পবিত্র লিপির অন্বেষণে

মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাসের অনন্য দলিল তাদের হায়ারোগ্লিফিক লিপি। এর পাঠোদ্ধারের কাহিনিটাও চমকপ্রদ...

হারিয়ে যাওয়া ভাষা

প্রায় তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিসরীয়রা প্রথম ভাষার একটি লিখিত রূপ আবিষ্কার করে। পশুপাখি, দেব–দেবীর ছবি দিয়ে তৈরি সেই অপূর্ব সুদর্শন ভাষা মিসরীয় মন্দিরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিত কয়েক গুণ। মন্দিরের দেয়ালের এই লিপিকে গ্রিকরা নাম দিয়েছিল হায়ারোগ্লিফিকা বা পবিত্র লিপি। পরে হায়ারোগ্লিফিক নামেই লিপিটি বেশি পরিচিত হয়। কিন্তু রোজকার কাজকর্ম চালাতে এই লিপি নিতান্তই অসুবিধাজনক ছিল (সবাই তো আর আঁকতে পারে না!)। তাই মিসরীয়রা অপেক্ষাকৃত সহজ সংকেত দিয়ে একটি লিপি ব্যবহার শুরু করল, যার নাম হেরাটিক। আরও পরে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ হেরাটিক আরও সহজ রূপ নেয়। এই লিপির নাম ডেমোটিক বা জনপ্রিয়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, হায়ারোগ্লিফিক, হেরাটিক বা ডেমোটিক কিন্তু একই ভাষার বিভিন্ন রূপ। সহজে বুঝতে গেলে কম্পিউটারে বিভিন্ন ফন্টে (Font) ইংরেজি লেখার মতো। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে নিজেদের রোজকার জীবনে মিসরীয়রা এই তিন লিপিকে ব্যবহার করত নিয়মিত। এমনকি ৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত একটি মন্দিরের দেয়ালের হায়ারোগ্লিফিক প্রমাণ করে, যিশুর জন্মের প্রায় ৪০০ বছর পরও এই লিপি বহাল তবিয়তে বিরাজমান ছিল। খ্রিষ্টীয় ৫০০ শতক নাগাদ চার্চের প্রতিপত্তি প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। তাঁরা প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিককে সরিয়ে নতুন এক লিপি—২৪ বর্ণমালার কোপ্‌টিক, চালু করেন। এই কোপ্‌টিকের কোপে পড়ে মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে হায়ারোগ্লিফিক অচ্ছুত এবং অবশেষে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত হয়ে পড়ে। প্রাচীন ফারাওদের সঙ্গে বর্তমানের যোগাযোগের শেষ মাধ্যমটুকু কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। এককালে গোটা মিসরবাসী যে লিপিতে মনের ভাব প্রকাশ করত, ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সে লিপি হয়ে গেল দুর্বোধ্য ও অদ্ভুত সাংকেতিক এক ভাষা।

রশীদ শহর থেকে উদ্ধার করা সেই বিখ্যাত রোজেটা স্টোন। এই শিলাতে একই বক্তব্য গ্রিক, ডেমোটিক ও হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে খোদাই করা ছিল
উইকিমিডিয়া
মজার কথা, এই শিলাতে একই বক্তব্য পরপর তিন ভাষায় খোদাই করা ছিল—গ্রিক, ডেমোটিক ও হায়ারোগ্লিফিক। এগুলোর মধ্যে একমাত্র গ্রিকই ঝরঝর করে পড়ে নেওয়া যাচ্ছিল। দেখেই পণ্ডিতদের মাথায় একটা মতলব আসে।

ফিনিক্স পাখির জীবন

হায়ারোগ্লিফিক হারিয়ে গেল, হাজার বছরের ওপর একে ভুলে রইল পৃথিবীর মানুষ। সপ্তদশ শতকে পোপ পঞ্চম সিক্সটাস ঠিক করলেন, রোম শহরকে নতুনভাবে সাজাবেন। মিসর থেকে বিশাল সব অবিলিস্ক নিয়ে সাজানো হলো নগরটিকে। সেখানে হায়ারোগ্লিফিকসে নানা লেখা পোপের চোখে পড়ল। প্রথমে সেগুলো ছবি ভাবলেও পরে বুঝলেন সেটা ভাষা। যথারীতি পণ্ডিতেরা চশমা এঁটে বসে পড়লেন এর সমাধান করতে। শুরুতে ভেবেছিলেন সবাই, বড়জোর মাস ছয়েক লাগবে। ধীরে ধীরে দেখা গেল, এ বড় কঠিন ঠাঁই। আসলে প্রথম থেকেই সবাই একটা ভুল করে যাচ্ছিলেন। হায়ারোগ্লিফিকের প্রতিটা ছবি যে আসলে একেকটি চিহ্নমাত্র (A, B কিংবা ক, খ-এর মতো), সেটা তাঁরা কিছুতেই মানতে চাইছিলেন না। প্রতিটি ছবিকে আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন এবং ব্যর্থ হচ্ছিলেন। আদিম মানুষেরা গুহাগাত্রে যেসব অর্থপূর্ণ ছবি আঁকতেন, তারই কাছাকাছি কিছু একটা হবে বলে মনে করে তাঁরা গবেষণা চালাতে থাকেন। মজার কথা, এই আন্দাজে ঢিল মেরেও অনেকে দাবি করেছেন যে তাঁরা হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধার করেছেন। ১৬৫২ সালে জার্মান পুরোহিত অ্যাথেনাসিয়াস কিরচার Edipus aegyptiacus নামে একটা হায়ারোগ্লিফ ডিকশনারিই লিখে বসলেন। তাতে বিভিন্ন লিপির তিনি অনুবাদ করেন (কীভাবে করেন, তার ব্যাখ্যা না দিয়ে)। সে এক মজার অনুবাদ। একটি লিপির অনুবাদ করে তিনি লেখেন, ‘দ্য বেনিফিটস অব দ্য ডিভাইন ওসিনস আর টু বি প্রাউড বাই মিনস অব স্যাকরেড সেরিমনিস...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে তা ছিল ফারাও এপ্রিসের বংশতালিকা মাত্র। কিরচারের অনুবাদ পড়ে এখন আমাদের যতই হাসি পাক না কেন, মনে রাখতে হবে, হায়ারোগ্লিফিক নিয়ে প্রথম সিরিয়াস চর্চা এই কিরচারই শুরু করেন। কিরচারের ডিকশনারির পর ১০০ বছরের বেশি কেটে গেছে। হায়ারোগ্লিফিক প্রায় সিন্ধু সভ্যতার লিপির মতো অসমাধানযোগ্য মেনে নেওয়া হয়েছে। এমন সময় ১৭৯৮ সালের গ্রীষ্মে নেপোলিয়ন মিসর দখল করলেন। সত্যি বলতে, এই অভিযান না হলে আদৌ হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধার করা যেত কি না, সন্দেহ।

নেপোর কীর্তি

মিসরের অভিযানকারী দলের সঙ্গে নেপোলিয়ন সেনাবাহিনী ছাড়াও একদল প্রত্নতাত্ত্বিক আর পণ্ডিত নিয়ে আসেন। তাঁদের কাজই হলো মিসরের যা কিছু চোখে পড়ে তার ছবি আঁকা, ম্যাপ বানানো, মাপামাপি করা আর তথ্য সংগ্রহ। এভাবেই একটা প্রাচীন মন্দিরগাত্রের ভেঙে পড়া দেয়াল চোখে পড়ে তাঁদের। অন্য যেকোনো শিলালিপির থেকে এ লিপির এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম ছিল। ১৭৯৯ সালে পাওয়া এই পাথরের খণ্ডটি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত শিলালিপি। রোজেটা শহরের (আসল নাম রশিদ। পশ্চিমাদের কাছে তা রোজেটা নামে পরিচিত) কাছে জুলিয়েন দুর্গ থেকে পাওয়া এই পাথর আজও বিখ্যাত ‘রোজেটা স্টোন’ নামে। মজার কথা, এই শিলাতে একই বক্তব্য পরপর তিন ভাষায় খোদাই করা ছিল—গ্রিক, ডেমোটিক ও হায়ারোগ্লিফিক। এগুলোর মধ্যে একমাত্র গ্রিকই ঝরঝর করে পড়ে নেওয়া যাচ্ছিল। দেখেই পণ্ডিতদের মাথায় একটা মতলব আসে। এই গ্রিক ভাষার সাহায্যেই দুষ্পাঠ্য হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধারের চেষ্টা করা যাক! রোজেটা স্টোনকে হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধারের একমাত্র চাবিকাঠি ধরে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কায়রোর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে। তাঁরা এই পাথর নিয়ে গবেষণা শুরু করতে না করতেই ফরাসি সৈন্যরা ইংরেজদের কাছে পরাস্ত হয়ে পিছু হটতে লাগল। রোজেটা স্টোনকে নিজেদের কবজায় রাখতে তারা সেটিকে কায়রো থেকে সরিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে আসে। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস, ইংরেজদের হাতে ফরাসিদের পরাজয়ের পর পারস্পরিক শর্ত অনুযায়ী কায়রোর পুরাতত্ত্বগুলোই শুধু ফরাসিরা পায়, আলেকজান্দ্রিয়ার পুরাতত্ত্ব চলে যায় ইংরেজদের দখলে।

মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিকের বিভিন্ন প্রতীকের অর্থ
সংগৃহীত

ফলে ১৮০২ সালে ১১৮ সেন্টিমিটার লম্বা, ৭৭ সেন্টিমিটার চওড়া আর ৩০ সেন্টিমিটার পুরু কালো ব্যাসল্ট পাথরে খোদাই করা রোজেটা স্টোনটিকে পোর্টসমাউথ বন্দর থেকে HMS ইজিপশিয়ান জাহাজে চাপিয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আজও সেটি সেখানেই আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা গবেষণা করে বুঝলেন, ১৯৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে খোদিত এই পাথর মিসরের ফারাও টলেমির আমলে তাঁরই পুরোহিতদের নির্দেশে খোদাই করা। ছত্রে ছত্রে টলেমির নানা গুণগান ও রাজাকে আশীর্বাণী। এবারে হায়ারোগ্লিফিক ও ডেমোটিকে যেহেতু একই কথা লেখা, তাই পণ্ডিতেরা ভাবলেন, এবার খুব সহজে হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধার হবে।

কিন্তু তাতে তিনটি কঠিন বাধা ছিল। এক, রোজেটা স্টোন অক্ষতভাবে পাওয়া যায়নি। গ্রিক ভাষায় ৫৪ লাইন (শেষ ২৬ লাইন পাওয়া যায়নি), ডেমোটিক ভাষায় ৩২ লাইন (প্রথম ১৪ লাইন পাওয়া যায়নি) আর হায়ারোগ্লিফিকের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ—মাত্র ১৪ লাইন (তা-ও অসম্পূর্ণ) পাওয়া গিয়েছিল। ফলে উদ্ধারের কাজ বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত, হায়ারোগ্লিফিক ও ডেমোটিকে যে ভাষা রয়েছে, সেই প্রাচীন মিসরীয় ভাষাও অবলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় ৮০০ বছর আগে। ফলে সে ভাষা জানা না থাকলে লিপির অর্থ করা অসম্ভব। কিরচারের ভূত তখনো পণ্ডিতদের মাথায় চেপে। হায়ারোগ্লিফিকের প্রতিটি বর্ণকে চিহ্ন না ধরে প্রতিটি বর্ণকে আলাদা আলাদা মানে করতেই তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন। ফলে রোজেটা স্টোন উদ্ধারের পরও হায়ারোগ্লিফিকের রহস্য উদ্ধার বিশ বাঁও জলেই পড়ে রইল।

ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এটি গোটা লিপিতে বেশ কয়েকবার এসেছে। ইয়ং ধারণা করলেন, এটি নিশ্চয়ই মহান কোনো ব্যক্তির নাম। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে স্বয়ং ফারাও টলেমির নাম।

ইংরেজ বনাম ফরাসি

প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধারে যিনি উদ্যোগী হলেন, তিনি বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রতিভা টমাস ইয়ং (ডাবল স্লিট পরীক্ষার মাধ্যমে আলোর তরঙ্গধর্ম প্রমাণ করেন এই বিজ্ঞানী) । ১৭৭৩ সালে সমারসেটে জন্ম। মাত্র ২ বছর বয়স থেকেই ঝরঝর করে বই পড়তে পারেন, ১৪ বছর বয়সে গ্রিক, লাতিন, ফ্রেঞ্চ, ইতালীয়, হিব্রু, শ্যালডিন, সিরিয়াক, সামারিটান, আরবি, পারসি, তুর্কি ও ইথিওপিক ভাষায় সুপণ্ডিত। পরবর্তীকালে অসামান্য গণিততত্ত্ব, পদার্থবিদ্যার ইয়ং মডিউলাসের জনক...আর কত বলব। এহেন টমাস ইয়ংয়ের কানে রোজেটা স্টোনের কথা এল। যেকোনো প্রতিভাধর মানুষের মতো তিনিও উদ্যোগী হলেন হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধারে। ১৮১৪ সালে ওয়ার্থিংয়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে তিনি সঙ্গে করে রোজেটা স্টোনের লিপির একটা কপিও নিয়ে গেলেন। ইয়ং খেয়াল করলেন, হায়ারোগ্লিফিকে লেখার মাঝেমধ্যেই কিছু লিপির চারদিকে গোল করে দাগ দেওয়া। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এটি গোটা লিপিতে বেশ কয়েকবার এসেছে। ইয়ং ধারণা করলেন, এটি নিশ্চয়ই মহান কোনো ব্যক্তির নাম। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে স্বয়ং ফারাও টলেমির নাম। কারণ, গ্রিক লিপিতে বহুবার তাঁর নাম টলেমিয়াস উল্লেখিত। এবার নাম যেহেতু কমবেশি সব ভাষাতেই একইভাবে উচ্চারিত হয়, ইয়ং সেই কটি লিপির (যাকে তিনি নাম দেন কার্তুজ, যেহেতু গোল করে ঘেরা থাকায় তাদের বন্দুকের টোটার মতোই লাগত) উদ্ধারে মন দেন। কার্তুজটি দেখতে ছিল ওপরের ছবির মতো।

ইয়ং এটি ব্যাখ্যা করেন। পরে দেখা গেছে, তিনি ৫০ শতাংশ ঠিক ছিলেন উচ্চারণ অনুযায়ী লিপি স্থাপনে এবং ১০০ শতাংশ ঠিক ছিলেন এই ধারণায় যে হায়ারোগ্লিফিকের প্রতিটি লিপি একেকটি চিহ্নমাত্র, তার থেকে বেশি কিছু নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার, ইয়ং এই গোটা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিলেনই না, বরং এই লিপির উদ্ধারকে ‘অবসর বিনোদনের মজা’ বলে উল্লেখ করে ১৮১৯ সালে এ নিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে ছোট্ট একটা প্রবন্ধ লিখে রণে ভঙ্গ দিলেন।

হায়ারোগ্লিফিকে লেখা টলেমি ও আবু সিম্বাল মন্দিরের লিপি

ছোট্ট সেই প্রবন্ধ চোখে পড়ল ফ্রান্সের বছর তিরিশের এক নব্য যুবকের। জঁ ফ্রাঙ্কোয়িস সাপোলিনোঁ। হায়ারোগ্লিফিকের প্রতি তাঁর ভয়ানক এক ঘোর লাগা ভাব ছিল। ১৮০০ সালে, যখন তাঁর ১০ বছর বয়স, তিনি জঁ ব্যাপতিস্তে ফুরিয়ারের সংস্পর্শে আসেন। ফুরিয়ার ছিলেন নেপোলিয়নের সেই মিসরীয় দলের সদস্য। তাঁর থেকে মিসরের ফারাও, অজানা ভাষা ইত্যাদির কাহিনি শুনে তিনি সেই কচি বয়সেই স্থির করেন, তাঁকে এ ভাষার অর্থ উদ্ধার করতেই হবে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাঁর লেখা পেপার ‘ইজিপ্ট আন্ডার দ্য ফারাও’ তাঁকে আকাদেমি অব গ্রিনোবেলের সদস্যপদ দেয়, সঙ্গে অধ্যাপক পদও। ইয়ংয়ের মতো তিনিও প্রায় ১৮টি ভাষায় পণ্ডিত হয়ে ওঠেন, যার মধ্যে সংস্কৃতও ছিল। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একমুখী—হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধার করা। এতটাই তিনি নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন যে রাস্তায় গুজব শোনেন কোনো এক আলেকজান্দার লিওনেয়ার নাকি হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধার করেছেন। এ খবরে তিনি এতটাই চমকে যান যে রাস্তাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

সে যা–ই হোক। ১৮২২ সালে ইয়ংয়ের প্রবন্ধটি সাপোলিনোঁর চোখে পড়ল। এই প্রথম কেউ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হায়ারোগ্লিফিক উদ্ধারের চেষ্টা করল। টলেমির কার্তুজ দেখে প্রভাবিত হয়ে তিনি ক্লিওপেট্রার একটি কার্তুজ নিয়ে পরীক্ষা করেন। কারণ, p, t, o, l আর e—এই দুই ক্ষেত্রেই আছে। মজার কথা t বাদে বাকি অক্ষরগুলো মিলেও গেল। সাপোলিনোঁ ধারণা করলেন, ‘t’ বা ‘ট’ ধ্বনিটি হয়তো দুই রকম লিপি দিয়ে লেখা হতো, যেমন ‘ক’ ধ্বনিটি c বা k দিয়ে লেখা হয় (Cat এবং Kid)। এই ধারণা নিয়ে আরেকটি কার্তুজে তিনি a-l-?-s-e-?-t-r-? পেলেন। যেহেতু সেই কার্তুজ গ্রিক আক্রমণের সময় ও আলেকজান্দ্রিয়া থেকে পাওয়া, সাপোলিনোঁ ধারণা করলেন, এতে alksentrs লেখা, যা গ্রিকে আলেকজেন্দ্রস বা ইংরেজিতে আলেকজান্দার। এই সাফল্য দুটি পেয়ে সাপোলিনোঁ উৎসাহিত হলেন। এমন সময় ১৮২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মিসরের আবু সিম্বাল মন্দিরের কিছু লিপি তাঁর কাছে পৌঁছাল, যা তাঁর জীবন বদলে দিল চিরতরে।

রাজা রামেসিস আর আবু সিম্বাল

আবু সিম্বাল মন্দিরের লিপি বয়সে প্রাচীনতর। এগুলোর মধ্যে একটি কার্তুজ সাপোলিনোঁর চোখ টানল। এই নিচের ছবির মতো।

ছোট্ট এই কার্তুজ গোটা লিপিতে বহুবার ব্যবহৃত। Alksentrs থেকে তাঁর জানা ছিল, আঁকশির মতো চিহ্নটি মানে s. অর্থাৎ কার্তুজে লেখা আছে ?-?-s-s। আগের কার্তুজগুলোর মতো কোনো পূর্ব তথ্য ছিল না এ ক্ষেত্রে। পুরোটাই অন্ধকারে হাতড়ানো।

সাপোলিনোঁর মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি জানতেন, সূর্য বোঝাতে মিসরীয়রা এক গোলের মধ্যে ডট চিহ্ন ব্যবহার করেন। আর সূর্যদেবের মিসরীয় নাম ‘রা’ (ra)। অর্থাৎ শব্দটি ra-?-s-s. মাঝে কোনো অক্ষর বসালে কি কোনো মিসরীয় ফারাওয়ের নাম পাওয়া যাবে? একের পর এক অক্ষর বসানোর পর m বসাতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল—Rams বা Rameses, মিসরের প্রাচীন এক ফারাও। সাপোলিনোঁ বুঝলেন, ফারাওদের প্রাচীন ভাষা তিনি বুঝতে পেরেছেন, ভেঙে গেছে হায়ারোগ্লিফিকের রহস্য। পাগলের মতো দৌড়াতে লাগলেন তিনি রাজপথ ধরে। হাঁপাতে হাঁপাতে দড়াম করে খুললেন দাদার অফিসের দরজা। প্রায় বসে যাওয়া গলায় বললেন, ‘Je tiens I’ affaire’ (আমি পেরেছি), আর বলেই লুটিয়ে পড়লেন বারান্দায়।

পাঁচ দিন বাদে জ্ঞান ফিরে পেলেন সাপোলিনোঁ। সবকিছু তাঁর কাছে এখন পরিষ্কার। তিনি বুঝেছেন, সবাই ভুল, হায়ারোগ্লিফিক চিত্রও নয় আবার অক্ষরও নয়। বরং চিত্র-অক্ষর, যাকে rebus বলা হয়। বাচ্চাদের ধাঁধায় এই rebus প্রচুর ব্যবহৃত হয়। যেমন যেকোনো একটি শব্দ—ধরি, পাহাড়—একে প্রথমে উচ্চারণ অনুযায়ী ভেঙে ফেলতে হবে—পা ও হাড়। এবার একটি পায়ের ছবি ও একটি হাড়ের ছবি পাশাপাশি এঁকে পাহাড় বোঝানো যায়, যদিও আদতে পা ও হাড়ের সঙ্গে পাহাড়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

মজার ব্যাপার, গোটা হায়ারোগ্লিফিক ভাষাই গড়ে উঠেছিল এমন ধাঁধার মতো rebus principle মেনে। আর তাই খুঁজি খুঁজি করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি এর দিশা। সাপোলিনোঁ আবার নতুন করে কাজ শুরু করলেন। ১৮২৪ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর নতুন গ্রন্থ প্রেসিস ডু সিস্টে হায়ারোগ্লিফিক, ফারাওদের ভাষার প্রথম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। শুধু তা-ই নয়, প্রাচীন ও অপেক্ষাকৃত নবীন হায়ারোগ্লিফের পার্থক্যও দেখিয়ে দিলেন সাপোলিনোঁ।

প্রথম বিরোধিতা এল ইয়ংয়ের কাছ থেকে। সে আপত্তি ধোপে টিকল না। সাপোলিনোঁ নিজে মিসর গেলেন। ১৮ মাস থেকে নানা লিপির পাঠোদ্ধার করলেন। যে কেউ সহজে যাতে হায়ারোগ্লিফিক পড়তে পারেন, তার উপায় নির্দেশ করলেন। পরের তিন বছর মেতে রইলেন নোট, ছবি আর অনুবাদ নিয়ে। সেসব নিয়ে বই তৈরিতে পাঠালেন সাপোলিনোঁ। সব ঠিকঠাক, বই প্রকাশের ঠিক আগেই ৪ মার্চ ১৮৩২-এ মাত্র ৪১ বছর বয়সে আকস্মিক স্ট্রোকে মারা গেলেন হায়ারোগ্লিফের ডিকোডার।

লেখক: গবেষক ও কথাসাহিত্যিক, কলকাতা