জুলাই মাসে নতুন যা জানলাম

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. চাঁদে বিশাল গুহা

রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু চাঁদ। কিন্তু এর অনেক অজানা রহস্য আজও কৌতূহল জাগায় বিজ্ঞানীদের মনে। সম্প্রতি চাঁদের বুকে বিশাল এক গুহার খোঁজ পেয়েছেন ইতালীয় বিজ্ঞানীরা। তাঁরা মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার লুনার রিকনিস্যান্স অরবিটারের (এলআরও) তথ্য থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এমন গুহার খোঁজ এই প্রথম মিলল। গুহাটি চাঁদের ‘সি অব ট্র্যাঙ্কুইলিটি’ বা ট্র্যাঙ্কুইলিটি খাদ নামে অঞ্চলে পাওয়া গেছে। অ্যাপোলো-১১ নভোযান যেখানে নেমেছিল, সেখান থেকে মাত্র ৪০০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি প্রায় ৪০ মিটার চওড়া, ৯ মিটার লম্বা ও ১০০ মিটার গভীর। চাঁদের এই বিস্ময়কর গুহার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে। বিজ্ঞানীদের মতে, গুহাটি ভবিষ্যতে চাঁদে মানববসতির জন্য সম্ভাবনাময় স্থান হতে পারে।

২. বিরল নীল প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান

প্যারাপারত্রেচিনা নীলা

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের হিমালয়ের পাদদেশে বিজ্ঞানীরা পিঁপড়ার একটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন। ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির নাম দেওয়া হয়েছে প্যারাপারত্রেচিনা নীলা (Paraparatrechina neela)। এ পিঁপড়ার সম্পূর্ণ শরীর ধাতব নীল রঙের। পিঁপড়ার জন্য এটা অত্যন্ত বিরল। বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে এদের রং নীল কেন। এই পিঁপড়ার দৈর্ঘ্য ২ মিলিমিটারেরও কম। উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে বাস করে। বাসা তৈরি করে গাছের গোড়ায় ও পাথুরে ফাটলে। এদের মাথা ত্রিভুজাকৃতির। সাধারণ পিঁপড়ার মাথা এমন আকৃতির হয় না। এ ক্ষেত্রেও পিঁপড়াটি তাই অনন্য। এদের মাথার মাঝে দুটি বড় চোখ স্পষ্ট দৃশ্যমান। মাথার নিচের অংশে পাঁচটি তীক্ষ্ণ দাঁত রয়েছে। এই শক্তিশালী চোয়াল শিকার ধরতে এবং খাবার কাটতে সাহায্য করে। মার্কিন জার্নাল জুকিসে (ZooKeys) এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

৩. পর্যায় সারণির ১২০তম মৌল তৈরির উজ্জ্বল সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির (এলবিএনএল) গবেষক

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির (এলবিএনএল) গবেষকরা ‘টাইটেনিয়াম-৫০’ ব্যবহার করে মহাবিশ্বের তৃতীয় ভারী মৌল লিভারমোরিয়াম তৈরির নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা পরে ১২০ নম্বর মৌল তৈরির সম্ভাবনাকে আরও বাস্তবসম্মত করে তুলেছে।

একখণ্ড প্লুটোনিয়ামের ওপর টাইটেনিয়াম রশ্মি ফেলে লিভারমোরিয়াম মৌল তৈরি করেছেন গবেষকেরা। আগে কখনো এ ধরনের পরীক্ষায় টাইটেনিয়াম মৌল ব্যবহৃত হয়নি। কারণ এর বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং নতুন পরমাণু তৈরি করতে অসংখ্যবার সংঘর্ষের প্রয়োজন হয়। পদার্থবিদরা তবু বিশ্বাস করেন, এটিই তাত্ত্বিকভাবে ১২০তম মৌল তৈরির সবচেয়ে ভালো উপায়। ১২০তম এ মৌলের নাম দেওয়া হয়েছে আনবিনিলিয়াম। এর নিউক্লিয়াসে থাকবে ১২০টি প্রোটন। গবেষকেরা গত ২৩ জুলাই ইলিনয়ের আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে অনুষ্ঠিত নিউক্লিয়ার স্ট্রাকচার ২০২৪ সম্মেলনে এ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেছেন।

