আমাদের শরীরের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে দুধ, ডিমের পাশাপাশি আরেক জনপ্রিয় খাবার হল মাংস। এমন অনেকেই হয়তো রয়েছে যারা ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষাশী জীবনযাপন করেন, কিন্তু তারপরও ভোটাভুটি হলে তাদেরকে হারিয়ে বিশ্বজুড়ে মাংসভোজীদেরই জয় হবে বিশাল ব্যবধানে।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে যে কেউই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, যেসব প্রাণীর মাংস আমরা জীবনধারণের জন্য খাই, তাদের প্রতি খুব একটা সদয় আচরণ করা হয় না। বিভিন্ন খামারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে পালিত হয় সেসব প্রাণী। তাদের জীবন কাটে অবর্ণনীয় কষ্ট, ভয়-ভীতি আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, এবং সেই জীবনের সমাপ্তিও ঘটে আকস্মিকভাবে, অকালে। যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সেদেশের মাত্র ১ শতাংশ খামারের প্রাণীই বদ্ধ পরিবেশের বাইরে জীবন কাটায়। অর্থাৎ, পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগের সুযোগ পায় না বাকি ৯৯ শতাংশ খামারের প্রাণী। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে খামারের প্রাণীদের অবস্থাও এর চেয়ে খুব একটা উন্নত নয়।
চমকপ্রদ বিষয় হলো, ঘোরতর প্রাণীপ্রেমী ব্যক্তিরাও কিন্তু মাংস খান। কুকুর, বিড়াল থেকে শুরু করে প্রকৃতির বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখির মঙ্গলে তারা সরব থাকলেও, মাংস ভক্ষণকে কখনোই না বলেন না। বরং যুক্তি দেখায় যে, মাংস খাই মানেই এই নয় যে আমি প্রাণীদের ভালোবাসি না।
এখানে এসেই জন্ম হয় এক প্যারাডক্সের। কেউ যদি আসলেই প্রাণীপ্রেমী হয়, প্রাণীদের দুঃখ-কষ্টে তার প্রাণ কাঁদে, তাহলে কীভাবে সে কিছু প্রাণীর মাংসই নির্দ্বিধায় গলধঃকরণ করে? কেউ যদি আসলেই প্রাণীদের সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়, তাহলে কীভাবে সে খামারের প্রাণীদের দুরবস্থার কথা জেনেও নিশ্চুপ থাকতে পারে?
এই যে চূড়ান্ত রকমের প্রাণীপ্রেমীরাও একটা পর্যায়ে এসে নীরব, এবং নিঃসঙ্কোচে খেয়ে চলে মাংসের নানা আইটেম, এই দ্বিমুখী প্রবণতা থেকেই উদ্ভব ঘটে মিট প্যারাডক্সের।
কী রয়েছে মিট প্যারাডক্সের নেপথ্যে?
এতক্ষণে হয়তো অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, এই লেখা এক ধরনের প্রোপাগান্ডা। এর উদ্দেশ্য সবাইকে মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা, কিংবা মাংসভোজীদেরকে কৌশলে অনুতপ্ত বোধ করা।
কিন্তু না। উপরোল্লিখিত ব্যাপারগুলো যদি আমরা বেমালুম ভুলেও যাই, তারপরও মিট প্যারাডক্স নিয়ে আলোচনা জরুরি। কেননা এর মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটে মানুষ হিসেবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে মুখোমুখি হওয়া এক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের। সেটি হলো কগনিটিভ ডিজোন্যান্স বা অবধারণগত অসঙ্গতি।
জার্মান-কানাডিয়ান মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানী ড. জুলিয়া শ বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি প্রাণীরা অনেক কিউট, এবং আমাদের উচিত তাদেরকে রক্ষা করা, তাদেরকে অত্যাচার না করা। আবার অন্যদিকে, আমরা তাদের মাংসে পরিণত করে খাই। সেটি করতে গিয়ে আমরা তাদেরকে ফ্যাক্টরি ফার্মে রাখি এবং নানাভাবে নির্যাতন করি। এভাবে আমাদের দুই ধরনের বিশ্বাসের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। এই পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারাকেই আমরা বলি অবধারণগত অসঙ্গতি। যখন আমরা একই সঙ্গে দুই ধরনের বিশ্বাসকে ধারণ করি, তাদের মাঝখানে অবস্থান করে একটি প্যারাডক্স।’
