সাক্ষাৎকার

বিজ্ঞান একটা চলমান প্রক্রিয়া—আসিফ, বিজ্ঞানবক্তা

আসিফ একাধারে বিজ্ঞানলেখক, সম্পাদক ও শিক্ষক। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়—বিজ্ঞানবক্তা। বিজ্ঞান নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘকাল বক্তব্য দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। মানুষ টিকিট কেটে তাঁর মুখে বিজ্ঞানের কথা শুনেছে। এককালে সম্পাদক হিসেবে প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স ওয়ার্ল্ড। বর্তমানে বিজ্ঞান পত্রিকা মহাবৃত্ত-এর সম্পাদক। পাশাপাশি লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু বিজ্ঞানবিষয়ক বই। এর মধ্যে ইউক্লিড ও এলিমেন্টস, মহাজাগতিক আলোয় ফিরে দেখা, কার্ল সাগান: এক মহাজাগতিক পথিক, মানবপ্রজাতির অনিশ্চিত গন্তব্য, ওরা কেন আসেনি উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এতে উঠে এসেছে তাঁর বিজ্ঞানবক্তৃতা শুরুর পেছনের কথা, অভিজ্ঞতা, নিজস্ব দর্শন, বিজ্ঞানবিষয়ক ভাবনাসহ আরও অনেক কিছু। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ। ছবি তুলেছেন সাজিদ হোসেন

বিজ্ঞানচিন্তা:

একসময় আপনি নিয়মিত বিজ্ঞানবক্তৃতা করতেন। সেটা খুব জনপ্রিয় ছিল। মানুষ টিকিট কেটে বিজ্ঞানের কথা শুনতে যেত। সে সময়ের কথা বলুন। কেমন ছিল দিনগুলো? সেই দিনগুলো কি এখন মিস করেন?

আসিফ: হ্যাঁ, অবশ্যই। অনেক মিস করি। কারণ, এটা আমার চিন্তারও বাইরে যে একটা বক্তৃতা দেব, কোনো আমন্ত্রিত অতিথি নেই, প্রধান অতিথি নেই, কিছু নেই। শুধু অডিটরিয়ামটা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ছবি ও চার্ট দিয়ে সাজানোর পরপরই এক-দেড় শ টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়া, আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারি না। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, আর আমার মাথায় কীভাবে ঢুকেছিল—দুটিই খুব অবিশ্বাস্য। এখনো আমি অবাক হই।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানবক্তৃতা শুরুর গল্পটা বলুন। কেন শুরু করলেন? এর পেছনে কি কোনো গল্প আছে?

বিজ্ঞানচিন্তার কার্যালয়ে বিজ্ঞানবক্তা আসিফ

আসিফ: গল্প তো আছেই। অনেক বড় গল্প। মানুষের জীবনে একটা পেশা লাগে। বেঁচে থাকার জন্য টাকাপয়সাও দরকার। আমারও প্রয়োজন ছিল। অনেক মানুষ আসতেন আমার কাছে। নারায়ণগঞ্জে আমার খানিকটা পরিচিতি ছিল। আর আমার বড় ভাই কবি আরিফ বুলবুলকেও অনেকে গুরুত্ব দিতেন, এটাও একটা ব্যাপার। তাই অনেকে আসতেন—ছাত্র, বন্ধু, শিক্ষক, সাংবাদিক—সবাই। হঠাৎ কয়েকজন বুদ্ধি দিল, এই যে সময়টা আপনি ব্যয় করছেন, এর বিনিময়ে কিছু পারিশ্রমিক বা টাকাপয়সা নিন।

