ভূতত্ত্ব
সিলেটে তেলের সন্ধান: কীভাবে মাটির নিচে তেল ও গ্যাস তৈরি হয়
সম্প্রতি সিলেট গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া গেছে তেলের সন্ধান। মাটির নিচে কীভাবে তেল ও গ্যাস তৈরি হয়? কেন সব দেশে বা সব ভূমিতে তেমন তেল বা মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায় না? জেনে নিন...
সম্প্রতি সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপ খনন করে প্রথম স্তরে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঘণ্টায় ১৫৯ লিটারের মতো তেলের প্রবাহ পাওয়া গেছে এই গ্যাসক্ষেত্রে। আরও তিনটি স্তরে নতুন গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে বলেও জানা গেছে সম্প্রতি। প্রথম আলোর সূত্রে জানা গেছে এসব সংবাদ।
নানা প্রশ্ন জাগতে পারে এসব খবর দেখে আপনার মনে। যেমন মাটির নিচে তেল কীভাবে তৈরি হয়? কেন সব দেশে বা সব ভূমিতে তেমন তেল বা মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায় না? আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন, কয়লা বা গ্যাস পাওয়া যায়, তেলও পাওয়া যায় কিছু কিছু, কিন্তু স্বর্ণ বা হীরার মতো ধাতু কেন পাওয়া যায় না এই দেশে?
এই সব প্রশ্ন নিয়েই আজকের আলোচনা। প্রথমে একটু জানা যাক, তেল-গ্যাস ইত্যাদি কীভাবে তৈরি হয়।
পাঠ্যবই বলি বা প্রচলিত শব্দ, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বাজ ওয়ার্ড’, সে হিসেবে ‘জীবাশ্ব জ্বালানি’ আমাদের অতি পরিচিত শব্দ। ইংরেজিতে বলা হয় ফসিল ফুয়েল। ইংরেজি ‘ফসিল’ বা বাংলা ‘জীবাশ্ব’ কথাটার মানে জীবের অবশেষ। বহু আগে বেঁচে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণী, অর্থাৎ জীব মৃত্যুর পর বা কালের আবর্তে চাপা পড়েছে মাটির নিচে। প্রচণ্ড তাপ ও চাপে এগুলো পরিণত হয়েছে জীবাশ্বে। নিশ্চয়ই ভাবছেন, কত আগের?
এই কেরোজেন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ, অন্তত দুই থেকে তিন কিলোমিটার মাটির নিচে চাপা পড়লে পৃথিবীর ভেতরের তাপ আর ওপরের কোটি কোটি বছর জমা মাটির চাপে পরিণত হতে পারে তেল বা গ্যাসে। এখানে বোঝা প্রয়োজন, মাটির যত গভীরে, তাপমাত্রা আর চাপ তত বেশি। এর ওপর নির্ভর করে তেল তৈরি হবে, নাকি গ্যাস
কয়লা আসলে ডাইনোসরদের চেয়েও প্রাচীন জীবের অবশেষ। ডাইনোসরদের মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। আরও আগের মৃত গাছ বা প্রাণিদেহের অবশেষ মাটির নিচে চাপা পড়তে পড়তে কালের আবর্তে আরও অনেক নিচে নেমে গেছে। পরে, মহাদেশীয় পাতের ভাঙন বা নড়াচড়ার ফলে এগুলো উঠে এসেছে কিছুটা ওপরের দিকে।
ওদিকে সমুদ্রের পানিতে প্ল্যাঙ্কটন ও জলজ ক্ষুদ্র প্রাণী থাকে। কবে থেকে? এগুলোর ইতিহাস পৃথিবীর মতোই প্রাচীন। কোটি কোটি বছর ধরে এসব জীবের দেহাবশেষ, অর্থাৎ কার্বন ও অন্য জৈব যৌগ সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে পড়েছে। এর ওপর আরও মাটি, আরও পলি পড়েছে। কালের আবর্তে এগুলো ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে পাথরে। যত দিন গেছে, এর ওপর আরও পলি, আরও মাটি জমেছে শুধু। ওসব পাথর—জমাট জীবের দেহাবশেষ থেকে অক্সিজেনহীন পরিবেশে তৈরি হয়েছে মোমের মতো একধরনের পদার্থ। এর নাম কেরোজেন।
এই কেরোজেন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ, অন্তত দুই থেকে তিন কিলোমিটার মাটির নিচে চাপা পড়লে পৃথিবীর ভেতরের তাপ আর ওপরের কোটি কোটি বছর জমা মাটির চাপে পরিণত হতে পারে তেল বা গ্যাসে। এখানে বোঝা প্রয়োজন, মাটির যত গভীরে, তাপমাত্রা আর চাপ তত বেশি। এর ওপর নির্ভর করে তেল তৈরি হবে, নাকি গ্যাস। নাকি দুটোই। তাপমাত্রা ৯০ থেকে ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে গ্যাস আর তেল (পেট্রোলিয়াম)—দুটোই তৈরি হবে। তাপমাত্রা ১৬০ ডিগ্রির বেশি হলে তৈরি হবে শুধু গ্যাস। কারণটা তো বোঝাই যাচ্ছে—তাপে তরল হয়ে গেছে বাষ্পীভূত।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে? ১৫-২০ কিলোমিটার বা আরও বেশি পলি মাটির নিচে চাপা পড়ে, প্রচণ্ড তাপে ঝলসে গিয়ে তৈরি হয়েছে এসব জীবাশ্ব জ্বালানি। কোথায় দুই-তিন কিলোমিটার, আর কোথায় ১৫-২০ কিলোমিটার। এত নিচে চাপা পড়লে তাপও তো অনেক বেশি। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কিছু পেট্রোলিয়াম তৈরি হয়েছে এ দেশে।
এখন তো অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসে। এক, প্ল্যাঙ্কটন, ক্ষুদ্র সামুদ্রিক জীব—এগুলো তো সমুদ্রে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ভেতরে কীভাবে এল? দুই, কোটি কোটি বছরে মাটির এত নিচে চাপা পড়ে থাকা এসব জিনিস উঠে এল কীভাবে?
এখন তো আবার বাংলাদেশ সৃষ্টির ঘটনাটা জানতে হবে। বাংলাদেশ যে মহাদেশীয় পাতের অংশ, তার নাম ভারত মহাদেশীয় পাত। তবে সরাসরি বাংলাদেশ নয়, এ মহাদেশীয় পাতের অংশ বঙ্গীয় ব-দ্বীপ। এই মহাদেশীয় পাতটা একসময় ছিল পৃথিবীর উল্টো পাশে, অ্যান্টার্কটিকার কাছে। মাঝে বিশাল সমুদ্র। আর আজকে যেখানে বাংলাদেশটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে ছিল ইউরেশীয় পাত। ভারত মহাদেশীয় পাত ওই অতদূর থেকে ভেসে এসে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা খেল ইউরেশীয় পাতের সঙ্গে। ভয়ংকর এক ধাক্কা। এই ধাক্কায় তো বিভিন্ন ভূমির স্তর উল্টে-পাল্টে গেল বটেই, তবে এখনও ভূমিকম্পের সময় ওই মহাদেশীয় পাতের নড়াচড়ায় কোনো স্তর ওপরে উঠে আসে, কোনোটা নেমে যায়। আচ্ছা, আবার সেই ভয়ংকর ধাক্কার কথা বলি। সেই প্রচণ্ড ধাক্কায় আজকে যেখানে তিব্বতের পর্বতাঞ্চল, সেটা গড়ে ওঠে। তৈরি হয় হিমালয় পর্বত। তিব্বতের পর্বতাঞ্চল থেকে নদী হয়ে পলি এসে জমা হয় ভারত মহাদেশীয় পাতের সেই অংশটায়, যেখানে আজকের বাংলাদেশ। হ্যাঁ, এই দেশের বেশির ভাগ অংশই পলি পড়ে পড়ে তৈরি হয়েছে। এর আগে এই দেশের বেশির ভাগ অংশ ছিল সমুদ্র।
তাহলে সমুদ্র থেকে প্ল্যাঙ্কটন, ক্ষুদ্র পানি—এগুলো কীভাবে মাটিতে চাপা পড়ল, তা তো বোঝা গেল। বোঝা গেল, কীভাবে জীবাশ্ব মাটির নিচে চাপা পড়ে পড়ে চাপ ও তাপে কেরোজেন তৈরি হয়, সেখান থেকে পাওয়া যায় তেল ও গ্যাস। এ ছাড়াও আরও কিছু জিনিস আমাদের দেশে পাওয়া যায়। যেমন চুন বা চুনাপাথর।