বিষয়টিকে যদি আরেকটু ভালোভাবে বুঝতে চাই, তাহলে এ সংক্রান্ত গবেষণার একদম গোড়ায় চলে যাওয়া ভালো। ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে প্রথম গবেষণাটি হয়েছিল। তারও অনেক বছর আগে ভারতে সংঘটিত এক অস্বাভাবিক আচরণের খবর জানতে পেরে সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ লিওন ফেস্টিঞ্জার মানবপ্রকৃতির একেবারে মৌলিক অথচ কম আলোচিত একটি বিষয়ের উপর উৎসাহী হন।
১৯৫৭ সালে আ থিওরি অব কগনিটিভ ডিজোন্যান্স-এ ফেস্টিঞ্জার লেখেন, ‘১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ভারতের বিহার প্রদেশে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে। কম্পনটি ছিল বেশ শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। তাই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এটি অনুভূত হয়। তবে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি ছিল কেবলই নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধ। বেশিরভাগ মানুষই ভূমিকম্পের ভীত হয়েছিল, কিন্তু কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা ধ্বংসযজ্ঞ দেখেনি।‘
নিজেদের চোখে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা না দেখার কারণে নিরাপদে থাকা মানুষগুলো বোধহয় নিশ্চিন্তে ছিলেন? আসলে তা নয়। মানুষ অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তার কারণ শুধু বিগত ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে নয়। ইতোমধ্যেই ভবিষ্যতে আসন্ন নানা ধরনের দুর্যোগ সম্পর্কে গুজব রটে। সাধারণ মানুষ সেসব গুজবে কান দিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে যায়।
ফেস্টিঞ্জার তাঁর আলোচনায় দেখান, এ ধরনের প্রতিক্রিয়া মানুষের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খায় না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পর নিরাপদে থাকা মানুষ অহেতুক নানা ধরনের ভীতিজাগানিয়া গুজব ছড়িয়ে দেবে এবং সেগুলো বিশ্বাসও করবে?
ফেস্টিঞ্জার এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। তিনি ধারণা করেন, মানুষজন আসলে অন্যদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল না। বরং তারা নিজেরাই আগে থেকেই ভীত হয়ে ছিল। গুজবগুলো ছড়ানোর মাধ্যমে তারা নিছকই নিজেদের সেই ভয়কে 'জাস্টিফাই' করার চেষ্টা করছিল। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের মনকেই বরং বোঝাচ্ছিল যে তাদের মনে জাগা নেতিবাচক অনুভূতিগুলো অনর্থক নয়; সত্যি সত্যিই তাদের ভয় পাবার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ রয়েছে।
অবধারণগত অসঙ্গতির উন্মেষ
১৯৫৯ সালে সহকর্মী জেমস মেরিল কার্লস্মিথকে সঙ্গে নিয়ে ফেস্টিঞ্জার একটি গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন। সেটি বর্তমানে অবধারণগত অসঙ্গতির ধ্রূপদী উপস্থাপন হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাওয়া তাঁদের সেই গবেষণা নিবন্ধ অনুযায়ী, এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণকারী ভলান্টিয়ারদের কিছু ক্লান্তিকর কাজ করতে বলা হয়, যেন তাদের মনে নেতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি হয়। অবশ্য আসল এক্সপেরিমেন্টটি ছিল এর পরে।
ভলান্টিয়াররা তাদেরকে দেওয়া কাজ শেষে চলে যাচ্ছিল। ঠিক তখন তাদেরকে নতুন আরেকটি নির্দেশনা দেওয়া হল: পরবর্তী অংশগ্রহণকারীদেরকে যেন তারা বলে যে তাদের সদ্যসমাপ্ত ক্লান্তিকর কাজগুলো আসলে ছিল 'খুবই উপভোগ্য', 'আনন্দদায়ক', এমনকি 'উত্তেজক'-ও। এমন ডাহা মিথ্যে বলার জন্য তাদের কারো হাতে দেওয়া হয় ১ ডলার, কারো হাতে ২০ ডলার, আবার কাউকে কিছুই নয়!
