অ্যান্টার্কটিকার অজানা ৭

অ্যান্টার্কটিকা—পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা, শুষ্ক এবং দুর্গম মহাদেশ। এই মহাদেশের সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা মানুষকে সবসময় আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু এই মহাদেশ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? শুভ্র বরফছাওয়া অ্যান্টার্কটিকাকে আরও ভালোভাবে জানতে আগ্রহীদের জন্যই এ লেখা।

১. পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি

গত ত্রিশ বছরে দক্ষিণ মেরুতে গড়ে বছরে মাত্র দশ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা অত্যন্ত নগণ্য

আমরা জানি, ধূলোর মরু হয়।বরফেরও কি মরুভূমি হয়? সাধারণত মরুভূমির কথা বললে মনে ভেসে ওঠে বালির উঁচু টিলা, প্রখর রোদ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মরুভূমিকে শুধু গরম বা বালুময় হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। মরুভূমি মানে বৃষ্টিপাতের অভাব। যেসব এলাকায় বছরে খুব কম বৃষ্টি হয়, সেগুলোকেই মরুভূমি বলা হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, আয়তনের দিক থেকে অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি। বরফমরু। গত ত্রিশ বছরে দক্ষিণ মেরুতে গড়ে বছরে মাত্র দশ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা অত্যন্ত নগণ্য। এ কারণেই অ্যান্টার্কটিকায় বরফের পুরু আস্তরণ তৈরি হতে লেগেছে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ৫০ লাখ বছর। পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক মহাদেশ হওয়ার পাশাপাশি অ্যান্টার্কটিকা সবচেয়ে শীতলও বটে।সারা বছর এখানে গড় তাপমাত্রা থাকে প্রায় মাইনাস ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে শীতকালে তাপমাত্রা কমে হতে পারে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে বাতাসে উড়ে চলা ধুলোর পরিমাণ সর্বোচ্চ।আবার ভূমির দিক থেকেও এটি সবচেয়ে উঁচু মহাদেশ।

২. বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বাদু পানির আধার

অ্যান্টার্কটিকার বরফ প্রায় ১৪ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৪০ লাখ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত

অ্যান্টার্কটিকা আমাদের গ্রহের সবচেয়ে বিশাল মিঠা পানির ভাণ্ডার। বিশ্বের মোট স্বাদু পানির ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ এই মহাদেশের বিপুল বরফে আবদ্ধ। এই বরফ প্রায় ১৪ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৪০ লাখ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বরফের আধারও এটি। অ্যান্টার্কটিকার পর্বতমালা, উপত্যকা ও মালভূমি এই বরফে ঢাকা। সব মিলে সারা বছর মহাদেশটির মাত্র এক শতাংশ অঞ্চলে শুধু বরফ থাকে না। গ্রীষ্মকালে অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের কিছু অংশের বরফ গলে যায়। এই বরফের সর্বোচ্চ পুরুত্ব প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্টের উচ্চতার প্রায় অর্ধেক। এই বিশাল বরফের স্তূপ যদি সম্পূর্ণ গলে যায়, তাহলে বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় ৬০ মিটার বেড়ে যেতে পারে। ফলে বিপন্ন হতে পারে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো।

৩. নির্দিষ্ট কোনো টাইমজোন নেই

অ্যান্টার্কটিকায় সময়ের ধারণা বেশ জটিল। দক্ষিণ মেরুতে পৃথিবীর সবকটি দ্রাঘিমা রেখা এক বিন্দুতে মিলিত হয়। ফলে ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোন বা সময়াঞ্চলের ধারণাটি এখানে খাটে না। অ্যান্টার্কটিকার বেশির ভাগ অঞ্চলে গ্রীষ্মের ৬ মাস অবিরাম দিনের আলো থাকে, আর শীতকালে ৬ মাসজুড়ে থাকে অন্ধকার। দিন-রাতের স্বাভাবিক চক্র না থাকায় সময়ের ধারণা এখানে অন্যরকম। অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণারত বিজ্ঞানীরা সাধারণত তাঁদের নিজ দেশের সময় মেনে চলেন। যেমন অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপে চিলি, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্র তাদের নিজ দেশের সময় অনুসরণ করেন বটে, তবে সে জন্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানে সমস্যা হয়। সাধারণত সাপ্লাই বা প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ ও তথ্য আদান-প্রদানের জন্য নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের সময়াঞ্চল ব্যবহৃত হয়। আবার অরোরা অভিযানে আসা পর্যটকরা সাধারণত উসুয়াইয়া সময় অনুসরণ করেন। তবে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ বা দক্ষিণ জর্জিয়া ভ্রমণের সময় তাঁরা সেখানকার স্থানীয় সময় অনুসরণ করেন।

৪. সব দিকই কি উত্তর?

