বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের শতভাগ নোবেলজয়ী ক্লাস

চন্দ্রশেখর ও তাঁর আবিষ্কৃত চন্দ্রশেখর সীমাছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিদ সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর। নামটা হয়তো শুনেছেন অনেকেই। তাঁর আবিষ্কৃত চন্দ্রশেখর সীমার কথাও হয়তো শুনেছেন। এই সীমার চেয়ে বেশি ভরের নক্ষত্ররা পরিণত হয় ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরে। নক্ষত্রের বিবর্তন ও জীবনচক্র নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৮৩ সালে মার্কিন পদার্থবিদ উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলারের সঙ্গে যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বিখ্যাত এই বিজ্ঞানীর জীবনের কিছু টুকরো গল্প শোনাতে চাই এ লেখায়।

দুঃখজনকভাবে চন্দ্রশেখরের সেই কোর্সে নিবন্ধন করে মাত্র দুজন ছাত্র! দুজনেই চৈনিক—ইয়াং ঝেনিং এবং ঝাং-দাও লি

১৯৩০ সালের ঘটনা। চন্দ্রশেখর তখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর শিক্ষক। ঠিক করেছেন অ্যাস্ট্রোফিজিকস, মানে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার ওপর একটা কোর্স নেবেন। পছন্দের বিষয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে বরাবরই ভালবাসতেন মানুষটি। শিক্ষার্থীদের সেসব বিষয় শেখাতেও তাঁর আগ্রহে কমতি ছিল না। কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার হলো, কোর্সটা নিতে হবে ইউনিভার্সিটি থেকে ৮০ মাইল দূরের এক অবজার্ভেটরি বা মানমন্দিরে। এত দূরে গিয়ে ক্লাস করা ও ক্লাস নেওয়া—দুটোই বিশাল ঝকমারির ব্যাপার! কিন্তু চন্দ্রশেখর তাতে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার কোর্স তিনি শুরু করবেনই করবেন।

সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলত কার কোর্সে কত বেশি শিক্ষার্থী, তা নিয়ে। যে অধ্যাপকের কোর্সে বেশি শিক্ষার্থী নিবন্ধন করতেন, তাঁদের জন্য সেটা ছিল বেশ গর্বের ব্যাপার। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কোর্স বেছে নিতে পারেন। স্বাভাবিকভাবে যে শিক্ষকেরা তুলনামূলক বেশি জনপ্রিয়, তাঁদের কোর্সে বেশি শিক্ষার্থী হতো। এই জনপ্রিয়তা উপভোগ করতেন অনেক শিক্ষক। আর সে জন্য সবাই চাইতেন যেন তাঁদের কোর্সে বেশি শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। দুঃখজনকভাবে চন্দ্রশেখরের সেই কোর্সে নিবন্ধন করে মাত্র দুজন ছাত্র! দুজনেই চৈনিক—ইয়াং ঝেনিং এবং ঝাং-দাও লি।

জ্যোতিঃপদার্থবিদ সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর
ছবি: সংগৃহীত

চন্দ্রশেখরের সেই কোর্স নিয়ে হাসি-তামাশা শুরু হয়ে গেল। অনেকেই ভাবলেন, মাত্র দুজন নিয়ে তো আর কোনো কোর্স চলতে পারে না। চন্দ্রশেখর নিশ্চয়ই এবার এই কোর্স বাতিল করে অন্য কাজে মন দেবেন। মাত্র দুজন ছাত্রের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবজার্ভেটরিতে যাওয়া-আসা করাও চাট্টিখানি কথা নয়! সে একেবারে পাক্কা ১৬০ মাইলের ধাক্কা! চন্দ্রশেখর নিশ্চয় এত বোকা নন যে শুধু দুজনের জন্য এত ঝক্কি কাঁধে নেবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে চন্দ্রশেখর সেই কোর্স চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন!

জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা চন্দ্রশেখরের ভালোবাসার জায়গা। অ্যাস্ট্রোফিজিকস শেখা, পড়া বা পড়ানো কিংবা গবেষণা করতে গিয়ে নানা বিষয়ের গভীরে ঢুকে যাওয়ার সুযোগ হেলায় হারাতে চাওয়ার পাত্র তিনি নন। নির্দ্বিধায় দুজনকে নিয়ে কোর্স চালিয়ে গেলেন এই বিজ্ঞানী। কিছুদিন পর দেখা গেল, জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার নেশায় বুঁদ তিন ছাত্র-শিক্ষক একসঙ্গে ৮০ মাইল পাড়ি দিয়ে একবার যাচ্ছেন, আবার ফিরছেন দিনশেষে।

ক্লাসের জনসংখ্যা এত কম বলেই কিনা, তাঁদের তিনজনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠল। কিংবা হতে পারে, নিজেদের কাজের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসার জন্যই হয়তো একে অন্যকে এত সম্মান করতেন। কেবল ক্লাসের জন্য এত এত মাইল যাঁরা নিয়মিত পাড়ি দিচ্ছেন, তাঁদের কর্মনিষ্ঠার তীব্রতা সহজে অনুমেয়।

অ্যাস্ট্রোফিজিকস নিয়ে ক্লাস চলল, গভীর জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করলেন তিন বিজ্ঞান অভিযাত্রী। যত দিন গড়াতে লাগল, তাঁদের কর্মস্পৃহা বাড়তে লাগল আরও
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ইয়াং ঝেনিং এবং ঝাং-দাও লি
ছবি: সংগৃহীত

অ্যাস্ট্রোফিজিকস নিয়ে ক্লাস চলল, গভীর জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করলেন তিন বিজ্ঞান অভিযাত্রী। যত দিন গড়াতে লাগল, তাঁদের কর্মস্পৃহা বাড়তে লাগল আরও। নতুন নতুন নানা বিষয়ে তাঁরা বিচরণ করতে লাগলেন। ঝেনিং ও ঝাং-দাও কাজ শুরু করলেন দুর্বল বল বা দুর্বল মিথস্ক্রিয়ায় ‘প্যারিটি’ যে সংরক্ষণশীল নয়, সে বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এটি দুর্বল বলের অনন্য চিহ্ন। মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বলের একটি এই দুর্বল বল। একে উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সও বলা হয়। খুব জটিলতায় না গিয়ে বলা চলে, বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়ে নতুন চিন্তাধারা তৈরি হয় তাঁদের কাজের ফলে। আগে কেউ এই বিষয়ে এভাবে ভাবতে পর্যন্ত পারেননি।

ঠিক এ কারণে কয়েক বছর পর এভাবে চলার পর দুজনেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন! ১৯৫৭ সালে ইয়াং ঝেনিং এবং ঝাং-দাও লিকে দুর্বল বল নিয়ে কাজের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। আরও প্রায় ২৬ বছর পর, ১৯৮৩ সালে চন্দ্রশেখর নিজেও নোবেল পুরস্কার পান। এ কথা অবশ্য আগেই বলেছি।

হইচই পড়ে যায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেবল সেই বিশ্ববিদ্যালয় কেন, গোটা বিশ্বেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই ক্লাস! হবে নাই-বা কেন? একটা ক্লাসের শতভাগ মানুষ নোবেল বিজয়ী, ভাবা যায়!

কে কী বলল বা কোন কথায় অপমান করা হলো, সে সব নিয়ে চন্দ্রশেখর বা তাঁর শিক্ষার্থীরা মাথা ঘামাননি। তিনজনের ক্লাস নিয়ে অনেকে কটু কথা বললেও তিনজনই নিজেদের কাজ করে গেছেন নিজেদের মতো করে। ভালোবেসেছেন নিজেদের কাজকে এবং সে হিসেবেই পরিশ্রম করেছেন।

এখানে একটা বিষয় আলাদা করে বলতে চাই। যখনই কেউ নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন, স্বাভাবিকভাবে সবাই সেটার গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। নতুন কিছু নিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে যেমন সহজে সেই বিষয়ে পারদর্শী কাউকে পাওয়া যায় না, তেমনি নতুন কোনো ভালো উদ্যোগ নিলেও প্রায়ই দেখা যায়, বেশি মানুষ এতে আগ্রহী হন না। চন্দ্রশেখরের এই গল্প যেন আমাদের সেই কঠিন মুহূর্তগুলোতে আশার আলো হয়ে পথ দেখায়। বুঝতে শেখায়, সবসময় পরিমাণ নয়, গুণমান বা কোয়ালিটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এই গল্প যুগে যুগে বহু বিজ্ঞানী ও গবেষককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁদের মতো আমরাও যদি এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারি, হয়তো এই শিক্ষা আমাদেরও এগিয়ে নেবে আরও কয়েক আলোকবর্ষ!

লেখক: প্রকৌশলী ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর

সূত্র: ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, উইকিপিডিয়া, দ্য গার্ডিয়ান