বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষকদের গবেষণা কর্মের মান ও প্রভাব (ইমপ্যাক্ট) নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন প্রকার নির্ণায়ক বা ইন্ডিকেটর ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত নির্ণায়ক হলো এইচ ইনডেক্স (h-index)। যার এইচ ইনডেক্স যত বেশি, তাঁর গবেষণার মান, গ্রহণযোগ্যতা ও ইমপ্যাক্ট তত বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। এইচ ইনডেক্সের পাশাপাশি গবেষকদের মোট সাইটেশনকেও তার গবেষণা কর্মের মান ও প্রভাব নির্ণয়ের আরেকটি প্রচলিত ইন্ডিকেটর হিসাবে ধরা হয়। কোন গবেষকের গবেষণাকর্ম অন্য একজন গবেষক যখন তাঁর গবেষণায় ব্যবহার করেন, তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় সাইটেশন বলা হয়। এইচ ইনডেক্সের মতো যার সাইটেশন যত বেশি, তাঁর কাজকে তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
প্রচলিত র্যাঙ্কিং পদ্ধতির সমস্যা
এই এইচ ইনডেক্স বা মোট সাইটেশন সংখ্যার ভিত্তিতে গবেষকদের র্যাঙ্কিং করার পদ্ধতিতে নানা সমস্যা আছে। মূল সমস্যাটি আসে ডেটাবেজভেদে এইচ ইনডেক্স বা সাইটেশন সংখ্যার তারতম্য থেকে। যেমন গুগল স্কলার থেকে ডেটা নিলে যে র্যাঙ্কিং হবে, ওয়েব অব সায়েন্স, স্কোপাস বা ক্লেরিভেট এনালাইটিকস থেকে নিলে তা হবে না। এই তারতম্যের কারণে নির্দিষ্ট একটি ফিল্ডে বা সাবফিল্ডে একজন গবেষকের র্যাঙ্কিংয়েও অনেক বড় তারতম্য চোখে পড়ে। তাই র্যাঙ্কিং হিসাব করার সময় এইচ ইনডেক্স বা সাইটেশন ডেটা কোন ডেটাবেজ থেকে নেওয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সমস্যা হলো, এইচ ইনডেক্স এবং সাইটেশন ডেটা নেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যার যেখান থেকে সুবিধা, সে সেখান থেকেই ডেটা নিচ্ছে। ডেটাবেজভেদে একজন গবেষকের সাইটেশন ডেটার এমন তারতম্যের অনেক কারণ আছে, সেগুলো অন্য আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। তবে এখানে সবেচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কয়েকটি ডেটাবেজের পাবলিকেশনের ডেটা সংগ্রহ এবং প্রচার নিয়ে দুই-একটি কথা বলা যায়। যেমন, একটি গবেষণাপত্র জার্নালের সাইটে প্রাকাশিত হওয়ার কমপক্ষে এক মাস পরে ‘ওয়েব অব সায়েন্স’ সেই গবেষণাপত্রের তথ্য তাদের সাইটে প্রকাশ করে। এই তথ্য প্রকাশে ‘স্কোপাস’ সময় নেয় এক বা দুই সপ্তাহ। আর ‘গুগল স্কলারে’ সেই ডেটা চলে আসে জার্নালের সাইটে আসার তিন দিনের মধ্যেই। ডেটাবেজগুলোতে গবেষণাপত্রের ডেটা প্রকাশের সময়ের এই তারতম্য যেকোনো গবেষকের মোট সাইটেশন এবং তার এইচ ইনডেক্সকে (নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে) প্রভাবিত করতে পারে। ফলে তার র্যাঙ্কিংও প্রভাবিত হতে পারে।
