁদও নিজের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরতে সময় লাগে ২৭.৩ দিন। কিন্তু নতুন চাঁদ দেখা যায় গড়ে প্রায় ২৯.৫ দিন পর। কারণ চাঁদ দেখার জন্য চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে অন্তত ১০.৫ ডিগ্রি কোণ তৈরি হতে হয়। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
চাঁদের এই ঘূর্ণনের কারণে চন্দ্রমাস কখনো হয় ২৯ দিনে, আবার কখনো ৩০ দিনে। এভাবে ১২ মাস হয়। অর্থাৎ ১২ বার নতুন চাঁদ ওঠে। ঈদের ঠিক আগে এরকম একটি নতুন চাঁদের অপেক্ষায় থাকি আমরা। যাই হোক, চন্দ্রমাসের হিসেব অনুসারে বছর হতে ৩৬৫ দিন লাগে না। লাগে ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন। ফলে সৌরবর্ষের সঙ্গে প্রায় ১০ বা ১১ দিনের পার্থক্য দেখা যায়। আরবি ক্যালেন্ডারে এই পার্থক্যটা আর পূরণ করা হয় না। ফলে প্রতিবছর ঈদ ১০ বা ১১ দিন করে এগিয়ে আসে। যেমন গত বছর ঈদ হয়েছিল ২২ এপ্রিল। এ বছর ঈদ হতে পারে ১০ বা ১১ এপ্রিল। অর্থাৎ ১১/১২ দিন এগিয়েছে। আগামী বছর হয়তো ১ এপ্রিল ঈদ হতে পারে।
ফলে সৌরবর্ষের সঙ্গে প্রায় ১০ বা ১১ দিনের পার্থক্য দেখা যায়। আরবি ক্যালেন্ডারে এই পার্থক্যটা আর পূরণ করা হয় না। ফলে প্রতিবছর ঈদ ১০ বা ১১ দিন করে এগিয়ে আসে
এবার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আমরা যে দিনের হিসাব করি, তা সৌরবর্ষের হিসেবে। অর্থাৎ যে দেশে আগে সূর্য উঠবে, সে দেশে দিন শুরু হবে আগে। কিন্তু রোজা বা ঈদ অনুষ্ঠিত হয় চন্দ্রবর্ষ অনুসারে। আমরা যে সৌদি আরব থেকে ৩ ঘণ্টা এগিয়ে আছি, তা আসলে সৌরবর্ষের হিসাবে। কিন্তু চন্দ্রবর্ষের হিসেবে আমরা মোটেও সৌদি আরব বা পশ্চিমা দেশ থেকে এগিয়ে নেই। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে আরও একটুখানি বিজ্ঞান বুঝতে হবে।
পৃথিবীর ঘূর্ণনটাও একটু জানতে হবে। পৃথিবী ঘোরে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে। ফলে সূর্যোদয় হয় পূর্বে আর অস্ত যায় পশ্চিমে। একইভাবে চাঁদও ঘোরে। কিন্তু পৃথিবী থেকে দেখলে চাঁদকে পশ্চিম আকাশে আগে দেখা যায়।
তাহলে পার্থক্য ৩ ঘণ্টা হলেও আমরা কেন একদিন পরে ঈদ পালন করি? কারণ যে তিন ঘণ্টা পার্থক্যের কথা বলছি, তা তো সূর্যের হিসেবে। চাঁদের হিসেবে এই পার্থক্যটা আসলে ২১ ঘন্টার। ফলে ঈদ যেহেতু চন্দ্রবর্ষের হিসাবে হয়, তাই হিসেবটাও করতে হবে চন্দ্রবর্ষ ধরে। আর ইতিমধ্যেই বলেছি, চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে পার্থক্য আসলে ৩ ঘণ্টার নয়, ২১ ঘণ্টার। অর্থাৎ বাংলাদেশের ২১ ঘণ্টা আগে চাঁদ দেখা যায় সৌদি আরবের আকাশে।
আরেকটা প্রশ্ন আপনার মাথায় আসতে পারে। বুঝলাম, সৌদি আরব বাংলাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত, তাই সে দেশে আগে চাঁদ দেখা যায় এবং আগে ঈদ হয়। কিন্তু যে দেশ বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত, যেমন জাপান কিংবা ইন্দোনেশিয়া—সেখানে কেন বাংলাদেশের একদিন আগে ইদ হয়? অর্থাৎ সৌদি আরব বাংলাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত, আর জাপান পূর্বে। তাহলে দুটি দেশ একই দিনে ঈদ পালন করে কীভাবে? বাংলাদেশই-বা মাঝে থেকে কেন একদিন পরে ঈদ পালন করে? এর সম্ভাব্য দুটি কারণ আছে।
প্রথমটা হলো, বাংলাদেশের চেয়ে জাপানে সূর্যাস্ত হয় আগে। অর্থাৎ যখন বাংলাদেশে চাঁদ দেখার কথা, তখন সূর্যের আলো থাকে। ফলে আমরা চাঁদ দেখতে পারি না। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া কিংবা জাপানের মতো পূর্বের দেশগুলোতে তখন থাকে সন্ধ্যা। ফলে তারা ঠিকই চাঁদ দেখতে পারে। শুধু সূর্যের আলোর কারণেই আমরা চাঁদ দেখতে পারি না। পরদিন চাঁদ আবার উঠলে আমরা সেই চাঁদ দেখি। এ কারণে জাপান বা ইন্দোনেশিয়া আমাদের পূর্বে থেকেও একদিন আগে পশ্চিমাদের সঙ্গে ঈদ পালন করতে পারে।
আর ইতিমধ্যেই বলেছি, চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে পার্থক্য আসলে ৩ ঘণ্টার নয়, ২১ ঘণ্টার। অর্থাৎ বাংলাদেশের ২১ ঘণ্টা আগে চাঁদ দেখা যায় সৌদি আরবের আকাশে
আর দ্বিতীয় কারণটা হলো, খালি চোখে চাঁদ দেখতে হলে চাঁদ ও সূর্যের মধ্যবর্তী কোণ হতে হয় ১০.৫ ডিগ্রি। ফলে জাপানে যখন সূর্য ও চাঁদের মধ্যবর্তী কোন ১০.৫ ডিগ্রি হয়, বাংলাদেশে তখন হয় না। এই কোণ হতে যে পরিমাণ পথ পাড়ি দিতে হয়, তাতে চাঁদের প্রায় ১৭ থেকে ২৪ ঘণ্টা লেগে যায়। তাই আমরা জাপানের চেয়ে পরে চাঁদ দেখি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশ বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত, তারা আমাদের চেয়ে আগে ঈদ করে। আবার যারা পূর্বে অবস্থিত, তারাও। মাঝে থেকে বাংলাদেশ ঈদ পালন করে তাদের চেয়ে একদিন পরে!
লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা