ওজোন স্তরের জন্মকথা

বায়ুমণ্ডলের অনেকগুলো স্তর আছে। একদম নিচের স্তরটাকে বলে ট্রপোস্ফিয়ার, তার ওপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, আরও ওপরে মেসোস্ফিয়ার ইত্যাদি। এসব কঠিন নাম না জানলেও স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরের একটি অংশের নাম সম্ভবত সবাই জানেন। ওজোন স্তর।

ভূপৃষ্ঠের ১০-৫০ কিলোমিটারের অংশটার নামই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। এর মধ্যে, ভূপৃষ্ঠের ১৫-৩০ কিলোমিটার ওপরের অংশটা জুড়ে রয়েছে ওজোন গ্যাস। মানে, এখানে ওজোনের ঘনত্ব অনেক বেশি। সে জন্যই এ অংশটাকে বলা হয় ওজোন স্তর। ওজোন মানে, একসঙ্গে তিনটি অক্সিজেন (O3)। পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার পেছনে এই ওজোন স্তরের ভূমিকা অপরিসীম। সে জন্যই এটাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা।

সূর্য থেকে আলো আসে, আমরা দেখি। পাশাপাশি সূর্য থেকে অতিবেগুনি রশ্মিও বিকিরিত হয়, এটা আমরা জানি। এই অতিবেগুনি রশ্মি—ইংরেজিতে বলে আল্ট্রাভায়োলেট, সংক্ষেপে ইউভি (UV)—তিন ধরনের হতে পারে। ইউভি-এ, ইউভি-বি এবং ইউভি-সি। ইউভি-এ রশ্মির শক্তি সবচেয়ে কম, ইউভি-বির শক্তি মাঝামাঝি আর ইউভি-সির শক্তি সবচেয়ে বেশি। এই সবচেয়ে বেশি শক্তির অতিবেগুনি রশ্মির বেশির ভাগটাই শুষে নেয় ওজোন স্তর। তবে বাকি দুই ধরনের অতিবেগুনি রশ্মি এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে। এর মধ্যে ইউভি-এ রশ্মির পরিমাণ থাকে প্রায় ৯৫%, আর ইউভি-বির পরিমাণ থাকে ৫ শতাংশের মতো।

ভূপৃষ্ঠের ১৫-৩০ কিলোমিটার ওপরের অংশটা জুড়ে রয়েছে ওজোন গ্যাস
এত তড়িঘড়ি করে ওজোন স্তর রক্ষার চেষ্টা করার কারণ আছে। ওজোন স্তর ইউভি-সি শুষে না নিলে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পড়ে। এতে মানুষের ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা। তখন নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ

১৯ শতকের মাঝামাঝি ফ্রিজ, এসির মতো বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য পণ্যে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, সংক্ষেপে সিএফসি, নামে একধরনের রাসায়নিক ব্যবহৃত হতো। এটি ফ্রিজের ভেতরটা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করত। কিন্তু এই রাসায়নিক বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ওজোন স্তরের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, ফলে ভেঙে যায় ওজোন অণু। তখন দুটি অক্সিজেন আলাদা হয়ে তৈরি হয় অক্সিজেন অণু (O2), আর একটি অক্সিজেন সিএফসির ক্লোরিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে ক্লোরিন মনোক্সাইড। এভাবে ধীরে ধীরে ওজোন স্তরে ফুটো হতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালে বিজ্ঞানীরা এটা প্রথম আবিষ্কার করেন। এর দুই বছর পর, ১৯৮৭ সালে সব রাষ্ট্র মিলে চুক্তি স্বাক্ষর করে যে সিএফসির ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। পরে, ১৯৯০ সালে মন্ট্রিয়াল চুক্তিতে বলা হয়, উন্নত দেশগুলো ২০০০ সালের মধ্যে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০১০ সালের মধ্যে সিএফসির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করবে। বর্তমানে তাই ফ্রিজ, এসি বা এ ধরনের কোনো কিছুতে সিএফসি ব্যবহৃত হয় না।

এত তড়িঘড়ি করে ওজোন স্তর রক্ষার চেষ্টা করার কারণ আছে। ওজোন স্তর ইউভি-সি শুষে না নিলে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পড়ে। এতে মানুষের ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা। তখন নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। ওদিকে, নষ্ট হয়ে যায় সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খল, কমে যায় ফসলের ফলন। নানামুখী এসব সমস্যার বাস্তব প্রকোপ দেখেই পৃথিবীর সব দেশ এক হয়েছিল ওজোন স্তরের সুরক্ষায়। তার ফল এখন আমরা পাচ্ছি। বর্তমানে ওজোন স্তরের সেই ফুটো ঠিক হয়ে গেছে।

যেভাবে ওজোন স্তর আমাদের সুরক্ষা দেয়
পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। আর ওজোন স্তর তৈরি হয়েছে প্রায় দুইশ কোটি বছর আগে, মানে পৃথিবীর জন্মের প্রায় ২৫০ কোটি বছর পর

ওজোন স্তরের গুরুত্ব তো বোঝা গেল। প্রশ্ন হলো, এই ওজোন স্তর তৈরি হলো কীভাবে? পৃথিবীর জন্মের সময়ই কি এটি ছিল, নাকি পরে কোনোভাবে তৈরি হয়েছে?

না, পৃথিবীর জন্মের সময় ওজোন স্তর ছিল না। তখন প্রাণ সীমাবদ্ধ ছিল সমুদ্রের গভীরে, যেখানে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি অতটা পৌঁছাতে পারত না। পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। আর ওজোন স্তর তৈরি হয়েছে প্রায় দুইশ কোটি বছর আগে, মানে পৃথিবীর জন্মের প্রায় ২৫০ কোটি বছর পর।

সে সময় একধরনের জলজ ব্যাকটেরিয়া ছিল। সায়ানোব্যাকটেরিয়া। এগুলো একধরনের আদিকোষ বা প্রাককেন্দ্রীক কোষবিশিষ্ট প্রাণ। আদিকোষ বা প্রোক্যারিয়টিক সেল মানে, সহজ করে বললে, এদের কোষে নিউক্লিয়াস সুগঠিত না; আর প্লাস্টিড, মাইটোকন্ড্রিয়া বা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণুগুলো থাকে না। তাই নিজেরা খাদ্য তৈরি করতে পারে না এগুলো সরাসরি। কিন্তু এই সায়ানোব্যাকটেরিয়াগুলোই একমাত্র আদিকোষবিশিষ্ট প্রাণ, যারা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য সরাসরি তৈরি করতে পারে! এদের কোষের বাইরের দিকে যে আবরণ থাকে, সেই আবরণের ভাঁজে ভাঁজে এই সালোকসংশ্লেষণ ঘটে।

ওজোন স্তরে ছিদ্র ধরা পড়েছে, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আতঙ্কের কিছু নেই
সায়ানোব্যাকটেরিয়ার দল সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে যে অক্সিজেন ছাড়ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল বায়ুমণ্ডলে। এভাবে জমতে জমতে আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন জমে যায়

সালোকসংশ্লেষণ মানে, সূর্যের আলো, কার্বন ডাই-অক্সাইড আর পানি ব্যবহার করে উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া। এ সময় বিক্রিয়ার বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত, মানে বাড়তি হিসেবে অক্সিজেন তৈরি হয়। সায়ানোব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে দেখে এদেরকে অনেকে ‘নীল-সবুজ শৈবাল’ও বলেন। ইংরেজিতে বলা হয় ব্লু-গ্রিন অ্যালগি। তবে এই নামটা ঠিক না। কারণ, শৈবালের কোষ সুগঠিত, ইউক্যারিয়টিক—ভেতরে নিউক্লিয়াস সুগঠিত; তার ওপর প্লাস্টিড, মাইটোকন্ড্রিয়ার মতো বিভিন্ন অঙ্গাণু থাকে। যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি।

সায়ানোব্যাকটেরিয়ার দল সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে যে অক্সিজেন ছাড়ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল বায়ুমণ্ডলে। এভাবে জমতে জমতে আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন জমে যায়। যথেষ্ট পরিমাণ মানে আজকের অক্সিজেনের পরিমাণের তুলনায় ১০ শতাংশের মতো। এ সময়টাকে বলা হয় প্রাক-ক্যামব্রিয়ান যুগ।

তখন বায়ুমণ্ডলের ওপরের দিকে কিছু অক্সিজেন অণু (O2) সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে ভেঙে যায়। অক্সিজেন অণুর দুটো পরমাণু যখন ভেঙে আলাদা হয়ে গেল, তখন একটি করে পরমাণু অন্য কিছু অক্সিজেন অণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে ফেলে তিন পরমাণুবিশিষ্ট অক্সিজেন অণু। মানে ওজোন (O3) গ্যাস। এভাবে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ওজোন স্তর। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা পায় পৃথিবী।

আরও পড়ুন

এর প্রায় ১৫ কোটি বছর পর প্রথম মাটিতে উদ্ভিদ জন্ম নেয়। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় আরও বেশি করে অক্সিজেন ছাড়তে থাকে তারা, ফলে ধীরে ধীরে আরও প্রাণবান্ধব হয়ে ওঠে পৃথিবী।

মানুষ এখন ওজোন স্তর নিয়ে অনেক সচেতন। তবু গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ওপর ওজোন স্তরে একটি বড় ছিদ্র ধরা পড়ে। তবে ইসার গবেষকেরা বলেছেন, এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। বর্তমানের মতোই সিএফসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এটি পুরোপুরি সেরে যাবে।

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, ইউনাইটেড স্টেটস এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি, নাসা, উইকিপিডিয়া