সেই ভারত মহাদেশীয় পাতের একদম শেষের অংশে, অর্থাৎ দক্ষিণ প্রান্তে তৈরি হয়েছে বর্তমান সিলেট ও রংপুর। এর দক্ষিণে সে সময় ছিল শুধু সমুদ্রের অথৈ জল। এই সমুদ্রের শামুক, ঝিনুক বা কোরালের মতো প্রাণীরা মারা গেলে খোলসগুলো গিয়ে মেশে পানিতে। খোলসে কী থাকে? অনেক কিছু, তবে এর অন্যতম প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম। আমাদের হাড়ে বা নখে যেমন থাকে। অর্থাৎ প্রাণিদেহের শক্ত আবরণ মানেই ক্যালসিয়াম। আর ক্যালসিয়ামই চুনাপাথরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। খোলস মিশ্রিত সেই পানি বাষ্পীভূত হয়ে গেলে ক্যালসিয়াম পড়ে থাকে। এসব ক্যালসিয়াম জমে জমে তৈরি হয়েছে চুনাপাথর। সিলেটের ওই অংশটা তো সমুদ্রের প্রান্তে, যেখানে গভীরতা কম। মানে এককালের উপকূল। সেটাই আজকের সিলেট। সে জন্যই সেখানে অত সাদাপাথর বা চুনাপাথর।
সেই পানি বাষ্পীভূত হলে খোলসের ক্যালসিয়াম জমে তৈরি হয় চুনাপাথর। তাই যেখানে প্রচুর চুনাপাথর পাওয়া যায়, প্রায় নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায় সেটা এক সময় স্বল্প-গভীরতার পানির নিচে ছিল, অর্থাৎ উপকূল ছিল। সিলেটেও তাই হয়েছে।
শুধু চুনাপাথরই না, আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, গ্যাস বা পেট্রোলিয়ামও তৈরি হতে পারে এসব অঞ্চলে। সিলেটের গ্যাসক্ষেত্র তাই রহস্যময় কিছু না। এমনটাই হওয়ার কথা।
প্রথম আলোর তথ্য মতে, ১৯৮৬ সালে দেশে প্রথম তেলের সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৮৬ সালে, সিলেটের হরিপুরে। আরও প্রায় ত্রিশ বছর আগে, ১৯৫৫ সালে এই হরিপুরেই পাওয়া যায় প্রথম গ্যাসের সন্ধান। সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের ওয়েবসাইটেই রয়েছে এই তথ্য।
তেল, গ্যাস পাওয়ার রহস্যটা বোধহয় বুঝতে পারছেন নিজেই। আচ্ছা, স্বর্ণের বিষয়টা কী? আসলে, লোহা, স্বর্ণ বা এ ধরনের ধাতুগুলো মাটির আরও অনেক অনেক গভীরে থাকে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড বা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ আসলে অত গভীরই নয়। এ অঞ্চলে তাই স্বর্ণ বা এ ধরনের খনিজ পাওয়া যায় না। কালেভদ্রে কোথাও পাওয়া যেতেও পারে, তবে তা নিতান্ত অল্প এবং ব্যতিক্রম।
এই সব কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি আসলে প্রাকৃতিক গ্যাস। এই যে সাম্প্রতিক তেল পাওয়া গেল, সেটাও সিলেট গ্যাসক্ষেত্রে। এই লেখাটা ভালোভাবে পড়লে কারণটা আপনি ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছেন, তেল-গ্যাস তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা আসলে একই। পার্থক্য শুধু তাপমাত্রা ও চাপে।
সূত্র: প্রথম আলো, সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড, উইকিপিডিয়া, থিংক বাংলা
বঙ্গীয় বদ্বীপের অতীত ও ভবিষ্যৎ/ দীপেন ভট্টাচার্য