আমার সোফিস্টদের কথা জানা ছিল। তাঁরা গ্রিক দার্শনিক—দর্শন শেখানো বা শিক্ষাদানের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতেন। এ রকম একজন ছিলেন প্রোটাগোরাস। তিনি বলতেন, ‘মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যদি বিপরীতধর্মী স্বভাব থাকে, তাহলে বিশ্বপ্রকৃতিতে মানুষের অবস্থান কোথায়?’ কথাটা আমাকে সব সময় ভাবায়। বর্তমানে আমরা যেভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি, তাতে এ কথার পেছনের বাস্তবতা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া সভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ আরও একজন একই কাজ করেছেন চতুর্থ শতাব্দীতে। তিনি ছিলেন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক (লাইব্রেরিয়ান)। হাইপেশিয়া। অনেকে বলেন, ইউক্লিডের পর সবচেয়ে প্রতিভাবান গণিতবিদ তিনি। তিনিও এ কাজ করেছেন। তবে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস টাকাপয়সা নিতেন না। তিনি পাল্টাপাল্টি প্রশ্নের মাধ্যমে সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন আয়োনীয় বিজ্ঞানী অ্যানাক্সাগোরাসের ছাত্র। খুব স্বল্প সময়ের জন্য, তবে এটাও একটা বড় ব্যাপার। সক্রেটিসের ব্যাপারটা আমাকে খুব উজ্জীবিত করে।

যাহোক, আমিও একটা পদ্ধতির কথা ভাবলাম। এমন একটা খোলা জায়গা হবে, যেখানে প্রশ্ন, পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আলোচনা হবে। সে আলোচনা মানুষ শুধু শুনবে না, টিকিট কেটে শুনবে।

হাইপেশিয়া বা বার্নহার্ড রিম্যানের মতো গণিতবিদেরাই আমার অনুপ্রেরণা। তাঁদের আমি নিজের আত্মা বলি। তাঁরাই আমাকে এ পথে হাঁটার শক্তি জুগিয়েছেন।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি যে বিজ্ঞানবক্তৃতা শুরু করলেন, এটা কত সালের ঘটনা?

আসিফ: ১৯৯২ সালের ১৯ মে আমি কাজটা শুরু করি। টাকাপয়সা নেওয়ার বিষয়টা আমাদের কাছে তো খুব স্বস্তিদায়ক নয়। প্রথমবার তাই এটা করে টাকা নিতে পারিনি। খুব খারাপ লেগেছিল। জ্ঞানের জন্য টাকা নেব? যত যুক্তিই দেখাই না কেন, পারিনি। পরেরবার নিয়েছিলাম। প্রথম বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ইউক্লিডীয় জ্যামিতির যৌক্তিক অসংগতি’। দ্বিতীয়টা ছিল, ‘সমান্তরাল সরলরেখা: এক বেদনাদায়ক উপাখ্যান’। এভাবে শুরু হয়েছিল ডিসকাশন প্রজেক্টের যাত্রা।

ধীরে ধীরে মানুষ আসতে শুরু করল। তখনো সংখ্যাটা নিতান্ত কম। কিন্তু ১০টি বক্তৃতা করে ফেলার পর কয়েকজন অংশগ্রহণকারী পেলাম, যাঁরা আমাকে অবিরাম সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে খালেদা ইয়াসমিন, শামসুদ্দিন আহমেদ, শরীফউদ্দিন সবুজ, ফরহাদ আহমেদ, সুমনা বিশ্বাস, রজনীশ রতন সিংসহ অনেকে রয়েছেন। আমি অডিটরিয়ামে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে কসমিক ক্যালেন্ডারের ওপর বক্তৃতা দিলাম। এটাই ছিল প্রথম ওপেন ডিসকাশন। পেছনে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির হাতে আঁকা ছবি, একটি লেখার বোর্ড, আর আমি। স্রেফ আমার মুখের কথা শোনার জন্য ৪০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ৩৫ থেকে ৪০ জন মানুষ এল।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানবক্তৃতার আগে কী করতেন?