দক্ষিণ মেরুতে দাঁড়ালে সব দিকই উত্তর বলে মনে হয়

দক্ষিণ মেরুতে দাঁড়ালে সব দিকই উত্তর হওয়ার কথা। অথচ অ্যান্টার্কটিকাকে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করা হয়। প্রশ্ন হলো, কেন? আসলে, দক্ষিণ মেরুতে দাঁড়ালে সব দিকই উত্তর বলে মনে হয়। কিন্তু অ্যান্টার্কটিকাকে পূর্ব ও পশ্চিমাংশে ভাগ করার পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। আমরা জানি, পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করার জন্য একটি কাল্পনিক রেখা আঁকা হয়, যাকে প্রধান মধ্যরেখা বা প্রাইম মেরিডিয়ান বলে। এই রেখা যুক্তরাজ্যের গ্রিনউইচ শহরের মধ্য দিয়ে যায়। দক্ষিণ মেরুতে দাঁড়িয়ে এই প্রধান মধ্যরেখার দিকে তাকালে বাঁ দিকের অংশকে পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা এবং ডান দিকের অংশকে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা বলা হয়। সহজ কথায়, প্রধান মধ্যরেখা এখানে রেফারেন্স পয়েন্ট বা জড়কাঠামো হিসেবে কাজ করে। এর সাহায্যে অ্যান্টার্কটিকার বিভিন্ন অংশকে সহজে চিহ্নিত করা হয়।

৫. অ্যান্টার্কটিকায় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে

মাউন্ট ইরেবাস অ্যান্টার্কটিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের সক্রিয় আগ্নেয়গিরি

এই শীতল মহাদেশে বেশ কটি আগ্নেয়গিরি আছে। এর দুটি এখনও সক্রিয়। মাউন্ট ইরেবাস অ্যান্টার্কটিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। রস দ্বীপের এই আগ্নেয়গিরি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। এর গর্তের কাছাকাছি ভেন্ট থেকে নির্গত গ্যাসের সংস্পর্শে বরফ গলে যায়। ফলে বিচিত্র গঠনের বরফ তৈরি হয়। এগুলোকে বলা হয় বরফের ফিউমারোল। ১৯০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী এজওয়ার্থ ডেভিড এবং ডগলাস মাওসনের নেতৃত্বে একটি দল পাঁচ দিন আরোহণ করে প্রথম এই আগ্নেয়গিরির শীর্ষে পৌঁছায়। অন্যদিকে, ডিসেপশন দ্বীপে অবস্থিত আগ্নেয়গিরিটিও সক্রিয়। দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের এই আগ্নেয়গিরি একসময় ছিল সমৃদ্ধ তিমিশিকার কেন্দ্র। পরে এটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ১৯৬৯ সালের এক অগ্ন্যুৎপাতের পর থেকে এই দ্বীপ পরিত্যক্ত। বর্তমানে এই আগ্নেয়গিরি এবং এর আশপাশের অঞ্চল অনেক অনেক পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

৬. দ্রুত বাড়ছে অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা

গত ৫০ বছরে এই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে

অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। পৃথিবীর যে অঞ্চলগুলোর তাপমাত্রা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে, সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। গত ৫০ বছরে এই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩৭.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়েছে, যা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকার বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যেমন পেঙ্গুইনরা এখন আগের জায়গা ছেড়ে ভিন্ন জায়গায়, বছরের ভিন্ন সময়ে বাসা বাঁধছে। আর তাপমাত্রা বাড়ার ফলে কমে যাচ্ছে সমুদ্রে বরফের পরিমাণ।

৭. অ্যান্টার্কটিকার নিজস্ব চুক্তিপত্র রয়েছে

১৯৫৯ সালে ১২টি দেশ মিলে অ্যান্টার্কটিক চুক্তি স্বাক্ষর করে

১৮২০ সালে মানুষ যখন প্রথম অ্যান্টার্কটিকা আবিষ্কার করে, তখন এই মহাদেশ কোনো দেশের মালিকানাধীন ছিল না। ফলে পরে গিয়ে বিভিন্ন দেশ এই মহাদেশের ওপর নিজেদের দাবি জানাতে শুরু করে। ফলে সূচিত হয় বড় সড় আন্তর্জাতিক বিবাদ। এই বিবাদ নিরসনে ১৯৫৯ সালে ১২টি দেশ মিলে অ্যান্টার্কটিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিকাকে শান্তি ও বিজ্ঞানের জন্য উৎসর্গ করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এখানে কোনো দেশের সার্বভৌম অধিকার থাকবে না। পরে আরও ৪১টি দেশ এই চুক্তিতে যোগ দেয়। অ্যান্টার্কটিক চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো এই মহাদেশ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং এখানে শুধু শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে গবেষণা করা। এই চুক্তির অধীনে বাণিজ্যিক মাছ ধরা, সীল শিকার এবং খনিজ সম্পদ খনন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

সূত্র: অরোরা এক্সপেডিশন্স ডটকম

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।

আরও পড়ুন