আপনারা যেমনটি আশা করছেন, কোনো ধরনের ঘুষ না পাওয়া অংশগ্রহণকারীরা আগের এক্সপেরিমেন্টকে খুবই বোরিং, অপ্রয়োজনীয়, নিরানন্দ হিসেবেই রায় দেয়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, যারা টাকা পেয়েছিল তারা কী করেছিল?
এখানে এসেই এক্সপেরিমেন্টটি দারুণ ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে। যাদেরকে ১ ডলার করে দেওয়া হয়েছিল, তারা বেশ গুছিয়েই মিথ্যেগুলো বলেছিল। জানিয়েছিল, তাদের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই আনন্দময়। এ ধরনের কাজ তারা ভবিষ্যতে আবারো করার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। অথচ অবাক করা ব্যাপার হলো, ২০ ডলার ঘুষ পাওয়া সত্ত্বেও ওই দলটির সদস্যরা অকপটে সত্যিটা বলে দেয়। তারা কতটা বিরক্ত হয়েছে, সে কথা গোপনের বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনি।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই মাথা ঝিমঝিম শুরু হয়েছে? হওয়ারই তো কথা! শ বলেন, ‘যাদেরকে ২০ ডলার দেওয়া হয়েছিল, চাইলেই তারা মিথ্যে কথা বলে সেটির পেছনে একটা জোরদার কারণ দেখাতে পারত। কিন্তু মাত্র ১ ডলার দেওয়া হলে মিথ্যে বলার জন্য সেটা যথেষ্ট হওয়ার কথা নয়!’
আসলে এখানে অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কে দুটি সাংঘর্ষিক কিন্তু একইসঙ্গে সত্য ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছিল: তারা শুরুর কাজগুলোকে উপভোগ করেনি, অথচ তাদেরকে বলতে হবে যে তারা উপভোগ করেছে। এখানে দ্বান্দ্বিক সংঘাত নিরসণের জন্য তাদেরকে যেকোনো একটি সত্যকে বদলে দিতে হতো। কিন্তু যেহেতু যে কাজটিকে আপনি অতীতে উপভোগ করেননি, সেটিকে টাইম ট্র্যাভেলের মাধ্যমে পেছনে ফিরে গিয়ে উপভোগের উপায় নেই, তাই আপনাকে আপনার মুখ নিঃসৃত মতামতেই পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেটি নির্ভর করবে বাহ্যিক প্রণোদনা বা প্রভাবের উপর।
একবার যখন আপনি অবধারণগত অসঙ্গতির ব্যাপারটি বুঝতে শুরু করবেন, তখন মানুষের আপাতদৃষ্টিতে 'নরমাল' অনেক আচরণকেই 'অ্যাবনরমাল' লাগতে শুরু করবে। গবেষক ব্রক বাস্তিয়ান ও স্টিভ লাফনানের মতে, ‘সমাজের কাঠামো গড়ে ওঠে অসঙ্গতি দূরীকরণের প্রচেষ্টার মাধ্যমে। সেখানে সমস্যাজনক আচরণগুলোকে প্রাত্যহিক স্বাভাবিকতার আড়ালে উধাও করে দেওয়া হয়।’
উদাহরণ হিসেবে মিট প্যারাডক্সের কথাই ধরুন। আপনি যদি প্রাণীপ্রেমী না হয়ে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু যদি সত্যিকারের একজন প্রাণীপ্রেমী হয়ে থাকেন, তাহলে একটি চিকেন উইংসে কামড় বসানোর সময় কেউ যদি আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে খামারে মুরগিটিকে কতটা কষ্ট পোহাতে হয়েছে, তাহলে আপনার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে বাধ্য। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
উত্তরটি খুব সহজ, যেকোনো সুপারমার্কেট বা ভালোমানের মাংসের দোকানে যান। সেখানে গেলে নিজে নিজেই সবকিছু বুঝে যাবেন।
‘ইন্ডাস্ট্রি যেভাবে মাংসকে উপস্থাপন করে, তা আমাদের এ খাবারটি খাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে প্রভাবিত তোলে। আমাদের মাংস খাওয়ার বাসনা প্রভাবিত হয় কী নামে আমরা ডিশটিকে ডাকছি এবং কীভাবে মাংসটি আমাদের সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে, সেই দুইয়ের মাধ্যমেই,’ জানান ২০১৬ সালে মিট প্যারাডক্স নিয়ে একটি গবেষণা নিবন্ধের সহ-রচয়িতা জোনাস কানস্ট। ‘উচ্চ প্রক্রিয়াজাত মাংসের ফলে একজন মানুষের পক্ষে সহজেই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয় যে এটি এসেছে কোনো প্রাণীর শরীর থেকে... মানুষ যত কম ভাবে যে মাংসের উৎস কোনো প্রাণী, ততই তারা কম সহানুভূতি ও বিতৃষ্ণা অনুভব করে। আর সেই সমান্তরালে কমে চলে তাদের নিরামিষ বিকল্প খাওয়ার ইচ্ছা।’
মূলত ‘আমি প্রাণীদের ভালোবাসি’ এবং ‘আমি মাংস ভালোবাসি’-র মধ্যকার অসঙ্গতি দূর করার ক্ষেত্রে আমাদের সামনে দুটি অপশন রয়েছে। হয় আমাদেরকে ভাবতে হবে, আসলে আমরা প্রাণীদের অত বেশিও ভালোবাসি না, অথবা আমাদেরকে পুরোপুরি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের অধিকাংশের জন্যই, এই দুই অপশনের কোনোটিই খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। তাই আমরা তৃতীয় অপশনের দিকে যাই: এমন একটা ভাব করি যেন প্রাণীদের ভালোবাসা ও মাংস ভালোবাসার মধ্যে কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক নেই।
মিট প্যারাডক্স নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধের প্রধান রচয়িতা সারাহ গ্রাডিজ বলেন, ‘মানুষজনকে মাংসের প্রাণিজ উৎস সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেওয়া তাদের জন্য খুবই অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। কেননা সাধারণত একজন মানুষ যখন মাংস খায়, তখন সে ওই প্রাণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে ভুলে যায়। সে ভুলে যায় যে মাংস প্রাণীদের শরীর থেকেই আসে।’
গ্রাডিজের মতে, মাংস খাওয়ার ব্যাপারে অবধারণগত অসঙ্গতি কাটিয়ে উঠতে মানুষ কয়েকটি কৌশলের আশ্রয় নেয়। যেমন: তারা কয়েকটি প্রাণীকে 'খাদ্য উৎপাদক প্রাণী' বলে নতুন এক শ্রেণিভুক্ত করতে পারে। ভাবতে পারে যে এই নতুন শ্রেণিভুক্ত প্রাণীদের ভাবার, চিন্তা করার, অনুভব করার ক্ষমতা হয়তো কম (যা আদতে সম্পূর্ণ অসত্য)। তারা ব্যবহার করতে পারে 'ফোর এন'-এর অজুহাতটিও—কিছু কিছু প্রাণীর মাংস খাওয়া 'নাইস, নরমাল, নেসেসারি বা ন্যাচারাল!’
‘যখনই আপনি মানুষকে মনে করিয়ে দেবেন যে, মাংস আসে প্রাণীদের থেকে, তাদের মনে এক ধরনের অস্বস্তি জেগে উঠতে পারে। কারণ তথ্যটি মনে করিয়ে দেওয়ার কারণে এতক্ষণ ধরে তারা যে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছিল, সে সক্ষমতাটি হারিয়ে ফেলে।’ গ্রাডিজের পর্যবেক্ষণ।
তবে যেমনটি আগেই বলেছে, মিট প্যারাডক্স কেবলই মাংসকেন্দ্রিক নয়। একজন গড়পড়তা সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের দ্বিমুখী চিন্তার মাধ্যমে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ কাজকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। যেমন ধরুন, অনেকেই পরিবেশ রক্ষা কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত হয়, বড় বড় কথা বলে; অথচ ব্যক্তি জীবনে ঠিকই এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করে, গাড়িতে চড়ে। কারণ পরিবেশ ও জলবায়ুর ব্যাপারে যত আন্তরিকই তারা হোন, তবু নিজেদেরকে কষ্ট দেওয়ার পক্ষপাতি তারা নন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে পা ব্যথা করতেও নারাজ।
আবার অনেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, শ্রমিককে কম মজুরি দেওয়া কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে দেওয়া ঠিক নয়। অথচ দিনশেষে নিজেরা ঠিকই কিছু পয়সা বাঁচানোর লোভে ছুটে যায় সস্তার দোকানে। একবারের জন্যও তাদের মনে হয় না, তারা এসব সস্তা পণ্য কেনে বলেই শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়া বা ঝুকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করানোর প্রথা চালু রয়েছে।
আমরা কি অবধারণগত অসঙ্গতি কাটিয়ে উঠতে পারব?