আসিফ: কিছুই করতাম না। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াতাম। প্রতিদিন সকাল ১০টা-১১টায় উঠতাম। চা খেয়ে দুপুর ১২টার দিকে যেতাম নদীর পাড়ে। সেখানে দুই ঘণ্টা বসতাম, বয়ে যাওয়া নদীকে দেখতাম। এভাবে প্রায় সাত বছর কাটিয়েছি। প্রতিদিনই কেউ না কেউ থাকত। এটাকেই মাঝেমধ্যে আমার সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় মনে হয়। মাঝেমধ্যে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের গীতিকার ও সুরকার হাশিম মাহমুদ আসতেন। কখনো আমার সঙ্গে নাশতা করে চা খেয়ে বলতেন, ‘হাঁটতে যাইবেন না?’ আমি যখন দু–একজন করে আলোচনা করতাম, তখন ‘জলের গান’-এর রাহুল আনন্দও এসেছে। ও অবশ্য আমার সামনেই বড় হয়েছে। এ রকম অনেক মানুষই এসেছেন, যাঁরা অসাধারণ, কিন্তু তাঁদের কেউ চেনেন না।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে বিজ্ঞান লেখালেখি, বিজ্ঞানবক্তৃতা বা বিজ্ঞানচর্চা করেন খুব অল্প কিছু মানুষ। আপনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞানে আগ্রহী হলেন কেন?

আসিফ: এর পেছনে অনেক কারণই আছে। তবে অসহায়ত্ব একটা বড় কারণ। বিজ্ঞানে আসাটা এমন নয় যে আমি হঠাৎ করে পড়লাম, খুব মজার ঘটনা দেখলাম আর বিজ্ঞানে চলে এলাম। এ রকম কিছু আমার জীবনে নেই। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় খালি পায়ে স্কুলে যেতাম, অনেকেই যেত। আমাদের বাড়ির পেছনে লাগোয়া পুকুর ছিল, তার এক পাশে ধু ধু প্রান্তর, আরেক পাশে বাংলোটাইপ বাড়ি; এগুলো বেলিং কোম্পানি বা রূপালী জুট মিল, স্বপ্নের জায়গা। সে সময় একদিন কয়েকজন ছেলে আমাকে বলল, ‘আসিফ, বৃষ্টিতে পুকুর ভরে গেছে, মাছ ধরতে যাবি?’ ‘না’ বলে স্কুলে চলে গেলাম। দুপুরে বাসায় ফিরে আসার সময় ৩০ গজ স্কয়ারের একটা মাঠের মুখোমুখি হতাম। দেখলাম, মাঠে অনেক লোক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, আমার বয়সী একটা ছেলে সাদা কাপড় পরে শুয়ে আছে। সকালে যাদের মাছ ধরতে যাওয়ার কথা বলেছিল, তাদের একজন। পরে বুঝলাম, সে মারা গেছে। তখনো মৃত্যু জিনিসটা আমি ভালোভাবে বুঝিনি। সেই প্রথম চোখের সামনে মৃত্যু দেখলাম। সকালে দেখলাম জীবিত একটা ছেলে, বিকেলে সে মারা গেছে। এটা আমার জন্য প্রচণ্ড শক (ধাক্কা) ছিল। আসলে যেখানে মাছ ধরতে গিয়েছিল, সেখানে ছিল বৈদ্যুতিক লাইন। ওই তারের সঙ্গে ছেলেটা পেঁচিয়ে গেছে। তখন তাকে কেউ বাঁশ দিয়ে বাড়ি দিলে হয়তো বেঁচে যেত। এই মৃত্যু কিছুটা হলেও পাল্টে দেয়। আমার ধারণা, সেখান থেকেই আমার চিন্তাভাবনার জগতে পরিবর্তন শুরু হয়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এবার জানতে চাই, আপনি বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখিতে কীভাবে এলেন?

