পরমাণুর ব্যাপারে সাধারণ একটা ধারণা আমাদের সবারই বোধ হয় আছে। যেকোনো পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। একে ঘিরে বিভিন্ন কক্ষপথে থাকে ইলেকট্রন। কথাটা আরও সঠিকভাবে বলতে চাইলে এভাবে বলতে হবে—ইলেকট্রনের মেঘ নিউক্লিয়াসকে ঘিরে থাকে। এখানে মেঘ মানে সম্ভাবনার মেঘ। এই মেঘের যে কোনো জায়গায় ইলেকট্রনটা পাওয়া যেতে পারে।
যাহোক, ইলেকট্রন বা পরমাণুর গঠন নিয়ে আরও জটিল বা গভীর আলোচনায় এ লেখায় যাব না। বরং শিরোনামের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। ধরুন, কপার বা তামার একটি পরমাণু। আরেকটি তামার পরমাণু নিলে, সেটা কি আগের পরমাণুর মতো হবে? একই মৌলের দুটো পরমাণু কি পুরোপুরি এক হতে পারে?
সাধারণত একই মৌলের দুটো পরমাণু একরকম হয় না। যেমন তামার দুটো পরমাণুর কথা আবারও ভাবা যাক। তবে ভাবার আগে ইলেকট্রন বা পরমাণুর উত্তেজিত অবস্থা কী, সেটা একটু জানতে হবে সহজভাবে।
আমরা জানি, নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন কিছু নির্দিষ্ট কক্ষপথে থাকে। তাপ বা আলো—এরকম তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের মাধ্যমে ইলেকট্রনকে শক্তি সরবরাহ করা যায়। এই শক্তি (যেমন তাপ) শোষণ করে নিয়ে ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়। উত্তেজিত ইলেকট্রন বাইরের কক্ষপথে চলে যেতে পারে বা বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। একে বলা হয় পরমাণুর উত্তেজিত দশা বা এক্সাইটেড স্টেড।
পরমাণুতে উত্তেজিত ইলেকট্রন (বাড়তি শক্তি শোষণ করেনি, এমন ইলেকট্রন) না থাকলে একে বলা হয় পরমাণুর অনুত্তেজিত অবস্থা বা গ্রাউন্ড স্টেট। অনুত্তেজিত পরমাণু সাধারণত বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না। প্রথমে এটিকে উত্তেজিত করতে হয় বিক্রিয়া করানোর জন্য।
এবারে তাহলে প্রশ্নটা আরেকটু পরিমার্জন করে, গুছিয়ে নেওয়া যাক। ধরা যাক, একই মৌলের দুটো পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো একই দশায় আছে। তাহলে কি পরমাণু দুটো পুরোপুরি একরকম হবে?
এবারে ওপরের প্রশ্নটা নিয়ে যদি ভাবি, খুব সহজে বোঝা যায়, একটি উত্তেজিত পরমাণু ও একটি অনুত্তেজিত পরমাণু একরকম নয়। কারণ, এ ক্ষেত্রে দশার পার্থক্য আছে। আর এই দশা পার্থক্য এর বিক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। আবার, উত্তেজিত দশায় রয়েছে, এমন পরমাণু কতটা উত্তেজিত, সেটাও বিক্রিয়ায় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
এবারে তাহলে প্রশ্নটা আরেকটু পরিমার্জন করে, গুছিয়ে নেওয়া যাক। ধরা যাক, একই মৌলের দুটো পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো একই দশায় আছে। তাহলে কি পরমাণু দুটো পুরোপুরি একরকম হবে?
উঁহু, হবে না। কারণ, পরমাণু সাধারণত কোথাও স্থির হয়ে থাকে না। চলনশীল বা ঘূর্ণমান থাকে। এই চলা বা ঘোরার গতিও পরমাণুর বিক্রিয়ায় প্রভাব রাখতে পারে। যেমন ধীরে চলা পরমাণু—ধরুন, লোহার কোনো খণ্ডের পরমাণু—স্থিতিশীল বন্ধন গঠন করতে পারে। কিন্তু তরল লোহার দ্রুত নড়নশীল পরমাণু অতটা স্থিতিশীল বন্ধন গঠন করতে পারে না। একইভাবে দ্রুত নড়নশীল টিনের পরমাণু আর ধীর গতির টিনের পরমাণুর বিক্রিয়ার ধরন ভিন্ন।
পাঠক হয়তো বলবেন, এবারে তাহলে প্রশ্নটা আরেকটু পরিমার্জন করে নেওয়া যাক। ধরুন, একই মৌলের সমগতিবিশিষ্ট দুটো পরমাণু একই দশায় আছে। তাহলে কি দুটো একরকম হবে? উত্তর: কঠিন! কারণ, পরমাণুতে ইলেকট্রন ছাড়াও রয়েছে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে। প্রোটনের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় পরমাণুর পরিচয়। তাই প্রোটনের সংখ্যা এক হলে ও নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হলে সেগুলোকে বলে একই মৌলের আইসোটোপ। যেমন কার্বন-১২ (৬টি প্রোটন ও ৬টি নিউট্রন) ও কার্বন-১৪ (৬টি প্রোটন ও ৮টি নিউট্রন)। দুটোই কার্বন বটে, তবে এক নয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এগুলো একই আচরণ করে বটে, তবে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় একরকম আচরণ করে না। যেমন পরমাণুর তেজস্ক্রিয় ক্ষয়। কার্বন-১২ ও কার্বন-১৪ পরমাণুর তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের হার ভিন্ন।
পাঠক হয়তো আবারও প্রশ্নটাকে সংশোধন-পরিমার্জন করতে চাইবেন। আগেই সে কাজ না করে, আরও কত কারণে দুটো পরমাণুর অবস্থা ভিন্ন হতে পারে, সেটা বলি। ইলেকট্রনের মতো নিউক্লিয়াসের ভেতরের প্রোটন বা নিউট্রনও উত্তেজিত বা অনুত্তেজিত দশায় থাকতে পারে। আবার গোটা নিউক্লিয়াসটা বিভিন্ন বেগে কাঁপতে ও ঘুরতে পারে। সে জন্য স্বর্ণের মতো পরমাণুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, সব—সব এক, শুধু নিউক্লিয়াসের উত্তেজনার পরিমাণের ভিন্নতার কারণে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় ভিন্ন আচরণ করছে।
সত্যি বলতে, একই মৌলের দুটো পরমাণুকে খুব সহজে একই অবস্থায় পাওয়া যায় না। পদার্থের একধরনের দশা আছে। এ দশায় বিভিন্ন পরমাণু বা উপপারমাণবিক কণা পরম শূন্যের একদম কাছাকাছি তাপমাত্রায় থাকে। ফলে এগুলো একইরকম আচরণ করে। পদার্থের এই দশাকে বলা হয় বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। বোস মানে আমাদের সত্যেন বসু। আর আইনস্টাইন তো আইনস্টাইনই, তাঁর পরিচয় আলাদা করে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট দশায় একই মৌলের একরকম একাধিক পরমাণু পাওয়া যায়। কাজটা এত কঠিন, অর্থাৎ একই মৌলের একই রকম একাধিক পরমাণু খুঁজে পাওয়া এত কঠিন যে যাঁরা প্রথম এ ধরনের পরমাণু শনাক্ত করেছেন, অর্থাৎ বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট শনাক্ত করেছেন, তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে! ২০০১ সালে এ জন্য এরিক কর্নেল, উল্ফগ্যাং কেটার্ল এবং কার্ল ওয়াইম্যান যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
তার মানে, হ্যাঁ, একই মৌলের দুটো পরমাণু থাকতে পারে। তবে এ ধরনের পরমাণু পাওয়া বড় কঠিন। তবে দুটো পরমাণু, যেমন দুটো কার্বন পরমাণু যদি একই রকম পারমাণবিক—নিউক্লিয়ার ও ইলেকট্রনিকভাবে একই দশায় থাকে, তাহলে তারা যেখান থেকেই আসুক না কেন, অতীতে এগুলোর সঙ্গে যাই ঘটুক, পরমাণু দুটো পুরোপুরি একরকম হবে।
সূত্র: ওয়েস্ট টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটি, নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