মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ে নতুন গবেষণা, নেতৃত্বে বাংলাদেশি গবেষক

ছবি: শাটারস্টোক

সম্প্রতি দুটি পদ্ধতি একসঙ্গে ব্যবহার করে হাবল ধ্রুবকের নতুন মান নির্ণয় করেছেন একদল বিজ্ঞানী। বাংলাদেশি-মার্কিন জ্যোতির্বিদ অধ্যাপক সৈয়দ আশরাফ উদ্দিনের নেতৃত্বে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণাটি জ্যোতিঃপদার্থ বিষয়ে বিশ্বের নামকরা জার্নাল দ্য অ্যাস্টোফিজিক্যাল জার্নাল-এ চলতি বছরের জুলাইতে প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণায় অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন ক্রিস বার্নস, মার্ক ফিলিপ্স, নিকোলাস সান্টজেফ এবং ওয়েন্ডি ফ্রিডম্যান। গবেষণাপত্রটির সহলেখকদের মধ্যে অন্যতম ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিদ সল পার্লমাটার। এ ছাড়া আরেক নোবেলজয়ী অ্যাডাম রিসের আমন্ত্রণে গবেষণাপত্রের কিছু হিসেব পুনর্বিবেচনা করেন সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন।

দীর্ঘদিন ধরেই সঠিকভাবে হাবল ধ্রুবকের মান নির্ণয়ের চেষ্টা করছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। বেশ কিছু পদ্ধতিতে এ মান নির্ণয় করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই আগের মানের সঙ্গে পার্থক্য পাওয়া গেছে। নতুন এ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দুটি পদ্ধতিতে মান নির্ণয় করে সেগুলো তুলনা করে দেখেছেন। এতে হাবল ধ্রুবকের মানে অমিল পাওয়া গেছে। স্বাভাবিকভাবে হাবল ধ্রুবকের মান নির্ণয়ের পদ্ধতিগুলো ঠিক আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে গবেষণাটিতে।

সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন

আমাদের চিরচেনা এই মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে গ্যালাক্সিগুলো। প্রায় ১০০ বছর আগে এ ঘটনা প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল। গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে কত দ্রুত সরে যাচ্ছে, তাও হিসাব করে দেখান তিনি। এটাই হাবল ধ্রুবক। অর্থাৎ হাবল ধ্রুবক হলো মহাবিশ্বের প্রসারণের হার। তিনি সে সময় এর মান নির্ধারণ করেন প্রায় ৫০০ কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপারসেক (km/s/Mpc)। ১ মেগাপারসেক মানে, আলো ৩২.৬ লাখ বছরে যতদূর পথ পাড়ি দিতে পারে। অর্থাৎ ৩২.৬ লাখ আলোক বছর। অত দূরের কোনো গ্যালাক্সি, হাবলের হিসাবে, প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার করে দূরে সরে যাচ্ছে। আর যে গ্যালাক্সি যত দূরে, সে তত দ্রুত যায় সরে।

পরবর্তীতে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যাবহার করে এ  ধ্রুবকের মান নির্ণয় করেন আরও অনেক জ্যোতির্বিদ। মান পাওয়া যায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপারসেকের মধ্যে। বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে এর ভিন্ন ভিন্ন মান পাওয়া যায়। বর্তমান কসমোলজি ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর একটি এটি।

আরও পড়ুন
মহাবিশ্বে দূরত্ব মাপা হয় ধাপে ধাপে। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত একটা পদ্ধতি কাজ করে। এর পরে অন্য আরেকটা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়।

সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য হাবল ধ্রুবকের মান নির্ণয়ে বিজ্ঞানীদের চেষ্টা কিন্তু থেমে নেই। বর্তমানে সরাসরি হাবল ধ্রুবকের মান নির্ধারণ করা হয় টাইপ ওয়ান-এ সুপারনোভার মাধ্যমে। সুপারনোভাদের পৃথিবী থেকে দূরত্ব এবং তাদের ছুটে চলার বেগ নির্ধারণ করে এই দুইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক থেকে হাবল ধ্রুবকের মান বের করা যায়। এ ক্ষেত্রে  গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো সুপারনোভাদের দূরত্ব ক্যালিব্রেট করা। এটা প্রধানত দুই পদ্ধতিতে বা দুই ধরনের দূরত্ব পরিমাপক ব্যবহার করে করা হয়। এর একটি হলো সেফিড ভেরিয়েবল বা শেফালি বিষম তারা, অন্যটি টিআরজিবি তারা। বলে রাখি, মহাবিশ্বে দূরত্ব মাপার কাজটি নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির লোহিত সরণ পরিমাপ করে সহজেই বের করা যায়।

মহাবিশ্বে দূরত্ব মাপা হয় ধাপে ধাপে। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত একটা পদ্ধতি কাজ করে। এর পরে অন্য আরেকটা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। নতুন পদ্ধতিকে আগের ধাপের পদ্ধতি দিয়ে ক্যালিব্রেট করতে হয়—অর্থাৎ দুটোর মধ্যে একধরনের সমন্বয় করে নিতে হয়। এটাই দূরত্ব পরিমাপের ধাপ। এই দূরত্ব মাপার মধ্য দিয়েই মহাবিশ্বের স্বরূপ জানা যায়। কোনো গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ভর করে আমরা কোন মহাবিশ্বে আছি, তার গঠন কেমন—এসবের ওপর। আমরা যত বেশি দূরত্ব মাপতে পারব, তত অতীতের মহাবিশ্বের স্বরূপ জানা যাবে। অন্যভাবে বললে, মহাবিশ্বের প্রসারণের ইতিহাস যত জানতে পারব, তত সঠিকভাবে মহাবিশ্বের প্রকৃত কাঠামো বুঝতে পারব আমরা।

দূরত্ব মাপার জন্য গত শতাব্দীর প্রথম থেকেই শেফালি বিষম তারা ব্যবহার করা হচ্ছে। এই তারাগুলোর আপাতঃ উজ্জ্বলতা পর্যায়ক্রমে কমে-বাড়ে। এই কমা-বাড়ার সঙ্গে এদের সর্বোচ্চ প্রকৃত উজ্জ্বলতার একটা সম্পর্ক আছে। দূরত্ব মাপার কাজে আরও একধরনের তারা ব্যবহৃত হয়। গত শতাব্দীর শেষদিক থেকে ব্যবহৃত এই তারাগুলোর নাম টিআরজিবি (টিপ অব দ্য রেড জায়ান্ট ব্রাঞ্চ)। এগুলো একধরনের লালদানব তারা। এদের নির্দিষ্ট প্রকৃত উজ্জ্বলতা আছে। আপাতঃ আর প্রকৃত উজ্জ্বলতা থেকে গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করে এসব তারার দূরত্ব বের করা যায়। এই দুই ধরনের তারা দিয়ে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কাছাকাছি অঞ্চলের গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মাপা যায় সহজেই। কিন্তু দূরের গ্যালাক্সিগুলোতে শেফালী বিষম বা টিআরজিবি তারা সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন

সৌভাগ্যক্রমে বহুদূর গ্যালাক্সিগুলোতে ‘টাইপ ওয়ান-এ সুপারনোভা’ নামে একধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিশেষ ধরনের সাদা বামন তারার মৃত্যুপ্রক্রিয়ায় এই বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় প্রচুর উজ্জ্বলতা ছড়ায় মৃত্যুপথযাত্রী এসব তারা। এই উজ্জ্বলতা এদের গ্যালাক্সির চেয়েও বহু গুণ বেশি হয়, ফলে মহাবিশ্বের অনেক অনেক দূর অঞ্চল থেকেও এদের শনাক্ত করা যায়। এই বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতা সুষম, অর্থাৎ সব টাইপ ওয়ান-এ সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় একই পরিমাণ উজ্জ্বলতা দেখা যায়। মহাকাশের অনেক দূরের অঞ্চলের দূরত্ব মাপতে এসব সুপারনোভা ব্যবহার করা যায়। শর্ত হলো, নিকটস্থ দূরত্ব পরিমাপকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে নেওয়া বা ওগুলো দিয়ে ক্যালিব্রেট করা। এ জন্য শেফালী বিষম আর টিআরজিবি তারা বেশ কার্যকর।

ভিন্ন ভিন্নভাবে ভাবে হাবল ধ্রুবকের যে মান আমরা পাচ্ছি, তা পরস্পরের সঙ্গে মেলে না। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়।

সাধারণত এই দুই ভিন্ন দূরত্ব পরিমাপক আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহার করা হয় সুপারনোভার দূরত্ব ক্যালিব্রেট করার জন্য। এরপর এই সুপারনোভা ব্যবহার করে হাবল ধ্রুবকের মান নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে দুটি প্রধান দল আছে, একটি অ্যাডাম রিসের; তাঁরা সাধারণত শেফালী বিষম তারা ব্যবহার করেন। আরেকটি দল আছে, এ দলের নেতৃত্বে আছেন বিজ্ঞানী ওয়েন্ডি ফ্রিডম্যান। এই দলটি মূলত টিআরজিবি তারা ব্যাবহার করে। এই দুই পদ্ধতিতে হাবল ধ্রুবকের যে মান বের করা হয়েছে, তা ৬৯ থেক ৭৪ কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপারসেকের মধ্যে। এই মানগুলো পারস্পরিক অসঙ্গতিপূর্ণ। তবে দুটি দলেরই দাবী, তাদের ব্যবহৃত পদ্ধতি সঠিক।

গবেষণাপত্রের মূল ফলাফল। আনুভূমিক অক্ষে বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া হাবল ধ্রুবকের মান দেখানো হয়েছে

পরোক্ষভাবেও হাবল ধ্রুবকের মান বের করা যায়, মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ বা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের মাধ্যমে। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর প্রথম গঠিত হয় পরমাণু, ইলেকট্রন বাঁধা পড়ে নিউক্লিয়াসের চারপাশে। এর আগে এই ইলেকট্রনগুলোর জন্য ফোটন ছুটে বেড়াতে পারেনি, বাধা পেয়ে থমকে গেছে বারবার। এ সময় প্রথম ফোটন মুক্তভাবে ছুটতে শুরু করে, আলোয় ভরে ওঠে মহাবিশ্ব। ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর থেকে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া সেই আলোই মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ। মহাবিশ্বের একটা আদি নকশা বলা যায় এই বিকিরণকে। এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায় বর্তমান মহাবিশ্বের বড় পরিসরের কাঠামোতে (Large-scale structure)। শুরুতে এই বিকিরণ ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত। যত দিন যাচ্ছে, কমছে এর তাপমাত্রা। বর্তমানে এ বিকিরণের গড় তাপমাত্রা ২.৭ কেলভিন (আসল মানটি হলো ২.৭২৫৪৮  ± ০.০০০৫৭ কেলভিন)। এই তাপমাত্রায় অতিসূক্ষ্ম পার্থক্য পাওয়া যায়—এই পার্থক্য থেকে মাপা যায় হাবল ধ্রুবকের মান বা মহাবিশ্বের প্রসারণের হার। আর এই মান ৬৫ কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপারসেক।

এখন মূল সমস্যাটা হলো, ভিন্ন ভিন্নভাবে ভাবে হাবল ধ্রুবকের যে মান আমরা পাচ্ছি, তা পরস্পরের সঙ্গে মেলে না। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। কারণ, আমাদের মহাবিশ্ব তো একটিই, সেটা প্রসারিত হচ্ছে। কাজেই প্রসারণের হার বা হাবল ধ্রুবকের  মান তো একই হওয়া উচিৎ! দ্বন্দটা এখানেই লাগে। এ দ্বন্দ নিরসরণের চেষ্টা করা হয়েছে নতুন গবেষণাটিতে। সেখানে অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন ও তাঁর দল সুপারনোভার দূরত্ব ক্যালিব্রেশনের দুটি পদ্ধতি (শেফালী বিষম এবং টিআরজিবি) একীভূত করে—অর্থাৎ একই সঙ্গে দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে হাবল ধ্রুবকের মান নির্ণয় করেন। উদ্দেশ্য ছিল, দুটি পদ্ধতির মধ্যকার অসঙ্গতি বের করা—অর্থাৎ বোঝার চেষ্টা করা, কেন দুই পদ্ধতিতে দুই ধরনের মান পাওয়া যাচ্ছে। এর জন্য বিজ্ঞানীদের এই দলটি কার্নেগী সুপারনোভা প্রকল্প থেকে সংগৃহীত উপাত্ত ব্যবহার করেন। ২০০৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দুই ধাপে এই প্রকল্পে ৩০০ এর বেশি টাইপ ওয়ান-এ সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করা হয় নয়টি ভিন্ন ভিন্ন ফিল্টারে। দৃশ্যমান ও অবলোহিত—এই দুই ধরনের আলোয় সুপারনোভাগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। সব তথ্য বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন ও তাঁর দল দৃশ্যমান আলোয় হাবল ধ্রুবকের মান নির্ণয় করেন ৭১.৭৬ কিমি/সেকেন্ড/মেগাপারসেক। অবলাল আলোয় তাঁরা পান, ৭৩.২২ কিমি/সেকেন্ড/মেগাপারসেক। তাঁদের এ গবেষণায় গাণিতিক ত্রুটির পরিমাণ প্রায় ১ শতাংশ।

আরও পড়ুন

এ গবেষণার মাধ্যমে হাবল ধ্রুবকের মানে কেন ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গবেষক দলটি। তাঁরা অবশ্য এটাও বলছেন যে কোনো একটি পদ্ধতি (শেফালী বিষম বা টিআরজিবি) অন্যটির চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। গণনা পদ্ধতি বা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে ভুল থাকতে পারে, আবার খোদ পদ্ধতিটাও ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। তেমনটা হলে মহাবিশ্বের নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য উম্মোচিত হতে পারে আমাদের সামনে। এতে মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের বর্তমান মডেলটিও প্রশ্নের মুখে পড়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।

সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানচিন্তাকে জানান, ‘আমাদের বের করা এই মানগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই আরও গবেষণা হবে। কেউ এসব মান গ্রহণ করবেন, কেউ হয়তো করবেন না। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে অসঙ্গতিগুলো বের করা, এই মান আরও নিখুঁত করা। হয়তো এ ক্ষেত্রে গুপ্ত কোনো সমস্যা থাকতে পারে এ পদ্ধতিগুলোতে, যেগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিংবা হয়তো আমাদের মডেলটা নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে।’

ভবিষ্যতে সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন ও তাঁর দল নতুন নতুন উপাত্ত ব্যবহার করে আরও গভীরভাবে এ নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন।

এ গবেষণার গুরুত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মোরেনো ভ্যালি কলেজের অধ্যাপক ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ দীপেন ভট্টাচার্যের ভাষ্যে। তিনি বলেন, ‘হাবল ধ্রুবক আমাদের মহাবিশ্বের প্রসারণের যে হার, তার নির্ণায়ক। একটি গ্য্যলাক্সি দূরের আরেকটি গ্যালাক্সি থেকে কী বেগে সরে যাচ্ছে, হাবল ধ্রুবকের মাধ্যমে তা পাওয়া যায়। ড. সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন বিশ্বের অগ্রগণ্য জ্যোতির্বিদদের সঙ্গে শুধু যে কাজ করছেন, তা নয়; তিনি একটি যুগান্তকারী গবেষণার পুরোধা হিসেবে হাবল ধ্রুবক নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পেপার প্রকাশ করেছেন। কার্নেগি সুপারনোভা প্রকল্পের অধীনে সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন ও তাঁর সহকর্মীরা তিনটি পৃথক পদ্ধতি—শেফালি বিষম তারা, লাল দানব তারা এবং কয়েকটি গ্যালাক্সির উপরিভাগের উজ্জ্বলতার হেরফের—ব্যবহার করে টাইপ ওয়ান-এ সুপারনোভাগুলোর দূরত্ব মেপেছেন এবং সেগুলো ব্যবহার করে হাবল ধ্রুবক বের করেছেন। আমাদের কাছাকাছি গ্যালাক্সিগুলোর ওপর নির্ভরশীল বলে এই পদ্ধতিকে ‘স্থানীয়’ বলা হয়। এই গবেষণায় একাধিক পদ্ধতির সমন্বয়ের মাধ্যমে অনিশ্চয়তা হ্রাস করা হয়েছে এবং স্থানীয় পরিমাপের ওপর আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। দৃশ্যমান নীল আলোয় তাঁদের পাওয়া এ ধ্রুবকের মান হলো ৭১.৭৬±০.৫৮ এবং অতিলাল এইচ (H) ব্যান্ডে এর মান ৭৩.২২±০.৬৮। এই ফলাফল অতীতে সুপারনোভা থেকে পাওয়া হাবল ধ্রুবকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। অন্যদিকে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) থেকে প্রাপ্ত ৬৭.৪±০.৫ মানের হাবল ধ্রুবকের সঙ্গে এটির বৈষম্য রয়েছে, যে বৈষম্যকে আমরা হাবল টেনশন বলি। আমার মতে, ড. আশরাফ উদ্দিনের গবেষণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানটি হলো—তাঁরা হাবল ধ্রুবকের যে মানটি পেয়েছেন, তা থেকে থেকে প্রমাণ হয় যে হাবল টেনশনের কোনো সহজ সমাধান নেই এবং দুটি পদ্ধতিতে প্রাপ্ত পরিমাপের পার্থক্য ব্যাখ্যার জন্য নতুন পদার্থবিজ্ঞান অথবা ডাটা বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত তারতম্য বোঝা দরকার। যেটাই হোক না কেন, এই গবেষণাটি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম বড় রহস্য—মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার—বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।’

ভবিষ্যতে সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন ও তাঁর দল নতুন নতুন উপাত্ত ব্যবহার করে আরও গভীরভাবে এ নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন। এ ক্ষেত্রে উপাত্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি টাইপ ওয়ান-এ সুপারনোভা ও বিভিন্ন ক্যালিব্রেটরের বৈশিষ্ট্য আরও নিখুঁতভাবে জানা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি তিনি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি, স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসের সহযোগী সদস্য।

গবেষণাপত্রের লিঙ্ক:https://iopscience.iop.org/article/10.3847/1538-4357/ad3e63