৪. নভোচারীদের জন্য নতুন স্পেসস্যুট

মহাকাশে মানববসতি স্থাপনের লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন। তেমনই এক অভূতপূর্ব প্রযুক্তি মহাকাশচারীদের জন্য এই নতুন স্পেসস্যুট। এটি মূত্র থেকে পানি তৈরি করতে সক্ষম। নভোচারীরা দীর্ঘদিন ম্যাক্সিমাম অ্যাবজর্ভেন্সি গার্মেন্টস (ম্যাগ) স্যুট ব্যবহার করে অস্বস্তি এবং স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। তবে নতুন এই স্যুটে সে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। মহাকাশে আগেও মানুষ প্রস্রাবকে পানিতে পরিণত করতে পারত। তবে সে যন্ত্র থাকত নভোযানে। এখন প্রতিটা স্পেসস্যুটেই থাকবে এই যন্ত্র। অনেকটা ডুন মুভির মতো। এই মুভিতে দেখানো হয়েছে, ফ্রিম্যানরা একধরনের পোশাক পরে, যা তাদের শরীরের পানি ব্যবহার করে খাবার ও পানি তৈরি করে দেয়। অনেকটা সেরকম স্যুটই তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েইল কর্নেল মেডিসিন ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। স্পেসস্যুটটা ৩৮ সেন্টিমিটার লম্বা, ২৩ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ২৩ সেন্টিমিটার উঁচু। ওজন প্রায় ৮ কেজি। নভোচারীদের পিঠে বহনের জন্য তুলনামূলক ছোট ও হালকা। নাসা ২০২৬ সালে আর্টেমিস ৩ মিশনে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মানুষ পাঠানোর চেষ্টা করছে। তাই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে প্রতিনিয়ত উন্নত করা হচ্ছে স্পেসস্যুট।

৫. মঙ্গলের মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে যে উদ্ভিদ

সিনট্রিচিয়া ক্যানিনারভিস

বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন, লাল গ্রহ মঙ্গল একদিন সবুজ অরণ্যে পরিণত হবে। সেই স্বপ্ন সম্ভবত এবার পূরণ হতে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এমন এক অবিশ্বাস্য মসবর্গীয় উদ্ভিদের সন্ধান পেয়েছেন, যা মঙ্গলের কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারবে। উদ্ভিদটি পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের মোহাবি মরুভূমিতে। এটি ছোট উদ্ভিদ হলেও কঠিন ও বিরূপ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। পৃথিবীর অনুর্বর শিলাকে উর্বর মাটিতে পরিণত করেছে এই উদ্ভিদ। বিজ্ঞানীদের মতে, মঙ্গল গ্রহের পাথুরে পৃষ্ঠ ও শুষ্ক মাটিতে এই উদ্ভিদ প্রাণের সূচনা করতে পারে। এর নাম ‘সিনট্রিচিয়া ক্যানিনারভিস’। অনেক জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে থাকতে পারে এ উদ্ভিদ। চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষকেরা ল্যাবরেটরিতে মঙ্গলের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করে এর বেঁচে থাকার ক্ষমতা পরীক্ষা করছেন। সেই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে দ্য ইনোভেশন জার্নালে।

৬. যেভাবে ধ্বংস হবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন

স্পেসএক্স এর ড্রাগন স্পেসশিপ

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। কারণ এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তাই নিরাপদে স্টেশনটি ধ্বংস করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্পেসএক্সকে। এতে প্রায় খরচ হবে ৮৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ১৭ জুলাই এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে নাসা। পরিকল্পনা অনুযায়ী স্পেসএক্সের অত্যন্ত শক্তিশালী ড্রাগন স্পেসশিপ ব্যবহার করে এ স্টেশনকে মহাকাশের নির্দিষ্ট কক্ষপথ থেকে বের করে পৃথিবীর কোনো সমুদ্রে নিরাপদে ধ্বংস করা হবে। প্রায় ফুটবল মাঠের আকৃতির সমান এই স্টেশন যাতে কোনো জনবসতিপূর্ণ এলাকা বা জাহাজ চলাচলের পথে আঘাত না করে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা হবে।

৭. প্যারিস অলিম্পিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার

২৬ জুলাই থেকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৩৩তম অলিম্পিক গেমস। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। প্রতিটি খেলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে শুরু করে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিসহ অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে খেলার ফলাফল হচ্ছে আরও নিখুত। যেমন—স্ক্যান ‘ও’ ভিশন মিরিয়া ক্যামেরা—ডাক নাম, ওমেগা—প্রতি সেকেন্ডে ২০৪৮ পিক্সেলের ৪০ হাজার ফ্রেম ধরতে পারবে। এটি অ্যাথলেটিকস, ঘোড়দৌড়, জিমন্যাস্টিকস, গ্রেহাউন্ড রেস, রোয়িং, সাইক্লিং এবং স্পিড স্কেটিংসহ বিভিন্ন ধরনের দ্রুতগতির খেলার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ওমেগা ক্যামেরার উচ্চ সংবেদনশীল সেন্সর কম আলোতেও উচ্চ রেজ্যুলুশনের ছবি তুলতে পারে। ফলে দর্শকরা অলিম্পিক দেখতে পারছেন ৮কে রেজ্যুলুশনে। এর আগে এই উচ্চ রেজ্যুলুশনে কখনো অলিম্পিক দেখা যায়নি। তা ছাড়া দর্শকদের জন্য রয়েছে এআইনির্ভর অনুবাদক যন্ত্র। এ যন্ত্রের সাহায্যে ১৬টি ভাষা তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শোনা যাবে। এ ছাড়াও সুইমিং পুলের দুপাশের দেয়ালে টাচ প্যানেল, স্বয়ংক্রিয় থ্রিডি মডেলের মাধ্যমে ফলাফল নির্ণয়, এইচডি স্কোরবোর্ড, কোয়ান্টাম টাইমারের মাধ্যমে সময় নির্ণয়, অ্যাথলেটদের ব্যবহৃত সরঞ্জামে অত্যাধুনিক সেন্সর, অ্যাথলেটদের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষায় উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন পোশাক ব্যবহৃত হচ্ছে।

৮. বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক ফিউশন চুল্লি নির্মিত

আন্তর্জাতিক ফিউশন শক্তি প্রকল্প ফিউশন রিঅ্যাক্টর

দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে বিশ্বের বৃহত্তম ফিউশন চুল্লির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে এই অত্যাধুনিক চুল্লি আরও ১৫ বছর বন্ধ থাকবে। কারণ, ২০২০ সালে এই চুল্লির জন্য প্রায় ৫০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। তারপরেও অনেক সমস্যার কারণে কাজ বিলম্ব হয়েছে এবং খরচও বেড়েছে। এখন পর্যন্ত এই চুল্লি তৈরিতে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি খরচ হয়েছে। লাগতে পারে আরও ৫০০ কোটি ডলার। এ কারণেই কাজ ১৫ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক ফিউশন শক্তি প্রকল্প (আইটিইআর) ফিউশন রিঅ্যাক্টর

১৯টি বিশাল কয়েলের সমন্বয়ে গঠিত ‘আন্তর্জাতিক ফিউশন শক্তি প্রকল্প (আইটিইআর) ফিউশন রিঅ্যাক্টর’ একাধিক টরয়েডাল চুম্বক দিয়ে নির্মিত। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৩৯ সালের আগে এই চুল্লির পরীক্ষা শুরু করা সম্ভব নয়। এই চুল্লিতে সহযোগী দেশ হিসাবে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ৩৫টি দেশ। এতে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী চুম্বক। এটি পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের তুলনায় প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার গুণ শক্তিশালী।

৭০ বছরের বেশি সময় ধরে পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। এ চুল্লি নির্মাণের মাধ্যমে সে পথে আরও একধাপ এগোনো হলো।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: স্পেস ডট কম, সায়েন্স ডেইলি, আইএফএল সায়েন্স, নিউ সায়েন্টিস্ট, কেমিস্ট্রি ওয়ার্ল্ড, দ্য গার্ডিয়ান, ফিজিকস অর্গ, অলিম্পিক ডট কম, টেক বার্নার, লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া ও বিজ্ঞানচিন্তা