আসিফ: আসলে আমার সব সময় লিখতেই হতো। আমার সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন কো-রাইটার (সহলেখক)। প্রথমে একটা রাফ লিখতাম। পরে সেটার বিস্তৃতি ঘটানো হতো। ঠিক করতাম, কীভাবে উপস্থাপন করা হবে। পরে অবশ্য পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। পুরোপুরি লেখালেখির জগতে ঢুকে পড়ি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

একটা সময় আপনি বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক বই লিখেছেন। দীর্ঘদিন আপনার লেখা কোনো বই দেখতে পাচ্ছি না। আরও একটা জিনিস জানতে পেরেছি, আপনি কার্ল সাগানের কসমস বইটি অনুবাদ করছিলেন। কিন্তু এখনো তা প্রকাশিত হয়নি। এত বড় বিরতি নিচ্ছেন কেন?

বিজ্ঞানচিন্তার কার্যালয়ে বিজ্ঞানবক্তা আসিফ

আসিফ: এটা আসলে বিশাল কাহিনি। বের হবে হবে করেও হচ্ছে না, আমারও খারাপ লাগে। তবে খুব শিগগির বইটা আসবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে নারায়ণগঞ্জে। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে অনেক সময় কাটিয়েছেন। বড় হয়ে ওঠার সেই গল্পটা শুনতে চাই।

আসিফ: আমরা একটা স্বপ্নের জীবন কাটিয়েছি। জীবনের এই যে যাপন, সে জীবনের সঙ্গে কতটুকু মিল, তা জানি না। তখনকার জীবনটা ছিল যেন খোলা মাঠ। ১৯৭৮ সালের কথা। নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াতাম। বয়স কত হবে—আট, নয় বা দশ (৮, ৯ বা ১০)। জায়গাটার নাম মেরিন ডিজেল বা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি (বিআইএমটি)। মেরিনের সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে মিলিমিটার ফিল্মের প্রজেক্টরের আলো প্রক্ষেপক দিয়ে দেয়ালে আলো ফেলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা অ্যানিমেল প্ল্যানেট–জাতীয় ডকুমেন্টারি দেখতাম। তিমি হত্যার ভয়ংকর দিক বিস্তৃতভাবে দেখেছি। যদিও তখন বুঝতাম না। হয়তো প্রাণিজগৎ নিয়ে এতটা সচেতনতা পৃথিবীব্যাপী গড়ে ওঠেনি। স্পিডবোটে ঘুরতে যেতাম, পিকনিক করতাম। একবার পিকনিকের চাঁদা উঠল ১১ টাকা। আমরা গেলাম ধলেশ্বরী, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার মোহনায়। সেখানে ছিল পেঁয়াজ আর টমেটোর খেত। আমরা দৌড়াতে থাকতাম। ক্লান্ত হলে সালাদ বানানোর জন্য পেঁয়াজের কলি নিয়ে এসেছি। পিকনিকে কারও বাড়ির চাল, কারও তেল নিতাম। এভাবে সবার থেকে নিয়ে পিকনিক হতো। মানে একধরনের কো-অপারেটিভ (সহযোগিতামূলক) চিন্তা আরকি। এভাবেই কেটে গেছে স্বপ্নের শৈশব।

বিজ্ঞানচিন্তা:

ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন? নিশ্চয়ই বিজ্ঞানবক্তা নয়?

আসিফ: না। চিন্তায়ও ছিল না। ইচ্ছা ছিল নাবিক বা এ রকম কিছু হব। মেরিন ডিজেলের বাঁ পাশে ‘ডেট পারসন’ নামে একটা জায়গায় নাবিক গড়ার ইনস্টিটিউট ছিল। তাঁদের কেউ কেউ বড় জাহাজি হয়েছেন। দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম, ‘প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়েছেন কখনো?’ এ রকম একজন প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ।’ তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কয়বার।’ উনি বললেন, ‘৪২ বার।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আটলান্টিকে গিয়েছেন?’ উনি বললেন, ‘৪০ বার।’ তখন আমার মাথার ভেতরটা কেমন করে উঠল! যিনি ৪২ বার প্রশান্ত মহাসাগরে যান আর ৪০ বার আটলান্টিকে যান, এই পৃথিবীটা তাঁর কাছে কেমন লাগে! ভাবতাম আর এক স্বপ্নের ঘোরে ডুবে যেতাম। মেরিন ডিজেলে একটা সুবিধা ছিল, ওখানকার একটা লাইব্রেরি রাতেও খোলা থাকত। রাতে একা একা বসে অনেক বই ঘাঁটতাম। রেনু ভাই নামের ওখানকার এক ভাই ছিলেন, উনি বেশ সহযোগিতা করতেন। বেশির ভাগ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ড্রয়িংয়ের বই। সেগুলো দেখতে ও পড়তে আমার যে কী আনন্দ হতো!

বিজ্ঞানচিন্তা:

একসময় আপনি বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স ওয়ার্ল্ড সম্পাদনা করেছেন। এখন বের করছেন মহাবৃত্ত। এ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

বিজ্ঞানচিন্তা হাতে বিজ্ঞানবক্তা আসিফ

আসিফ: এই দুটি ম্যাগাজিনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মহাবৃত্ত হলো জার্নাল টাইপের পত্রিকা। আর সায়েন্স ওয়ার্ল্ড ছিল বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার একটা ম্যাগাজিন। দুটোই সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করে। সায়েন্স ওয়ার্ল্ড-এর সঙ্গে ২০০৫ সালে যুক্ত থাকলেও ২০০৬ সালে কাজ শুরু করলাম। লুই পাস্তুর: জীবন ও কর্ম, সমান্তরাল মহাবিশ্ব, শৈবালবিদ নুরুল ইসলাম—এ রকম নানা বিষয়ে সংখ্যা করলাম। এমনকি সুলতানাস ড্রিম বইটির গুরুত্ব নিয়েও প্রচ্ছদ–কাহিনি করেছি ২০০৬ সালে। আজ ইউনেসকো এই বইটার গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বীকৃতি দিচ্ছে। তারপর বাংলায় বিজ্ঞানের পথিকৃৎ, চিড়িয়াখানা নিয়ে একটা সংখ্যা করলাম। এমনকি ২০০৭ সালের দিকে আমি ৫০০-এর বেশি চিঠি পেয়েছি প্রতি মাসে।

(প্রকৃতিবিদ) দ্বিজেন শর্মা সংখ্যা সায়েন্স ওয়ার্ল্ডই প্রথম বের করে। যাঁকে নিয়ে সংখ্যা করছি, উনি তখনো বেঁচে ছিলেন। মানুষটা সে অর্থে সেলিব্রিটিও নন। হায়াৎ মামুদ, দেবী শর্মা, মশিউল আলমসহ অনেকে আমাকে সহযোগিতা করেন। আমার কাজে দ্বিজেনদা খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি খুব শান্তি পেয়েছিলাম। এটাই ছিল দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে প্রথম সংখ্যা। যেখান থেকে পরে অনেকেই নিয়েছে, কিন্তু সংখ্যাটির প্রতি কেউ ‍ঋণ স্বীকার করেনি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

স্বাধীনতার পর থেকে অনেক সময় অনেকে বিজ্ঞান সাময়িকী করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোটাই দীর্ঘদিন টিকতে পারল না। দুই বা তিন বছর পর এসব সাময়িকী বন্ধ হয়ে গেছে। এর পেছনে কারণ কী বলে মনে করেন?

আসিফ: বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের (সাময়িকীর) পেছনে কেউ তেমন টাকা খরচ করতে চায়নি। বিজ্ঞান সাময়িকী নামে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হতো, যার সম্ভাবনা অনেক ছিল। কিন্তু বিনিয়োগের অভাবে টিকে থাকতে পারল না। সম্ভবত সায়েন্স ওয়ার্ল্ড সে রকম একটি পত্রিকা, যেখানে প্রথম এভাবে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। প্রকাশক নিয়মিত এর পেছনে খরচ করতেন। একসময় প্রকাশকেরা মনে করতেন, পত্রিকা বের করা বিনা পয়সার কাজ। যাঁরা লিখছেন, কাজ করেছেন, তাঁদের কাউকেই টাকা দেওয়া হতো না। তা না হলে আজ বিজ্ঞান সাময়িকীর বিশাল এক আর্কাইভ থাকত বাংলাদেশে। বিজ্ঞানচিন্তা এদিক দিয়ে সৌভাগ্যবান, পাঠকগোষ্ঠী পেয়েছে, আট বছর টিকে আছে। সুষ্ঠু বিনিয়োগ ও নিয়মিত প্রকাশ—এটা অনেক বড় ব্যাপার।

বিজ্ঞানচিন্তা:

কার্ল সাগান নিয়ে আপনার অসীম আগ্রহ। তাঁকে নিয়ে বইও লিখেছেন। আপনার লেখালেখিতেও কার্ল সাগানের উল্লেখ প্রচুর। তাঁর সম্পর্কে আপনার এত আগ্রহ কেন? এ আগ্রহ কীভাবে তৈরি হলো?

আসিফ: শৈশবে অনেকের ভাবনা থাকে, বিশ্বটাকে পরিবর্তন করে ফেলবে। কেউ নিউরোবায়োলজি, কেউ রিলেটিভিটি, কেউ অ্যানাটমি—এ রকম নানা বিষয়ে কাজ করে। আবার কেউ কেউ পড়াশোনা ছেড়েও দেয়। অন্যভাবে জীবনটাকে উপভোগ করবে। আমার এ রকম অনেক বন্ধু ছিল। তাদের অনেকে অনেক কিছু। কেউ লেখাপড়াই ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ, আমরা ভেবেছিলাম পাঁচ-সাত বছরের মধ্যেই পৃথিবীটাকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারব। এটা নিয়ে অনেকে হাসতে পারেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, এরা কতখানি ডেডিকেটেড। সব ছেড়ে নিয়ে নিজের কাজ নিয়ে পড়ে আছে। তবে আমি কখনো এভাবে ভাবিনি। কিন্তু আমি তাদের চিন্তাকে সম্মান করি। আমি বুঝি, এই যাত্রা অনেক বেশি বড়। এটা কোনো একা মানুষের যাত্রা নয়। এটা একটা লংমার্চ। জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চলবে। অনেকে বলেন, আপনি কসমস অনুবাদ করেছেন। আমি বলি—না, আমি কসমস–এর মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আমি অনুভবের চেষ্টা করেছি। কসমস আমাকে বুঝিয়েছে, আমি মহাবিশ্বের একটা অংশ। এ জন্যই কার্ল সাগানের প্রতি কৃতজ্ঞ।

কসমস বইয়ের প্রচ্ছদ
বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানের চূড়ান্ত গন্তব্য আসলে কী?

আসিফ: বিজ্ঞান একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা কখনো শেষ হবে না। তবে মহাবিশ্বের উপাদান দিয়েই মানুষ তৈরি। এখন আমরা জানি, আমরা কীভাবে পদার্থ ও মহাবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে জীবন বা চেতনা সম্পর্কে ততটা এখনো জানি না। আর আমাদের গন্তব্য হচ্ছে—মহাবিশ্ব ও নিজের মধ্যকার গভীর যে সম্পর্ক, দৃষ্টিভঙ্গিতে তার বিকাশ ঘটানো। এটাই শিক্ষা।

বিজ্ঞানচিন্তা:

জামাল নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন শর্মাসহ বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে জড়িত এমন অনেক ব্যক্তিকে আপনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁদের ব্যাপারে কিছু বলুন।

আসিফ: একবার সিরাজগঞ্জ গিয়েছি। তখন ভালোভাবেই জামাল নজরুল ইসলামকে চিনি। বুঝেছি যে ইনিই সেই বিখ্যাত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। আমি তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করি। তবে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে কোনো সখ্য গড়ে ওঠেনি। তবে ২০ বছর আগের একটা ছবি আমাকে ভাবায়: চট্টগ্রামে সম্ভবত তাঁর বাসায় জামাল নজরুল পিয়ানো বাজাচ্ছেন আর পেছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ডাইসন স্ফেয়ারের জনক ফ্রিম্যান ডাইসন তন্ময় হয়ে তা শুনছেন। ডাইসন, যাঁর কাজ সায়েন্স ফিকশনকেও হারা মানায়, জানতে ইচ্ছা হয় তিনি আসলে পিয়ানোর সুরে কী খুঁজছেন!

আর দ্বিজেন শর্মার মতো এত মানবিক মানুষ আমি কখনো দেখিনি। কোনো মানুষই তাঁর কাছে ছোট নয়। আর তাঁর যে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, তা ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ, বিস্তৃত। ডেইলি স্টার তাঁকে নিয়ে একটি সংখ্যা বের করেছিল। তখন যে সাংবাদিক তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সম্ভবত অমিতাভ কর, তাঁকে দ্বিজেনদা বলেছিলেন, ‘আমার সম্পর্কে কিছু করতে চাইলে সেখানে আসিফের বিবৃতি থাকতে হবে। কারণ, ও আমার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানে।’ দ্বিজেন শর্মা হলেন সেই ধরনের মানুষ, যিনি প্রতিটি অগ্রগতির পেছনে হিউম্যান রিলেশনগুলো (মানুষে মানুষে সম্পর্ক) কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার চেষ্টা করতেন। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ সময় কেটেছে। তাঁর সঙ্গে আমি লঞ্চে জার্নি করেছি, পাথারিয়া পাহাড় দিয়ে হেঁটেছি অনেকবার। সেটাও আমার জন্য একটা ভালো অভিজ্ঞতা।

বিজ্ঞানচিন্তা:

‘কসমস’ বইটা আপনার অনেক পছন্দ। ওটা পড়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। এ রকম আরও কোনো বইয়ের কথা বলবেন, যেটা সবার পড়া উচিত?

আসিফ: ইভান ইয়েফ্রেমভের ফেনার রাজ্য। শুভময় ঘোষ এটা অনুবাদ করেছেন। জহুরুল হক অনূদিত জেকব ব্রনোওস্কির বিজ্ঞানের চেতনা।

একনজরে

পূর্ণ নাম: আসিফুজ্জামান

জন্ম: ১.১০.১৯৬৮

জন্মস্থান: আগামসি লেন, ঢাকা

বাবা: আ খ ম আখতারুজ্জামান

মা: সাবেরা খানম

স্ত্রী: খালেদা ইয়াসমিন ইতি

সন্তান: ১ ছেলে

অবসর: বই পড়া, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো

প্রিয় বই: কসমস

প্রিয় ব্যক্তিত্ব: কার্ল সাগান

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার মতে বাঙালি সেরা বিজ্ঞানী কে?

আসিফ: সেরা বিজ্ঞানী বলে কিছু নেই। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রাধা গোবিন্দ চন্দ্র, জামাল নজরুল ইসলাম, অমল রায়—আরও অনেকে আছেন। প্রত্যেকে তাঁর নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা বাংলা থেকেই নিজেদের উন্মোচন করে গেছেন, এটা অনেক বড় শক্তি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

আসিফ: বাজারে বিজ্ঞানের শুধু একটাই পত্রিকা এখন। এ রকম শুধু একটা পত্রিকা থাকলে সেটা নিয়ে মতামত দেওয়া যায় না। এত দিন ধরে যে বিজ্ঞানচিন্তা বের হচ্ছে, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর-তরুণ। তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

আসিফ: এই মহাবিশ্বে সেরা বলে কিছু নেই, শ্রেষ্ঠ বলেও কিছু নেই। নিজেকে জানা, আত্মোন্মোচন (এক্সপ্লোরিং) গুরুত্বপূর্ণ। এ ধারণা আমাদের আত্তীকরণ করতে হবে।