ডেটাবেজভেদে সাইটেশন এবং এইচ ইনডেক্সের কেমন তারতম্য হয়, তার একটি উদাহরণ দেই। আমার নিজের (Search Name: Muhammad J. A. Shiddiky) গুগল স্কলারে এইচ ইনডেক্স এবং সাইটেশন সংখ্যা যথাক্রমে ৪৬ এবং ৫৮৭৫ (২৬ শে অক্টোবর ২০২১ তারিখের তথ্য)। স্কোপাসে সেই সংখ্যা ৪৩ ও ৪৮৯৫ এবং ওয়েব অফ সায়েন্সে ৪১ ও ৪৭৯২। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আমার গুগল স্কলার এবং ওয়েব অফ সায়েন্স সাইটেশন ডেটায় পার্থক্য ১০৮৩। আর এইচ ইনডেক্সের পার্থক্য ৫। এখন আমাকে যদি সাইটেশন ডেটা ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে আমি অবশ্যই গুগল স্কলারের ডেটা ব্যবহার করব। কারণ, এই ডেটাতে আমার তুলনামূলক র্যাঙ্কিং ভালো আসবে। তার মানে হলো, একজন গবেষক যে ডেটাবেজ থেকে ডেটা নিলে তার র্যাঙ্কিং বেশি হবে, স্বভাবতই সে সেই ডেটাবেজের ডেটা ব্যবহার করবে।
এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেও এ সমস্যার প্রভাব কিছুটা লক্ষ্য করছি। প্রায় নিয়মিতই দেখতে পাই, কেউ না কেউ তার গবেষণা ফিল্ডে নিজেকে তার প্রতিষ্ঠানের সেরা, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশসেরা দাবী করেও স্ট্যাটাস দেন। অনেক নামি-দামি পত্রিকা সেই খবর আবার ফলাও করে প্রকাশও করেন। এই দাবি করা, প্রচার করা বা প্রকাশ করাতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। বরং এটি ভালো। আমাদের মধ্যে যে গবেষণায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব তৈরি হচ্ছে, এটি তার লক্ষণ। বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণার সামগ্রিক উন্নতির জন্য গবেষণায় পজিটিভ প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সমস্যা হলো, কোত্থেকে ডেটা নিয়ে এই র্যাঙ্কিং দেওয়া হয়েছে বা কীসের ভিত্তিতে এই দাবীটি করা হয়েছে? ডেটার সোর্স কী? সেই ডেটা কীভাবে হিসাব করা হয়েছে? এগুলো কী সর্বজনগৃহীত কোনো ডেটাবেজ থেকে নেওয়া? মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাপী এখন অনেক ভুঁইফোড় ডেটা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আছে। একটু ঘাঁটাঘাটি করলেই দেখা যাবে, এসব প্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিং তৈরি করতে এমন কিছু ইন্ডিকেটর ব্যবহার করেছে, যাদের অধিকাংশের সঙ্গে বিজ্ঞান গবেষণা এবং গবেষণা কর্মের প্রভাবের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। তাই এসব ইন্ডিকেটর দিয়ে গবেষণার মান নির্ধারণ করলে অন্য কিছু হলেও হতে পারে, কিন্তু তা যে গবেষণা কর্মের মান নির্ধারণী কিছু হবে না, তা আমি মোটামুটি নিশ্চিত।
শুধু সাইটেশন ডেটার ওপর ভিত্তি করে র্যাঙ্কিং করার আরও বড় একটি সমস্যা আছে। অনেক গবেষক নিজের গবেষণাপত্র নিজেই সাইট করেন। দেখা যায়, একটি গবেষণাপত্রের মোট ৪০টি সাইটেড রেফারেন্সের মধ্যে তাঁর নিজেরই ১৫টি। আর তাঁর কোলাবোরেটর বা সহযোগীদের আছে আরও ১৫টি। এই শ্রেণির গবেষকরা ছোট দল বেঁধে চলেন এবং একজন আরেকজনের কাজকে সাইট করেন। এর ফলস্বরূপ খুব সাধারণ মানের একটি গবেষণাপত্রও অল্প সময়ে অনেক বার সাইটেড হয়ে যায়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এসব সাইটেশনের অধিকাংশই অপ্রাসঙ্গিক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
নতুন সমন্বিত র্যাঙ্কিং পদ্ধতি
বিশ্বব্যাপী সাইটেশন ইনডেক্সের এই অপব্যবহার, অপব্যাখ্যা এবং অপপ্রচারকে দূর করতে যুক্তরাস্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন পি. এ. ইওয়ানিডিসের নেতৃত্বে একদল গবেষক একটি সমন্বিত পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ২০১৯ সালের ১২ আগস্ট বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী, প্লস বায়োলজিতে এই পদ্ধতিটি প্রকাশিত হয় (তথ্যসূত্র ১)। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই এটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অলোড়ন তোলে। বিভিন্ন ডেটাবেজের ডেটার তারতম্য দূর করতে ইওয়ানিডিসের দল শুধু স্কোপাস থেকে ডেটা নেন। এই পদ্ধতি উদ্ভাবনে তাঁরা একজন গবেষকের (ক) এইচ ইনডেক্স ও (খ) সাইটেশন সংখ্যার পাশাপাশি আরও চারটি ইন্ডিকেটর ব্যবহার করেন। এই চারটি ইন্ডিকেটর হলো, (গ) যৌথ লেখকদের ক্ষেত্রে সমন্বিত স্ক্রাইবার এইচ-এম ইনডেক্স (h-m index), (ঘ) একক লেখক হিসাবে মোট সাইটেশন সংখ্যা, (ঙ) একক বা প্রথম লেখক হিসাবে মোট সাইটেশন সংখ্যা এবং (চ) একক, প্রথম বা শেষ লেখক হিসাবে মোট সাইটেশন সংখ্যা। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এই ছয়টি ইন্ডিকেটরকে একসঙ্গে বিবেচনা করে তাঁরা কম্পোজিট (সি) স্কোর নামের একটি নতুন ইন্ডিকেটর প্রবর্তন করেন। সি-স্কোর হিসাব করতে তাঁরা একটি গাণিতিক সূত্রও উদ্ভাবন করেন। এই সূত্রে একজন গবেষকের জন্য স্কোপাস থেকে প্রাপ্ত ছয়টি ইন্ডিকেটরের প্রত্যেকটির মানের ন্যাচারাল লাগারিদমের সঙ্গে বিজ্ঞান গবেষণার সকল ফিল্ড ও সাব-ফিল্ডের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইন্ডিকেটরের সর্বোচ্চ মানের ন্যাচারাল লাগারিদমের আনুপাতিক সম্পর্ক বের করা হয়। আর ইন্ডিকেটরগুলোর লগারিদমের আনুপাতিক সম্পর্কগুলোর যোগফলই হলো এই গবষকের সি-স্কোর। সি-স্কোর হিসাব করার সূত্রটি প্লস বায়োলজিতে প্রকাশিত ইওয়ানিডিসের মূল গবেষণাপত্রটিতে দেওয়া আছে১। এটি একটি ওপেন অ্যাক্সেস বিজ্ঞান সাময়িকী, তাই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকেউ সহজেই গবেষণাপত্রটি ডাউনলোড করতে পারবেন।
ইওয়ানিডিসের দল সি-স্কোর ব্যবহার করে পৃথিবীর যে সব বিজ্ঞান গবেষক কমপক্ষে ৫টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে সেরা ২ শতাংশ গবেষকের একটি সমন্বিত তালিকা তৈরী করেন (তথ্যসূত্র ২, ৩)। এই তালিকায় ২২টি মূল গবেষণাক্ষেত্র (Research Field) এবং ১৭৬টি সাবফিল্ডের গবেষকদেরকে এক সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই তালিকার প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভার্সন ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ তৃতীয় ভার্সনটি প্রকাশিত হয়েছে এই বছরের ২০ অক্টোবর।
তালিকায় দুইটি বড় টেবিলে সেরা ২ শতাংশ গবেষকদের প্রত্যেকের নিজ নিজ সি-স্কোর বিবেচনায় নিয়ে একটি তুলনামূলক র্যাঙ্কিং দেওয়া হয়েছে। প্রথম টেবিলে গবেষকদের দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার প্রভাবকে দেখানোর জন্য তাদের ২২ বছরের বেশি সময়ের (১ জানুয়ারী, ১৯৯৬ থেকে ১ আগস্ট, ২০২১) স্কোপাসের সাইটেশন ডেটাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে (তথ্যসূত্র ২)। এই টেবিলে মূলত সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষকরাই বেশি স্থান পেয়েছেন। দ্বিতীয় টেবিলে প্রত্যেক গবেষকের শুধুমাত্র এক বছরের সাইটেশন ডেটাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে (তথ্যসূত্র ৩)। ফলে দীর্ঘ সময় থেকে গবেষণায় নিয়োজিত থাকা সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষকদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত তরুণ গবেষকদের তুলনার পক্ষপাত এবং ভারসাম্যহীনতার ব্যাপারটি অনেকাংশে কমে গিয়েছে। কারণ সুপ্রতিষ্ঠিত এবং নতুন সকল গবেষককেই এখানে তাদের এক বছরের ডেটার ভিত্তিতেই তুলনা করা হয়েছে। আমার নিজের সমন্বিত র্যাঙ্কিং এখানে একটি উদাহরণ হিসাবে দেখানো যেতে পারে। যেহেতু আমি অপেক্ষাকৃত নতুন গবেষক, তাই প্রথম টেবিলে সেরা দুই শতাংশ গবেষকের তালিকায় আমি স্থান পাইনি। কিন্তু দ্বিতীয় টেবিলে ২০২১ সালের সাইটেশন ডেটা অনুযায়ী আমি সমন্বিত র্যাঙ্কিংয়ে ৯৯ হাজার ৩৫৪তম স্থান পেয়েছি।
আগেই বলেছি, বর্তমানে প্রচলিত র্যাঙ্কিং পদ্ধতিতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ফিল্ডে গবেষকদের মোট গবেষণাপত্র ও সাইটেশনের সংখ্যাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। ইওয়ানিডিসের নতুন পদ্ধতিতে প্রত্যেক গবেষক ২২টি ফিল্ড এবং ১৭৬টি সাবফিল্ডের মধ্যে যেখানে সবচেয়ে বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, তার ওপর ভিত্তি করে গবেষকের দক্ষতার ক্ষেত্র হিসাবে একটি মূল ও দুইটি সাব গবেষণা ফিল্ডের নাম দেওয়া হয়। যেহেতু গবেষণাপত্র প্রকাশের ফিল্ড অনুযায়ী প্রতিটি গবেষকের দক্ষতার ফিল্ড এবং সাবফিল্ড বের করা হয়েছে, তাই সংশ্লিষ্ট সাবফিল্ডে সি-স্কোর ব্যবহার করে সেখানেও তাদেরকে একটি র্যাঙ্কিং দেওয়া হয়। যেমন, আমার গবেষণার একটি সাবফিল্ড হলো অ্যানালাইটিক্যাল কেমিস্ট্রি বা বিশ্লেষণী রসায়ন। ২০২১ সালের ডেটা অনুযায়ী এনালাইটিক্যাল কেমিস্ট্রির ১ লাখ ২ হাজার ৭৬৭ জন সেরা দুই শতাংশ গবেষকের মধ্যে আমার অবস্থান ৬৫২ তম। সে হিসাবে আমি এনালাইটিক্যাল কেমিস্ট্রির টপ (৬৫২/১০২৭৬৭) ^ ১০০ =) ০.৬৩% গবেষকদের একজন।
এই টেবিলে স্কোপাস থেকে ডেটা নেওয়ার সময় দুটি বিষয়কে খুব কার্যকরভাবে মানা হয়েছে। প্রথমত, প্রতিটি গবেষকের সি-স্কোর হিসাব করার সময় সেল্ফ সাইটেশনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন, একটি গবেষণাপত্রে সহলেখক যাঁরা আছেন, তাঁদের কেউ যদি এই গবেষণাপত্রটি নিজেদের অন্য কোনো কাজে সাইট করে, সেই সাইটেশন সংখ্যাকে এই গবেষকের সি-স্কোর হিসাব করার সময় বাদ দেওয়া হয়েছে। ধরা যাক, একটি গবেষণাপত্রে ১০ জন গবেষকের নাম আছে এবং এটি মোট ১২৫ বার সাইটেড হয়েছে। এই ১২৫টি সাইটেড গবেষণাপত্রের মধ্যে ২৫টিতে এই ১০ জনের কেউ না কেউ সহলেখক হিসাবে আছেন। সেক্ষেত্রে এই গবেষণাপত্রটির মোট ১২৫টির মধ্যে (১২৫ - ২৫ =) ১০০টি সাইটেশনকে হিসাবে নেওয়া হয়েছে। এখানে ২৫টি সেল্ফ সাইটেশনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক গবেষকের জন্য ইওয়ানিডিসের দল একটি ‘অথর প্রোফাইল’ তৈরি করেছেন। এটি তৈরি করতে তাঁরা প্রত্যেক গবেষকের নিজস্ব স্কোপাস প্রোফাইল ও কিউরেটেড অথর প্রোফাইলের একটি সম্মিলিত অ্যালগরিদম ব্যবহার করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, কোনোভাবেই যেন একজন গবেষক তাঁর সঠিক গবেষণাপত্র সংখ্যা এবং সংশ্লিষ্ট সাইটেশন সংখ্যা থেকে বঞ্চিত না হন। তাই এই টেবিলে প্রতিটি গবেষকের সি-স্কোর হিসাবের সময় ছয়টি ইন্ডিকেটরের ডেটা নির্ভুলভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে।
তালিকায় বাংলাদেশি গবেষকেরা
এ বছরের ২০ অক্টোবর ইওয়ানিডিসের দলের প্রকাশিত ২০২১ সালের ১ লাখ ৯০ হাজার ৬৫ জন সেরা দুই শতাংশ গবেষকের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ৯৭ জন স্থান পেয়েছেন (তথ্যসূত্র ৩, ৪)। এই ৯৭ জন বাংলাদেশি গবেষকের প্রত্যেককে নিয়ে আলাদা আলাদা করে লিখতে পারলে ভালো লাগতো, বিশেষ করে কেন তাঁরা তালিকায় স্থান পেয়েছেন, তাঁদের গবেষণা কর্ম কেন অন্যরা সাইট করছেন, এসব বিষয়ে লিখলে অনেক কিছু পরিস্কার হতো। গত দুই দিনে এই ৯৭ জনের প্রত্যেকের গুগল এবং স্কোপাস প্রোফাইল ঘেঁটেছি। তাঁদের অনেকের কাজের সঙ্গে আমার কাজের কোনো মিল নেই, এরপরেও এঁরা আমার নিজের দেশের—অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর সেই গবেষণার জন্য পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের নামের পাশে তাঁরা স্থানও পেয়েছেন।
এই তালিকায় বাংলাদেশ থেকে প্রথম স্থানে আছেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্বের অধ্যাপক মীর্জা হাছানুজ্জামান। তিনি বিশ্বের ১ লাখ ৯০ হাজার ৬৫ জন সেরা দুই শতাংশ গবেষকের মধ্যে ৮ হাজার ৩৭৪ তম। আর প্ল্যান্ট বায়োলজি ক্ষেত্রে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮১৪ জন সেরা গবেষকের মধ্যে তাঁর অবস্থান ৯৩ তম। বিশ্বসেরা ১০০ জন প্ল্যান্ট বায়োলজিস্টের মধ্যে একজন বাংলাদেশী গবেষক আছেন, এটি ভাবতেই ভালো লাগার একটি অনুভূতি হয়!
বাংলাদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় এখন আগের মতো আর পিছিয়ে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগিয়ে। এই তালিকার দিকে একটু খেয়াল করলেই এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। নর্থ সাউথ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায়। নর্থ সাউথ থেকে তিনজন গবেষক এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। এই তিনজনের মধ্যে ইলেট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক আহনাফ রাশিক হাসান সেরা দুই শতাংশ গবেষকের মধ্যে ২১ হাজার ৭৪৪ তম স্থান নিয়ে বাংলাদেশের গবেষকদের মধ্যে আছেন দ্বিতীয় স্থানে। আর নেটওয়ার্কিং সাব ফিল্ডে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৪৮ জন গবেষকের মধ্যে তিনি ১৮৮ তম।
বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণায় আইসিডিডিআর’বির কথা নতুন করে কী আর বলব? যাঁরা গবেষণার টুকটাক খবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চিত জানেন যে আইসিডিডিআর’বি হলো বাংলাদেশের মৌলিক ও ফলিত গবেষণার অন্যতম সূতিকাগার। এই তালিকায় স্থান পাওয়া ৯৭ জন বাংলাদেশির গবেষকের মধ্যে ১৪ জনই আইসিডিডিআর’বির। এর মধ্যে বাংলাদেশি গবেষকদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছেন আইসিডিডিআর’বির ডক্টর রাশিদুল হক। বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় তাঁর অবস্থান ৩০ হাজার ৬০৭ তম। মাইক্রোবায়োলজি সাবফিল্ডে তিনি পৃথিবীর ১ আলখ ৬৫ হাজার ২৪৪ জন সেরা দুই শতাংশ গবেষকের মধ্যে ৬৩০ তম। এই তালিকায় চতুর্থ স্থানে আছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক নুরশাদ আলী। সেরাদের সমন্বিত তালিকায় তাঁর অবস্থান ৩২ হাজার ৮৭০ তম। টক্সিওকোলজি সাবফিল্ডে ৫৩ হাজার ২৪৭ জনের মধ্যে তাঁর অবস্থান ১১৯ তম। নুরশাদ আলী ছাড়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও ৪ জন সেরা গবেষকদের এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। এ তালিকায় রাজশাহী, বুয়েট, ঢাকা, বাংলাদেশ কৃষি, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা এবং চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ৮, ৭ , ৫, ৩, ৩, ৩, এবং ২ জন করে স্থান পেয়েছেন।
তালিকায় স্থান পাওয়া বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য গবেষক আছেন, যাঁদের গবেষণার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বাংলাদেশের কম-বেশি সবাই মোটামুটি জানেন। যেমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তফাজ্জল ইসলাম। ২০২১ সালের টেবিলে সেরা দুই শতাংশ গবেষকের মধ্যে তিনি ৯৫ হাজার ১৮৬ তম স্থানে আছেন। শস্যের রোগ-বালাই এবং প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজিতে তাঁর অবদান দেশে এবং বিদেশে সমানভাবে স্বীকৃত। ঠিক একইভাবে এই টেবিলে ৯৫ হাজার ১০৮ তম স্থানে থাকা ডক্টর ফিরদৌসী কাদরী বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বেরও একজন প্রতিষ্ঠিত জীববিজ্ঞানী। বিশেষ করে কলেরা জীবাণু শনাক্ত করার দ্রুত-নির্ণয় পদ্ধতি উদ্ভাবনে তাঁর অবদান সারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
দীর্ঘদিন গবেষণার সঙ্গে জড়িত সুপ্রতিষ্ঠিত এবং প্রভাবশালী এমন গবেষকদের এই টেবিলের পাশাপাশি আরেকটি টেবিলে স্থান দেওয়া হয়েছে (তথ্যসূত্র ২, ৪)। যেখানে গবেষকদের দীর্ঘ ২২ বছরের বেশি সময়ের ডেটাকে তুলনায় নেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় বাংলাদেশ থেকে ৪০ জন স্থান পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে সবার আগে আছেন আইসিডিডিআর’বির ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস (এই তালিকায়, বিশ্বসেরা দুই শতাংশ গবেষকের মধ্যে তাঁর অবস্থান ২৪ হাজার ৩১৩ তম)। এর পরেই আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ. এ. মামুন (২৭ হাজার ৭৭২ তম)। এই তালিকায় স্থান পাওয়া আরও কয়েকজন হলেন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ডক্টর মোস্তাফিজুর রহমান (৫০ হাজার ২৪৪ তম), ডিভিশন অব কম্পিউটার এইডেড ড্রাগ ডিজাইনের ডক্টর নজরুল ইসলাম (৬৬ হাজার ৯৬৯ তম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. আনোয়ার হোসেন (৮৪ হাজার ৩২২ তম), বাংলাদেশ পাট গবেষণা কেন্দ্রের মো. শহীদুল ইসলাম (৯৩ হাজার ৫৮৬ তম)। এই টেবিলেও স্থান পেয়েছেন শুধুমাত্র এক বছরের বিবেচনায় ২০২১ সালের তালিকায় স্থান পাওয়া শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা হাসানুজ্জামান (৮৫ হাজার ৪৩৫ তম), আইসিডিডিআর’বির ডক্টর রাশিদুল হক (৪৭ হাজার ৬৫৯ তম) এবং ডক্টর ফিরদৌসী কাদরী (৯৫ হাজার ৯২৫ তম)।
শেষ কথা
এখন একজন গবেষক নানা কৌশলে তাঁর সি-স্কোর বাড়াতে চেষ্টা করতে পারেন। যেমন, তিনি যদি শুধুমাত্র একক লেখক হিসাবে (একজন মাত্র অথর) গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং সেই গবেষণাপত্রগুলো যদি খুব বেশি সাইটেড হয়, তাহলে তাঁর সি-স্কোর দ্রুত বেড়ে যাবে। যেসব গবেষকদের অনেক পিএইচডি, মাস্টার্স এবং অনার্সের ছাত্র এবং সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করতে হয়, তাঁদের সি-স্কোর খুব দ্রুত বাড়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাঁদের প্রতিটি গবেষণাপত্রে একাধিক সহলেখক থাকেন। কিন্তু এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মানসম্পন্ন গবেষণা করে গেলে এবং সেই গবেষণা নিয়মিত প্রকাশ করলে, গবেষণার দীর্ঘমেয়াদি সুফল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট সবাই যেমন পাবেন, তেমনি মানব সভ্যতারও উপকারে আসবে।
অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি, এসব র্যাঙ্কিং বেশিরভাগ সময় গবেষণা ও গবেষণা কর্মের ফলাফলকে সঠিক ভাবে তুলে ধরে না। কিন্তু এটিও সত্য যে লক্ষ লক্ষ গবেষক এবং তাদের গবেষণা কর্মকে একটি নির্দিষ্ট মানদন্ডের অধীনে যাচাই করতে হবে। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতে প্রচলিত যাচাই করার পদ্ধতিগুলোর প্রায় সবগুলোতেই কোনো না কোনো সমস্যা আছে। অনেকে আবার ইচ্ছেমতো ইন্ডিকেটর বা মেট্রিক্স সৃষ্ট করে যাচাই করার এই প্রকৃয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন। আমার অভিমত, ইওয়ানিডিস ও তাঁর দলের উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান গবেষকদের মান নির্ধারণের প্রায় নির্ভুল এবং সমন্বিত একটি পদ্ধতি। এর সর্বজনীন ব্যবহার বর্তমানে প্রচলিত র্যাঙ্কিং পদ্ধতির সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান দেবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্র :
(১) PLoS Biol, 2021, 17(8): e3000384. https://doi.org/10.1371/journal.pbio.3000384
(২) Table_1_Authors_career_2020_wopp_extracted_202108.xlsx
(৩) Table_1_Authors_singleyr_2020_wopp_extracted_202108.xlsx
(৪) https://elsevier.digitalcommonsdata.com/datasets/btchxktzyw/3