যেভাবে আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হলাম

বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। গত ৫ জুলাই, শুক্রবার তিনি দাবা খেলতে খেলতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ৫০ বছরের জীবনে তিনি বাংলাদেশি দাবাড়ুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফিদে রেটিং অর্জন করেছিলেন। তাঁর গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে ওঠার কাহিনি…  

খেলতে খেলতেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানছবি: শামসুল হক

আমি দাবা খেলতে শুরু করি ক্লাস ফোরে। তখন আমার বয়স মাত্র ১০। সে সময় থেকে আমি একটা খেলাই খেলতে চেয়েছি—দাবা। দাবা আমাকে যেমন আনন্দ দেয়, বারবার সক্ষমতার পরীক্ষা নেয়। এ জন্য সব সময় দাবা খেলায় চ্যালেঞ্জ অনুভব করি। তাই এখনো খেলে যাই আনন্দের সঙ্গে। সেই ছোটবেলা থেকেই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।

২০০২ সালে আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হলেও এর প্রস্তুতি  নিয়েছি দীর্ঘ সময়। বলতে গেলে ১৯৮৪ সালে যখন দাবা খেলতে শুরু করি, তখন থেকেই। মোটামুটি কম বয়সে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হয়েছিলাম। সেটা ১৯৯৩ সালের কথা। তখনো উচ্চমাধ্যমিক পাস করিনি, সিটি কলেজে পড়ি।

ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তাম। বইয়ের তালিকায় গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি থাকত দাবার বই। বাবা ছিলেন প্রকৌশলী, দেশের বাইরে থাকতেন। আমার জন্য নানা ধরনের বই পাঠাতেন, সেগুলো পড়তাম। মনোবিজ্ঞানের বেশ কিছু বই আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। সফলতার পেছনে কীভাবে ছুটতে হয় তার ওপর এম আর কোপমেয়ারের কয়েকটি বই বাবা এনে দিয়েছিলেন। এখনো বইগুলো আমার কাছে আছে। ওই বইগুলো আমাকে লক্ষ্যপূরণের জন্য সাহায্য করেছে খুব।

জিয়াউর রহমান
ছবি: জাহাঙ্গীর মাসুদ

গ্র্যান্ডমাস্টার হতে তিনটা নর্ম অর্জন করতে হয়। গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম পেতে চাইলে এমন টুর্নামেন্টে খেলতে হবে, যেখানে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক গ্র্যান্ডমাস্টার খেলবেন। অন্তত নয় রাউন্ড খেলা থাকতে হবে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক পয়েন্ট পেতে হবে। ১৯৯৯ সালের আগস্টে আমি প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মটা অর্জন করি, ব্রিটিশ ওপেনে, ইংল্যান্ডে। দ্বিতীয় নর্মটা পাই ২০০১ সালে কলকাতার গুডরিক আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্টে। শেষ নর্মটা পাওয়ার আশা নিয়ে আমি অংশ নিই ফ্রান্সে সাউতার্নের রোডে ওপেন টুর্নামেন্টে। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, এই টুর্নামেন্টেই আমি কাঙ্ক্ষিত নর্মটি অর্জন করতে পারব।

টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে সাদা নিয়ে এবং দ্বিতীয় ম্যাচে কালো নিয়ে আমি জিতি। পরের ম্যাচে আমার বিপক্ষে ছিলেন ফ্রেঞ্চ গ্র্যান্ডমাস্টার আন্দ্রেই ইস্ত্রাতেস্কু। এ ম্যাচে আমি সাদা নিয়ে শুরু করি। ২৫ চাল খেলার পর ম্যাচটি আমরা দুজন সম্মতভাবে ড্র করে দিই। ড্র করলে আধা পয়েন্ট পাওয়া যায়। দাবায় এমনিতে ম্যাচ ড্র হতে পারে, কিন্তু উভয় খেলোয়াড় চাইলে ম্যাচ ড্র ঘোষণা করতে পারে।

এই ম্যাচ ড্র করে আমি কিছুটা চাপে পড়ে যাই। এই টুর্নামেন্টে আমার চেয়ে বেশ ভালো রেটিংয়ের অনেক খেলোয়াড় ছিলেন। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বা রানার্সআপ হওয়ার চাপ আমার ছিল না। কিন্তু আমি তো ছুটছি আমার স্বপ্নের পিছু। পরের ম্যাচেও যদি ড্র করি, তাহলে আমার গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মটা পাওয়া হবে না। পরের ম্যাচে আমার প্রতিপক্ষ ইসরায়েলের গ্র্যান্ডমাস্টার আর্থার কোগান। তাঁর সঙ্গে ড্র করলেও আমার রেটিং খুব বেশি কমবে না। এমনকি হারলেও আসলে রেটিংয়ে প্রভাব পড়বে না। তবে এ টুর্নামেন্টে গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মটা আমার হাতছাড়া হবে। এর আগে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হওয়ার পর থেকে অনেকবার নর্ম অর্জনের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও সফল হইনি। একটা ভয় তাই ছিলই।

