রসায়ন
সমুদ্রের পানি হবে পানযোগ্য
ভূপৃষ্ঠের তিন ভাগ জল। তবু এই পানীয় জলের বড্ড অভাব পৃথিবীজুড়ে। এর বড় কারণ সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা। আগে সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হতো। এখন এসে গেছে নতুন এক পদ্ধতি।
পানির অপর নাম জীবন। নিছকই এক প্রবাদ নয়। কথাটা দুইভাবে সত্য। জীবনের উৎপত্তির বড় অংশে রয়েছে পানি। আবার পানি ছাড়া জীবন টিকেও থাকে না। শরীরে ৭৮ শতাংশ পানি নিয়ে মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে। এক বছরের সময় সেটা কমে ৬৫ শতাংশে নেমে এলেও পূর্ণবয়স্ক অবস্থায়ও দেহে ৬০ শতাংশ পানি থাকে। অন্য প্রাণীরাও কিন্তু পানি দিয়েই গঠিত। জেলিফিশে তো পানির পরিমাণ ৯০ শতাংশ। যে কারণে ভিনগ্রহে প্রাণ খুঁজতে আগে খোঁজা হয় পানি।
পানি ছাড়া আবার বাঁচাও সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ কত দিন বাঁচা সম্ভব, সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে আছে পরিবেশ, পরিশ্রম, বয়স, স্বাস্থ্য, ওজন, লিঙ্গ ইত্যাদি। পাবমেডের এক গবেষণা অনুসারে, মানুষ পানি ছাড়া ৮ থেকে ২১ দিন বেঁচে থাকতে পারে। বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাবে এটা আরও কমবেশি হতে পারে।
জীবনের জন্য এমন প্রয়োজনীয় উপাদানটি কি সবার হাতের নাগালে আছে? বেশির ভাগ উন্নত দেশে ট্যাপ খুললেই বিশুদ্ধ পানি বেরিয়ে আসে। এ পানির বড় অংশ অপচয় হয়ে ড্রেনের ময়লার সঙ্গে মিশে যায়। ওদিকে বিশ্বে ১০০ কোটির বেশি মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে। ২৭০ কোটি মানুষ বছরে অন্তত এক মাস পানির কষ্টে ভোগে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক হিসাব বলছে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেকসংখ্যক মানুষ বছরের কিছু না কিছু সময় পানিসংকটের মুখে পড়ে। ৫০ কোটি মানুষ সারা বছর সংকটের মধ্যে থাকে।
পাতনপ্রক্রিয়া আবার আলাদা। তরলকে বাষ্পীভূত ও ঘনীভূত করে করে অন্য উপাদানকে আলাদা করার নাম পাতন
অনেক লেখক বলছেন, পৃথিবীতে তেলের চেয়ে দুর্লভ হয়ে উঠছে পানি। স্টিভেন সলোমনের মতো অনেক বিশ্লেষক তো এ–ও দাবি করছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হবে পানি। নাসার একটি গবেষণায়ও এমনটা বলা হয়েছে। বিংশ শতকে পানির ব্যবহার জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্বিগুণ হয়েছে। নাসার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, বিশ্বের প্রধান ৩৭টি পানির উৎসের মধ্যে ২১টি ঝুঁকিতে আছে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও অত্যধিক ব্যবহার। এগুলোর বেশ কটিই চীন-ভারতের মতো বিভিন্ন দেশের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। যেগুলো নিয়ে চলছে বিবাদ।
অথচ পানির সহজ একটি উৎস আছে হাতের কাছেই! বলছি সমুদ্রের পানির কথা। পৃথিবীপৃষ্ঠের ৭০ শতাংশই পানি। পৃথিবীর ৯৬ শতাংশ পানিই পাঁচটি মহাসাগরে স্রোত তুলছে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত লবণের কারণে এ বিপুল জলরাশি পানীয় জলের অভাবমোচনে কোনো কাজে আসে না।
তবে কাজে লাগানো সম্ভব। সে জন্য পানি থেকে লবণ আলাদা করা চাই। প্রক্রিয়াটির নাম ডিস্যালাইনেশন। আর তাহলে বিশ্বজুড়ে পানির অভাব অনেকটাই কমে আসবে। কাজটি কিন্তু অনেক দেশ শুরুও করেছে। সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইসরায়েল নিরাপদ পানির জন্য ডিস্যালাইনেশনের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে। ইসরায়েলের তো গৃহস্থালি কাজের জন্য ৪০ শতাংশ পানিই ডিস্যালাইনেশনের মাধ্যমে আসে। এ দেশগুলোয় ভূগর্ভস্থ বা স্বাদুপানির উৎস নেই বললেই চলে।
পানিকে লবণমুক্ত করার বেশ কটি উপায় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হলো পুনঃ অভিস্রবণ ও পাতনপ্রক্রিয়া। অভিস্রবণপ্রক্রিয়ায় দ্রবণের তরল পদার্থ ঝিল্লি (তরল চলাচল করার মতো হালকা পর্দা) ভেদ করে অন্য পাশে চলে যায়। পুনঃ অভিস্রবণপ্রক্রিয়ায় পানিকে ছোট ছোট ফিল্টারের ভেতর দিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়। লবণকে পেছনে রেখে বেরিয়ে আসে বিশুদ্ধ পানি। পাতনপ্রক্রিয়া আবার আলাদা। তরলকে বাষ্পীভূত ও ঘনীভূত করে করে অন্য উপাদানকে আলাদা করার নাম পাতন। এ জন্য পানিকে প্রথমে গরম করা হয়। এরপর বাষ্পের কণাগুলো সংগ্রহ করা হয়। শুনতে সহজ মনে হলেও দুটি প্রক্রিয়াই অনেক ব্যয়বহুল। প্রয়োজন প্রচুর জ্বালানি ও বিশাল অবকাঠামো।
