বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করতেন হকিং!

আমাদের কালের নায়ক স্টিফেন হকিং। কৃষ্ণগহ্বর গবেষণায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নওরীন আহসান। অবাক হয়ে তিনি জানলেন, বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করতেন হকিং! স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে দেখা, গল্প ও টুকরো স্মৃতিকথা...

স্টিফেন হকিংকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল বছর বিশেক আগে। ১৯৯৭-৯৮ সেশনে কেমব্রিজ কমনওয়েলথ ট্রাস্টের একটি বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে (DAMTP) পড়তে গিয়েছিলাম। হকিং ছিলেন সেই বিভাগের অধ্যাপক। ডিপার্টমেন্টের একতলায় ছিল বড় একটা লবির মতো জায়গা। তার এক পাশে ছিল কিচেন এবং অন্য তিন পাশজুড়ে ছিল বেশ অনেকগুলো ঘর। এগুলোরই একটাতে ছিল হকিংয়ের অফিস। মাঝে মাঝে যখন লবিটায় বসে থাকতাম, ক্লাসের ফাঁকে বা লাঞ্চের সময়, তখন হকিংকে কখনো দেখা যেত ঘর থেকে বের হয়ে আসতে, কারও সঙ্গে কথা বলতে কিংবা লাঞ্চ করতে।

স্টিফেন হকিং

ওই বিভাগটা এখন নতুন এলাকায় নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে আমি শুনেছি। পুরোনো ভবনের সেই লবির উষ্ণতা নিয়ে এখন আরেকটা লবি আছে কি না, জানি না। কিন্তু ওই লবির একটা বিশেষ ধরনের উষ্ণতা ছিল; আমাকে খুব টানত। ওখানে ঢোকামাত্রই নাকে কফির কড়া গন্ধ ভেসে আসত। সারাক্ষণই কেউ না কেউ কফি খাচ্ছে, কাজেই এই গন্ধটা একেবারে জাঁকিয়ে বসেছিল সেখানে। একদিন ক্লাসের পরে লবির দরজা দিয়ে ঢুকতে না-ঢুকতেই কফির গন্ধ ছাপিয়ে নাকে এল দেশি খাবারের গন্ধ। অর্থাৎ, বিরিয়ানি ধরনের খাবারের গন্ধ। অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি প্রফেসর হকিং তাঁর হুইলচেয়ারে বসে বিরিয়ানি খাচ্ছেন, মানে তাঁকে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে আরকি।

সব শেষে আমরা তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। তিনি সম্মতি দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। সেদিনের তোলা সেই ছবিটা আমার ছবির ভান্ডারের অনেক মূল্যবান ছবি।

আমি তো অবাক! ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। ‘কারি মহল’ নামের একটা রেস্তোরাঁ ছিল রাস্তার (Mill Lanegi) উল্টো দিকে। এক সিলেটি ভদ্রলোক (যত দূর মনে পড়ছে, আমরা তাঁকে ডাকতাম মাহমুদ ভাই বলে) এই রেস্তোরাঁর মালিক ছিলেন। ওখান থেকে খাবার আনিয়েছেন হকিং। এই গল্প অন্যদের সঙ্গে করতে গিয়ে শুনলাম, তিনি মাঝে মাঝে ওখানে গিয়েও খেয়ে আসেন। ভালো লাগল এই ভেবে, অতখানি শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়েও তিনি তাঁর ভালো লাগার কাজগুলো যথাসাধ্য করে গেছেন। হকিং নিয়মিত গবেষণা চালিয়ে গেছেন। পদার্থবিদ্যার জগৎকে নাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর গবেষণা দিয়ে। পিএইচডি ছাত্রদের সুপারভাইজ করতেন। শুনেছি মাঝে মাঝে সেমিনারে বক্তৃতাও দিতেন, অবশ্য আমার শোনার সৌভাগ্য হয়নি কখনো। কোনো কিছুতেই পিছপা থাকেননি হকিং।

আমার এক ভাই তখন থাকতেন লন্ডনে, বিবিসিতে কাজ করতেন, নাম আনিস আহমেদ। পরে তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় চাকরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন এবং এখনো আছেন। তাঁর ছেলে শোভন তখন হাইস্কুলে পড়ে। স্বপ্ন দেখে বড় বিজ্ঞানী হওয়ার। আমি DAMTP-এ পড়ি শুনে সে উত্তেজনায় অস্থির। খুব ইচ্ছে, প্রফেসর হকিংয়ের সঙ্গে দেখা করবে। আমি হকিংয়ের পিএসকে ই-মেইল করে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। জানতে চাইলাম, প্রফেসর কি শোভনের সঙ্গে একবার দেখা করবেন? উত্তর পেলাম, ইয়েস। অমুক দিন অমুক সময়ে।

যথাসময়ে শোভন কেমব্রিজে হাজির। স্যুটেড-বুটেড হয়ে শোভন আমার সঙ্গে চলে এল ডিপার্টমেন্টে। হকিং বেরিয়ে এলেন তাঁর ঘর থেকে। শোভনের চোখে-মুখে খুশি উপচে পড়ছে। অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা। হকিং ধৈর্য ধরে শুনলেন এবং উত্তর দিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে আমি শুনলাম আর দেখলাম। কী অদ্ভুতভাবে তিনি শুধু ডান হাতের দু-তিনটে আঙুলের সাহায্যে হাতে-ধরা ডিভাইসে চাপ দিয়ে শব্দের পর শব্দ, বর্ণের পর বর্ণ লিখে যাচ্ছেন। কখনো কখনো নিত্যব্যবহার্য বাক্যগুলো এক চাপেই বেরিয়ে আসছে। আমি সেই প্রথম এবং শেষ—হকিংকে এত কাছ থেকে দেখলাম ও কথা বলতে শুনলাম। বিস্ময়, কী বিস্ময়!

স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে লেখক

সব শেষে আমরা তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। তিনি সম্মতি দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। সেদিনের তোলা সেই ছবিটা আমার ছবির ভান্ডারের অনেক মূল্যবান ছবি। এর তিন-চার দিন পরই আমি কেমব্রিজ ছেড়ে দেশে চলে আসি। তাঁর সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি। তাঁর গবেষণার বিষয় আমি বুঝি না বললেই চলে। কিন্তু আমার কাছে তাঁর আবেদন একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যত, তার চেয়ে বেশি একজন যোদ্ধা হিসেবে। তিনি কী না অতিক্রম করেছেন? শুধু মাথা আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তিনি কি না অর্জন করেছেন? তাঁর মেধাকে ছোট করে দেখছি না মোটেই। কিন্তু এই যোদ্ধা-মন না থাকলে কোথায় থাকত এই মেধা, কোথায় চলে যেতেন এই মানুষটা আর পৃথিবীর মানুষই বা কোথায় পেত এই জ্ঞানের ভান্ডার, যা তিনি দান করে গেছেন? অধ্যাপক হকিংয়ের প্রতি এবং তাঁর যোদ্ধা-মনের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ অভিবাদন।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়