জিয়াউর রহমান
ছবি: জাহাঙ্গীর মাসুদ

টুর্নামেন্টটা ছিল আটলান্টিক থেকে কাছেই। আমি থাকতাম টুর্নামেন্টের চিফ আর্বিটার জিন লুইসের বাসায়। দাবায় আর্বিটার হলেন ফুটবল খেলার রেফারির মতো। আমি ছাড়াও কয়েকজন দাবাড়ু ওই বাসায় ছিলেন। সেদিন ৩১ অক্টোবর। সকালে জিন লুইস আমাদের বললেন, আমরা ঘুরতে যেতে চাই কি না। সকালে সবাই মিলে আটলান্টিকের পাড়ে ঘুরতে গেলাম। সাগর আমার সব সময় ভালো লাগে। সাগরের তাজা বাতাসে আমার মধ্য থেকে সব চাপ দূর হয়ে গেল। খুব ফুরফুরে মেজাজে খেলতে গেলাম।

খেলায় আমার ভাগ্যে ছিল কালো ঘুঁটি, কালো নিয়ে খেলা একটু কঠিন। আমি ‘ইংলিশ ডিফেন্স’ পদ্ধতিতে খেলা শুরু করি। আগে ইংলিশ ডিফেন্স পদ্ধতিতে শুরু করতাম না। ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে পরপর দুবার আমার একজন প্রিয় গ্র্যান্ডমাস্টারের কাছে হেরে গিয়েছিলাম আমি। ব্রিটিশ গণিতবিদ-দাবাড়ু স্পিলম্যান দুবারই আমাকে ইংলিশ ডিফেন্সে শুরু করে হারান। পরপর দুবার এভাবে হেরে ইংলিশ ডিফেন্স নিয়ে ভাবতে শুরু করি। পরে আবিষ্কার করি, ইংলিশ ডিফেন্স খুবই শক্তিশালী ‘ওপেনিং’।

ম্যাচটা চলেছিল ৩৯ চাল পর্যন্ত। ৩৭তম চালে আমার ঘোড়া আমি g4 থেকে e3-তে নিয়ে যাই। (e3 বলতে বোঝায় দাবা বোর্ডের ৫ নম্বর কলামের ৩ নম্বর সারি, দাবা বোর্ডের ছবিটা দেখলেই বুঝবেন।) সাদার রাজা চেকে পড়ে। আর্থার রাজা f2-তে নিয়ে আসে, আমি g1-এ থাকা সাদার হাতি খেয়ে ফেলি। আর্থারের রাজার কাছে আমার ঘোড়া কাটা পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে আমার জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। রাজার ঠিক ওপরে আমার একটা সৈন্য ছিল, রাজা সরলেই আমি নতুন ঘুঁটি ওঠাতে পারব, আমার মন্ত্রী (ইংরেজিতে কুইন) কাটা পড়েছিল। মন্ত্রীও ওঠাতে পারতাম। সৈন্যের ঠিক ওপরেই ছিল নৌকা।

আর্থারের সঙ্গে খেলার শেষ মুহূর্তে বোর্ডের অবস্থা। এ সময় ছিল আর্থারের সাদার ৩৭তম চাল।
আর্থারের সঙ্গে ম্যাচের চালগুলো: d4 e6 2. c4 b6 3. a3 f5 4. Nc3 Nf6 5. Qc2 Bb7 6. f3 Be7 7. e4 Nc6 8. e5 Nh5 9. Be3 Bh4+ 10. g3 f4 11. Bf2 Nxg3 12. hxg3 fxg3 13. O-O-O gxf2 14. Nge2 O-O 15. Qe4 Bg5+ 16. Kb1 Bh6 17. d5 Ne7 18. Nd4 Rf4 19. Qc2 Ng6 20. dxe6 Nxe5 21. Nf5 Bxf3 22. Nxh6+ gxh6 23. Rxh6 Qe7 24. Qd2 Raf8 25. Nd5 Bxd5 26. Qxd5 d6 27. Rd2 Kh8 28. Rh5 R4f6 29. Rd4 Qxe6 30. Rdh4 Qe7 31. Rxh7+ Qxh7+ 32. Rxh7+ Kxh7 33. Kc2 Kg7 34. Kd1 a5 35. b4 axb4 36. axb4 Ng4 37. Qc6 Ne3+ 38. Ke2 Nxf1 39. Kxf1 Rg6

এই ম্যাচ জিতে যাওয়ার পর আমাকে আর চিন্তা করতে হয়নি। পরের ম্যাচ বেলজিয়ামের গ্র্যান্ডমাস্টার আলেক্সান্ডারের সঙ্গে ছিল। খেলার শুরুতেই দুজনের সম্মতিতে ড্র করি ম্যাচটা। ষষ্ঠ ম্যাচটা দীর্ঘ ছিল, কালো নিয়ে আমি জিতি। পরের তিন ম্যাচে তিনজন গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করি। নয় ম্যাচের চার ম্যাচে জয়, পাঁচ ম্যাচ ড্র করি। ড্র করা পাঁচজনের সবাই ছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার, আমার চেয়ে বেশি রেটিংয়ের। মোট সাড়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে যৌথভাবে টুর্নামেন্টে রানারআপ হই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার সঙ্গে আপসে ড্র করা আন্দ্রেই ইস্ত্রাতেস্কু ৭ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। আমার মাথায় তখন রানারআপ বা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চাপ ছিল না। কারণ, ততক্ষণে আমি পেয়ে গেছি গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার তৃতীয় নর্ম। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০২ সালে ফিদে (FIDE) আমাকে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবে ভূষিত করে।

লেখক: বাংলাদেশের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার

অনুলিখন: ইবরাহিম মুদ্দাসসের, পিএইচডি গবেষক, রসায়ন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত