গুজব ছড়ায় কীভাবে

কেউ কেউ বলেন, গুজব বাতাসের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছড়ায়। কিন্তু কীভাবে?

আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, গুজব ছড়িয়ে পড়ছে অতি দ্রুত। কেউ হয়তো নিজের মতো করে একটা কথা বললেন, দেখা যায়, ঘণ্টা পেরোনোর আগেই সেটা জেনে ফেলেন অনেক মানুষ। কেউ কেউ বলেন, গুজব বাতাসের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছড়ায়। আগে গুজব ছড়াত মূলত মুখে মুখে। এখন আর সেভাবে অত ছড়ায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর কোনো কোনোটি পাবলিক; অর্থাৎ গণসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—যেমন ফেসবুক বা এক্স (টুইটারের বর্তমান নাম)। একসঙ্গে অনেক মানুষ এতে যেকোনো লেখা, ছবি বা ভিডিও, অর্থাৎ কনটেন্ট দেখতে পান, শেয়ার করতে পারেন। কোনো কোনোটি আবার বার্তা প্রেরণের কাজে ব্যবহৃত হয় শুধু—যেমন হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা টেলিগ্রাম। এগুলোতে আগে শুধু একজনের সঙ্গে একজনের কথা হতো, তারপর এল গ্রুপ বা দলবদ্ধ যোগাযোগ। এখন চ্যানেলও খোলা যায়, অর্থাৎ একটা বিষয় মুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া যায় অনেকের কাছে।

কত দ্রুত ছড়াতে পারে গুজব? বিষয়টা একদিকে অবাক করা, অন্য দিকে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো বটে। তবে একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, পুরো বিষয়টাই গাণিতিক। এবং খুব সম্ভব। এতে খুব অবাক করা কিছু নেই। বিখ্যাত রুশ লেখক ইয়াকভ পেরেলমান তাঁর ‘অঙ্কের খেলা’ বইটিতে এ বিষয়ে লিখেছেন। ‘গুজব’ নামে একটি অনুচ্ছেদে দেখিয়েছেন, কীভাবে গুজব ছড়ায়। সেই লেখাটিই একটু ভিন্ন আঙ্গিকে এখানে উপস্থাপন করতে চাই।

পেরেলমানের গল্পে, একটা শহরে ৫০ হাজার মানুষ থাকে। একজন রাজধানী থেকে একটা খবর নিয়ে আসে শহরে। সেটা সকাল ৮টার কথা। সে তিন জনকে খবরটা জানায়। এ জন্য তার লাগে ১৫ মিনিট। অর্থাৎ সকাল ৮টা ১৫তে খবরটা জানতে পারে মাত্র ৪ জন। এখন, প্রত্যেকে যদি পরের ১৫ মিনিটে ৩ জনকে এই খবরটা বলে, তাদের প্রত্যেকে যদি পরের ১৫ মিনিটে আরও ৩ জন করে মানুষকে জানায়, এবং খবরটা এভাবে ছড়াতে থাকে, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে?

কত দ্রুত ছড়াতে পারে গুজব? বিষয়টা একদিকে অবাক করা, অন্য দিকে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো বটে। তবে একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, পুরো বিষয়টাই গাণিতিক। এবং খুব সম্ভব

৮টায় জানে: ১ জন

৮টা ১৫-এ জানে: ১ + ৩ জন = ৪ জন

৮টা ৩০-এ জানে: ৪ + (৩×৩) জন = ১৩ জন

৮টা ৪৫-এ জানে: ১৩ + (৯×৩) জন = ৪০ জন

৯টা বাজে জানে: ৪০ + (২৭×৩) জন = ১২১ জন

খুব বেশি না, কী বলেন? আরেকটা ঘণ্টা হিসেব করা যাক।

আরও পড়ুন

৯টায় জানে: ১২১ জন

৯টা ১৫-এ জানে: ১২১ + (৮১×৩) জন = ৩৬৪ জন

৯টা ৩০-এ জানে: ৩৬৪ + (২৪৩×৩) জন = ১ হাজার ৯৩ জন

৯টা ৪৫-এ জানে: ১০৯৩ + (৭২৯×৩) জন = ৩ হাজার ২৮০ জন

১০টা বাজে জানে: ৩২৮০ + (২১৮৭×৩) জন = ৯ হাজার ৮৪১ জন

এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে, শহরের এক-পঞ্চমাংশ মানুষ জেনে ফেলেছে। আর ৩০ মিনিট পরে কী হবে, ভাবুন তো!

১০টা ১৫-এ জানবে: ৯৮৪১ + (৬৫৬১×৩) জন = ২৯ হাজার ৫২৪ জন!

১০টা ৩০-এ জানবে: ২৯৫২৪ + (১৯৬৮৩×৩) জন = ৮৮ হাজার ৫৭৩ জন!

পেরেলমানের গল্পে, একটা শহরে ৫০ হাজার মানুষ থাকে। একজন রাজধানী থেকে একটা খবর নিয়ে আসে শহরে। সেটা সকাল ৮টার কথা। সে তিন জনকে খবরটা জানায়। এ জন্য তার লাগে ১৫ মিনিট।

দেখা যাচ্ছে, আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই সবাই জেনে ফেলবে। অথচ সকাল ৮টায় জানত মাত্র ১ জন মানুষ, আর প্রত্যেকে শুধু ৩ জনকে বলেছে।

সমীকরণটা কীরকম দাঁড়ায়?

মোট = আগের যোগফল + (আগের ধাপে যতজন নতুন জেনেছে × প্রত্যেকে যতজনকে বলছে)

যেমন আমরা দেখেছি, ৮টা ৩০-এ আগের যোগফল ছিল ৪। এ ক্ষেত্রে আগের ধাপে নতুন জেনেছিল ৩ জন, আর প্রত্যেকে বলেছে ৩ জনকে। তাই বিষয়টা হয়েছে—৪ + (৩×৩) জন = ১৩ জন।

৮টা ৪৫-এ, আগের যোগফল ১৩ জন। আগের ধাপে নতুন জেনেছে ৯ জন; আর প্রত্যেকে বলছে ৩ জনকে। সে জন্য জেনে ফেলল মোট ৪০ জন।

এখানে তাও গুজবটা ছড়িয়েছে ধীরে ধীরে। যদি প্রত্যেকে গুজবটা শোনার পর আরও ৫ জনকে বলে?

হিসাব করে সহজেই বোঝা যায়, ৯টা ৪৫; অর্থাৎ পৌণে ২ ঘণ্টার মধ্যেই সবাই খবরটা জেনে যাবে।

প্রত্যেকে ১০ জনকে বললে?

পুরো শহরে খবরটা ছড়াতে লাগবে ১ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়।

প্রত্যেকে ১০০ জনকে বললে? হিসাব করে বের করতে পারবেন সহজেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব যে আরও দ্রুত ছড়ানোরই কথা, তা এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।

গুজব কীভাবে এত দ্রুত ছড়ায়, তা সহজেই বোঝা যায় গণিত কষে
আরও পড়ুন

শেষ করার আগে বিষয়টা যদি এক কথায় বলি, যাঁরা মাধ্যমিক পর্যায়ের গণিতের সঙ্গে পরিচিত, নিশ্চয়ই বুঝেছেন, এটা আসলে গুণোত্তর ধারার সমীকরণ। এই সমীকরণটা এভাবে লেখা হয়—

a + ar + ar2 + ar3 + … + arn-1

এখানে, a হলো শুরুর পদ, r হলো সাধারণ অনুপাত বা যে হারে বাড়ছে আর n হলো পদসংখ্যা।

তাহলে, n তম পদ পর্যন্ত মোট যোগফল বা সমষ্টি হবে,

a (1 - rn)/(1-r); যদি r এর মান ১-এর কম হয়

আর r-এর মান ১-এর বেশি হলে যোগফল হবে,

a (rn - 1)/ (r-1)।

শিগগিরিই আসছে বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট সংখ্যা। এ সংখ্যায় থাকছে:

প্রতি ১৫ মিনিটে ৩ জন করে বললে, ৯টার হিসাবটা করে দেখা যাক।

শুরুর পদটি ছিল ১। a = 1।

বাড়ছে ৩ জন করে, অর্থাৎ r = 3।

আর ১৫ মিনিট অন্তত ৯টা হলো ৫ম পদ। ফলে n = 5।

সুতরাং, a (rn - 1)/ (r - 1) = 1 (35 - 1) / (3 - 1) = 1 (243 - 1)/ 2 = 242 / 2 = 121।

এটাই আমরা দেখেছিলাম, সকাল ৯টায় খবরটা জানতেন ১২১ জন।

সূত্র: অঙ্কের খেলা/ ইয়াকভ পেরেলমান, উইকিপিডিয়া