মনস্তত্ত্ববিদ স্টিফ লাফনান বলেন, ‘মানুষজন তাদের আচরণ বদলাতে পারে... (কিন্তু) অধিকাংশই নিজেদেরকে মাংস খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চায় না। প্রাণীদের নৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করার মাধ্যমে তারা নিষ্কলুষ বিবেক নিয়েই মাংস খাওয়া চালিয়ে যেতে পারে।’
তবে অবধারণগত অসঙ্গতি এবং আমাদের এটিকে কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা কোনো খারাপ বিষয় নয়। প্রিন্সটনে যেমন গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন অবধারণগত অসঙ্গতিকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মানার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করার উপায়। এর মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার কমিয়ে আনা। এদিকে হিউস্টনে এই ব্যাপারটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে কলেজগামী শিক্ষার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত পান থেকে বিরত রাখতে। নিউইয়র্কের গবেষকরা বিশ্বাস করেন, অনলাইন আসক্তদের ইন্টারনেট ব্যবহার কমাতেও এটি হতে পারে সহায়ক।
হিউস্টনের গবেষণাটির পেছনে থাকা অধ্যাপক ক্লেটন নেইবার্স বলেন, ‘মূল্যবোধ ও আচরণে অসংলগ্নতা থাকা খুবই অস্বস্তিকর একটি বিষয়। আপনি যদি মানুষের মনে অবধারণগত অসঙ্গতির উপলব্ধি জাগিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও এটি তাদেরকে বদলে যেতে অনুপ্রাণিত করবে।’
আর যদি আপনি বদলাতে না চান, তাহলে অন্তত নিজের সঙ্গে সৎ হন, এমনটিই পরামর্শ শয়ের।
‘মাংস একটি ভালো উদাহরণ, যেখানে অনেক ধরনের অজুহাত রয়েছে,’ তিনি বলেন। ‘আমরা ক্রমাগত নিজেদের মনকে বুঝ দিচ্ছি যে কাজটি ঠিক আছে... কারণ অন্য সবাইও তো কাজ একই কাজ করছে। কারণ এটিকে কেন্দ্র করে তো একটি স্বতন্ত্র ইন্ডাস্ট্রিই রয়েছে, এবং এটি আমাদের সমস্যা নয়।’
তিনি আরো যোগ করেন, ‘আমাদের নিদেনপক্ষে এটুকু স্বীকার করা উচিত যে আমরা ভণ্ডামি করছি। যখন কেউ আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বলবে যে আমাদের আচরণে সমস্যা রয়েছে, তখন রাগা যাবে না। বরং চলুন ব্যাপারটি নিয়ে ভেবে দেখি। যদি বুঝি যে আমাদের আচরণ আসলেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবে আদর্শ কাজ হবে আচরণে পরিবর্তন আনা... যেমন ধরুন, আমরা অত্যধিক পরিমাণ প্রাণীজ খাবার খাওয়ায় লাগাম টেনে ধরতে পারি। পাগলের মতো পৃথিবীটাকে দূষিত করা থেকে বিরত থাকতে পারি। আবার কেবল প্রাইস ট্যাগের জন্য সস্তা কাপড় কেনাও বন্ধ করতে পারি।’
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: আইএফএল সায়েন্স