মে মাসে নতুন যা জানলাম

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড়

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পৃথিবীতে একটি বিরল ও শক্তিশালী সৌরঝড় আঘাত হানে। গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র সৌরঝড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এটিকে। এতে অস্ট্রেলিয়ার অঙ্গরাজ্য তাসমানিয়া থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের আকাশে বর্ণিল আলো দেখা যায়। এ আলোকে বলা হয় অরোরা। মেরুজ্যোতি নামেও এটি পরিচিত।

সূর্যের অভ্যন্তরে যে বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়, তাতে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণু আন্দোলিত হতে থাকে। এতে ইলেকট্রন, প্রোটন সূর্যের বায়ুমণ্ডলের উত্তপ্ত বাইরের স্তর ‘করোনা’ থেকে দ্রুতগতিতে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এ ব্যাপারটিকে বলে সৌরবায়ু বা সৌরঝড়।

আসলে, সৌরবায়ু মুক্ত চার্জযুক্ত প্লাজমা কণা ও গামারশ্মি, এক্স-রের মতো ক্ষতিকর রশ্মির সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে। পৃথিবীতে আসার সময় সৌরবায়ু নিজেই তার চারপাশে একটি চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি, যা করোনাল মাস ইজেকশন নামে পরিচিত। ১০০ কোটি পরমাণু বোমা একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটলে যে পরিমাণ শক্তির জন্ম হয়, ঠিক ততটাই শক্তিশালী এই চৌম্বকক্ষেত্র। কিন্তু পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে এরা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে কিছু কণা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে আটকে পড়ে এবং চৌম্বকরেখা বরাবর সক্রিয় হয়ে ওঠে। এসব কণাই পরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটা স্তরে প্রবেশ করে। মুক্ত প্রোটন ও ইলেকট্রনগুলো তখন বায়ুমণ্ডলে ভাসতে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। সংঘর্ষের সময় কিছু শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি গ্রহণ করে বায়ুমণ্ডলীয় পরমাণুর ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে লাফিয়ে উঠে পড়ার সুযোগ পায়। পরে নিম্ন শক্তিস্তরে ফিরে আসার সময় এরা শক্তি বিকিরণ করে। বিকিরিত সেই শক্তিই ফোটন বা ফোটনের ঝাঁক, অর্থাৎ আলো হিসেবে দেখা দেয়। ফলে সবুজ, লাল, নীল, গোলাপিসহ বিভিন্ন আলোয় বর্ণিল হয়ে ওঠে আকাশ। এই আলোর খেলাই অরোরা।

২. নতুন বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান

আমাদের সৌরজগত থেকে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে একটি এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। আকৃতিতে এটি পৃথিবীর মতো। এটিই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে কাছের সম্ভাব্য বাসযোগ্য গ্রহ বলে মনে করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ও স্কটল্যান্ডের গবেষকরা ‘গ্লিস ১২বি’ নামে নতুন এ গ্রহ আবিষ্কার করেছেন।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ‘স্পেস টেলিস্কোপ ট্রানজিটিং এক্সোপ্ল্যানেট সার্ভে স্যাটেলাইট’ ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো ‘গ্লিস ১২বি’ গ্রহটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, গ্রহটির উপরিভাগের তাপমাত্রা প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রহটি পৃথিবীর ১২ দিন ৮ ঘণ্টায় এর সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। গ্রহটির নাম রাখা হয়েছে সূর্যের নাম ‘গ্লিস ১২’। এটি একটি লাল বামন নক্ষত্র। যুক্তরাজ্যের রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এ গ্রহ আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হয়।

১৮ মাস বয়সী ওপাল স্যান্ডি

৩. জিন থেরাপিতে শ্রবণশক্তি পুনরুদ্ধার

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জিন থেরাপির মাধ্যমে জন্মগতভাবে বধির এক শিশু শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়েছে। যুক্তরাজ্যের ১৮ মাস বয়সী ওপাল স্যান্ডি নামের এক মেয়ে শিশুকে এই থেরাপি দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত স্যান্ডিই সবচেয়ে কম বয়সী শিশু, যাকে এ থেরাপি দেওয়া হয়েছে। শিশুটি ‘অডিটরি নিউরোপ্যাথি’ নামে একটি রোগে ভুগছিল। এ রোগের কারণে ভুক্তভুগীরা শব্দ শনাক্ত করতে পারে ঠিকই, কিন্তু মস্তিষ্কে তা রিলে হয় না। মানে মস্তিষ্ক সেই শব্দ শনাক্ত করতে বা বুঝতে পারে না। এ কারণে শিশু জন্মের সময় থেকেই বধির থাকে।

১৬ মিনিটের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুটির কানে কার্যকরী জিন স্থাপন করা সম্ভব হয়। অস্ত্রোপচারের পর থেকে শব্দের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে শিশুটি। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে।

৪.  গ্লুবল নামের নতুন অতিপারমাণবিক কণা

চীনের বেইজিংয়ে অবস্থিত বেস ৩ কোলাবোরেশনের আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি দল সম্প্রতি গ্লুবল নামে একটি নতুন কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। ২ মে, বৃহস্পতিবার ফিজিক্যাল জার্নাল লেটার-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা জানান, তাঁরা কণাত্বরক যন্ত্রের সাহায্যে এই গ্লুবল আবিষ্কার করেন। গ্লুবল হলো গ্লুয়ন কণার মধ্যে ঘটা একধরনের মিথস্ক্রিয়া। গ্লুয়ন শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের বাহক। এই গবেষণার আগে গ্লুবলের তত্ত্ব সত্য কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, গ্লুয়নগুলো কোয়ার্কের সাহায্য ছাড়াই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে গ্লুবল তৈরি করে।

নতুন কণাটির নাম দেওয়া হয়েছে পার্টিকেল এক্স(২৩৭০)। তবে এই গবেষণার মাধ্যমে গ্লুবলের অস্তিত্ব নিখুঁতভাবে প্রমাণিত হয়নি। গবেষক দল আরও বিস্তারিত গবেষণা করছে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য।

৫. মাশরুম থেকে চামড়া তৈরি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী মাশরুম থেকে টেকসই চামড়া তৈরিতে সফল হয়েছেন। এটা টেকসই ফ্যাশনের জন্য যুগান্তকারী এক আবিষ্কার। এই নতুন চামড়া মাইসেলিয়াম নামে পরিচিত। দেখতে অনেকটা পশুর চামড়ার মতোই। ছোট জায়গায় অল্প পানি ও সৌরশক্তির সাহায্যে এই চামড়া তৈরি করা যায়। এটি পরিবেশবান্ধবও বটে। দুই ধরনের মাশরুম ব্যবহার করে এই চামড়া তৈরি করেছেন গবেষকরা—গ্যানোডার্মা লুসিডাম ও প্লেউরোটাস জ্যামর। মাশরুমগুলো দ্রুত বাড়ে এবং পরিবেশেও সহজে পাওয়া যায়। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে রিসার্চ ডিরেকশন: বায়োটেকনোলজি ডিজাইন জার্নালে।

৬. আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত অনুমানের প্রমাণ

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষণা করছেন। ১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এ তত্ত্ব থেকেই পাওয়া গিয়েছিল কৃষ্ণগহ্বরের ধারণা। এ তত্ত্ব অনুসারে, বিপুল ভর যখন একটি সীমিত স্থানে সঙ্কুচিত হয়, তখন কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়। এর মহাকর্ষ এত তীব্র যে আলোও এর সীমানা পেরিয়ে বেরোতে পারে না।

এই তত্ত্বের একটি দাবি, কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে, ইভেন্ট হরাইজন বা সীমানা দিগন্তের ঠিক বাইরে রয়েছে একটি ঢালু অঞ্চল। এই অঞ্চলটিকে ইংরেজিতে বিজ্ঞানীরা বলছেন ‘প্লাঞ্জিং রিজিওন’। সহজ কথায়, কোনো পদার্থ এ অঞ্চলে পৌঁছে গেলে তার ভবিতব্য নির্ধারিত হয়ে যায়। তখন একে গিলে নেয় কৃষ্ণগহ্বর। বাইরে বেরিয়ে আসার আর কোনো উপায় থাকে না। তবে অঞ্চলটি সত্যিই আছে কি না, গত একশ বছরেরও বেশি সময়ে সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না বিজ্ঞানীরা। এ নিয়ে ছিল নানা বিতর্ক। অবশেষে এ বিতর্কের অবসান হলো।

টেলিস্কোপ ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে প্রায় ১০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি কৃষ্ণগহ্বর পর্যবেক্ষণ করেছেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এই কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে সেই ঢালু অঞ্চল বা প্লাঞ্জিং রিজিওনের সন্ধান পেয়েছেন।

৭. মানুষের মুখভঙ্গি অনুকরণে রোবট ‘ইমো’

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীদের তৈরি ‘ইমো’ রোবটটি মানুষের মুখের ভাব হুবহু অনুকরণ করতে পারে। মানুষ ও রোবটের মধ্যে মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২৬টি অ্যাকচুয়েটর ব্যবহার করে ইমো মানুষের মতো বিভিন্ন মুখের ভাব প্রকাশ করে। রোবটের মুখটি সিলিকনের তৈরি একটি মাস্ক দিয়ে আবৃত। এতে চেহারা আরও বাস্তবসম্মত মনে হয়। ইমোর চোখে রয়েছে উচ্চ রেজ্যুলুশনযুক্ত ক্যামেরা।

গবেষণায় দেখা গেছে, ইমো মানুষের অভিব্যক্তি অনুমান করেও অনুকরণ করতে পারে। একজন মানুষ হাসার প্রায় ৮৪০ মিলিসেকেন্ড আগেই বলে দিতে পারে রোবটটি। একে আরও উন্নত ও স্বাভাবিক কথোপকথনে উপযুক্ত করে তোলাই প্রকৌশলীদের বর্তমান লক্ষ্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স এলার্ট, স্পেস ডটকম, নাসা, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, পোলার জার্নাল, ফিজিক্স ডট অর্গ, নিউ সায়েন্টিস্ট, টেকনোলজি নেটওয়ার্ক, বিজ্ঞানচিন্তা