আসলে সাগরের পানিকে এখনো ব্যাপকভাবে সুপেয় পানিতে রূপান্তর না করার কারণ খরচ। এ কারণেই এখন পর্যন্ত সীমিত কিছু জায়গায় ডিস্যালাইনেশনের ব্যবহার আছে। যেখানে নেই স্বাদুপানির উৎস। কাজটি আরও করা হয় জাহাজ কিংবা রণতরিতে।
ডিস্যালাইনেশনের ক্ষতিকর দিকও আছে। ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্টগুলোতে সরাসরি সমুদ্রের পানি সংগ্রহ করা হয়। এভাবে মাছ বা অন্যান্য সামুদ্রিক জীব মারা যেতে পারে। বিশেষ করে ছোট আকারের সামুদ্রিক জীবদের তো ক্ষতি হবেই।
খরচটাও অনেক বেশি, যা বহন করার সাধ্য নেই বেশির ভাগ দেশের। সে তুলনায় স্বাদুপানি দূর থেকে বহন করে নিয়ে আসায়ই খরচ কম। তারপর সমুদ্রের লবণের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনাও আছে। খরচ তখন বাড়বে আরও। যত বেশি লবণ পানি থেকে আলাদা করতে হবে, খরচ হবে তত বেশি। এ কারণে অনেক সময় সাধারণ লবণপানির বদলে হালকা লবণপানি নিয়ে কাজ করা হয়। কিন্তু হালকা ঘনত্বের লবণপানির প্রাচুর্য কম।
তবে খরচ কমিয়ে আনতেও প্রচেষ্টার অন্ত নেই। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইসরায়েল। বর্তমানে দেশটিতে চাহিদার চেয়ে বেশি সুপেয় পানি তৈরি হচ্ছে। খরচও কমে আসছে। নব্বইয়ের দশকের তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে বর্তমান খরচ। এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে ইসরায়েলের সোরেক ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট। এখানে এক হাজার লিটার পানি তৈরিতে খরচ ৫৮ সেন্ট। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০ টাকা। মানে ৫ টাকায় ১০০ লিটার পানি তৈরি হয়। ইসরায়েলের মানুষকে পানির জন্য মাসে ৩০ ডলার (২ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি টাকা) বিল দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ রাজ্যে বিলটা একই রকম। লাস ভেগাস বা লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো রাজ্যে অবশ্য বিলটা দ্বিগুণ!
ইন্টারন্যাশনাল ডিস্যালাইনেশন অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বর্তমানে ৩০ কোটি মানুষ ডিস্যালাইনেটেড পানি ব্যবহার করে। সংখ্যাটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশেও ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ করছে।
ডিস্যালাইনেশন প্রক্রিয়া বর্তমানে কূটনীতির অংশ হয়েও দাঁড়িয়েছে। জর্ডান ও ইসরায়েল সীমান্তে আছে লোহিত সাগর ও মৃত সাগর। এই সাগরগুলোর পানি দিয়ে ঐতিহাসিকভাবে বৈরী দুই দেশ বিশাল ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। প্ল্যান্টের পানি সরবরাহ করা হবে দেশ দুটি ছাড়াও ফিলিস্তিনে।
ডিস্যালাইনেশনের খরচ কমানোর আরেকটি স্বাভাবিক উপায় হলো নবায়নযোগ্য শক্তি খরচ করা। সৌদি আরব বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ডিস্যালাইনেড পানি উৎপাদনকারী দেশ। বর্তমানে দেশটি ডিস্যালাইনেশনের জন্য প্রতিদিন ১৫ লাখ ব্যারেল তেল খরচ করে। পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় পানীয় জলের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ। তেলের বদলে তাই সৌরশক্তি ব্যবহার বিশাল পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সৌরশক্তিচালিত নতুন একটি প্ল্যান্ট দিনে ৬০ হাজার ঘন মিটার পানি উৎপাদন করবে।
ডিস্যালাইনেশনের জন্য সৌর প্রযুক্তি এখনো ব্যাপক হয়নি। বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার পানি ডিস্যালাইনেটেড করা হয়। প্রয়োজনীয় জ্বালানির ১ শতাংশের কম আসে সৌর উৎস থেকে। বাকি উৎসগুলোর জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে।
সমুদ্রের পানিকে সুপেয় করে তুলতে সৌরশক্তির সুফল ব্যবহার নিশ্চয়ই পৃথিবীর ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে থাকবে। দুটি জিনিসই বলতে গেলে মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অফুরন্ত আছে। অন্তত যত দিন না আমরা টাইপ টু বা থ্রি পর্যায়ের সভ্যতার স্তরে পৌঁছে যাই। যখন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে আসবে সূর্যের কিংবা পুরো গ্যালাক্সির সব শক্তি আহরণের কৌশল (তাত্ত্বিকভাবে!)। তাহলে আশা করা যায়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি কারণ অন্তত কমবে!
লেখক: প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, সিলেট ক্যাডেট কলেজ।
সূত্র: বিবিসি, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, গ্লোবাল সিটিজেন ডট অর্গ, ইউএসজিএস, নেচার