বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় নানা ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার খবরসহ বিভিন্ন ছবি প্রকাশ করা হয়। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার, ইন্টারন্যাশনাল গার্ডেন ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার, ব্রিটিশ ইকোলজি সোসাইটির বার্ষিক ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা, এন্টোমোলজিক্যাল সোসাইটি ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা, সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতাসহ আরও অনেক প্রতিযোগিতার সেরা ছবিগুলো নিয়ে সম্প্রতি ফটোফিচার প্রকাশ করেছে বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্স। সেই ছবিসহ বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তার চোখে সেরা ১০ ছবি প্রকাশিত হলো এখানে।
দক্ষিণ আমেরিকার প্যান্টানালের এক জলাভূমির কাছে ঘুরতে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের ফটোগ্রাফার ইয়ান ফোর্ড। সেখান থেকে ফিরে আসার কয়েক ঘণ্টা আগে ক্যামেরা হাতে নিজ বাসস্থানের আশপাশে ঘুরে বেড়ান তিনি। সেই অবস্থায় তাঁকে হুশিয়ার করা হয় যেন জলাভূমির দিকে না যান। কারণ, ওখানে একটা জাগুয়ারকে ঘুরতে দেখা গেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে বললে, এটি একধরনের বড় বিড়ালজাতীয় প্রাণী; তবে সত্যিকার অর্থে ওটা আসলে একধরনের বাঘ। ওই ফোন পেয়ে তিনি দ্রুত জলাভূমির দিকে যান জাগুয়ারের ছবি তুলতে। গিয়ে সেই জাগুয়ারের দেখা পান। ওটাকে অনুসরণ করেন। অনুসরণ করতে করতে একসময় চেপে বসেন নৌকায়। নৌকা ও ক্যামেরা নিয়ে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান নেন ইয়ান ফোর্ড। হঠাৎ নারী জাগুয়ারটি একটা কুমিরের ওপরে হামলা করে। ঠিক সেই মূহূর্তে এই ছবি তুলেছেন ফোর্ড। ২০২৪ সালে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ ক্যাটাগরিতে এটি সেরা ছবির মর্যাদা পেয়েছে।
আলাস্কার কাটমাই ন্যাশনাল পার্ক থেকে তোলা হয়েছে ছবিটি। একটা বাদামি ভাল্লুককে সকিয়ে স্যামন মাছ ঘিরে রেখেছে। এই মাছ রেড স্যামন নামেও পরিচিত। মাছগুলো বার্ষিক অভিবাসন থেকে ফিরে এসেছে। প্রতিবছর জুনের শুরুর দিকে প্রায় ৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক রেড স্যামন সমুদ্র থেকে ব্রিস্টল উপসাগরে ফিরে আসে। সেরকমই ফিরে এসেছে এই মাছগুলো। আর এসেই ঘিরে ধরেছে একটা ভাল্লুককে। সেই অবস্থায় ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার ব্যারেট হেজেস। ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় ‘পিপলস চয়েস’ বিভাগের সেরা ছবির তালিকায় ছিল এটি।
অসংখ্য পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে বনে। পাখির কলকাকলিতে গাছগুলো যেন দুলে দুলে যাচ্ছে। প্রথম দেখায় ছবিটি দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। এখানে যেগুলোকে পাখি মনে করছেন, সেগুলো আসলে ব্যাঙ্গাচি। মানে ব্যাঙের ছানাপোনা। আর গাছগুলো হলো শাপলা। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের একটি হ্রদে রয়েছে এই শাপলা। শাপলাপাতার নিচে পানির জগৎ দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। পাতার নিচে সাঁতার কাটছে ব্যাঙের ছানা। নিরাপদে সাঁতার কেটে হ্রদের গভীর থেকে অগভীর জায়গায় যাচ্ছে। কারণ, অগভীর জায়গায় খাবার পাওয়া যায় বেশি, শিকারিও কম। এরা সাধারণত ৪-১২ সপ্তাহের মধ্যে ব্যাঙে পরিণত হয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো, একটি ব্যাঙ প্রায় ১২ হাজার ডিম পাড়লেও এদের মধ্যে মাত্র এক শতাংশ বেঁচে থাকে। দারুণ সুন্দর এই ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী শেন গস। ‘দ্য সোয়ার্ম অব লাইফ’ শিরোনামের এই ছবি ২০২৪ সালের ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় বিশ্বসেরা ছবির মর্যাদা পেয়েছে।
সুইডেনের অ্যালেক্স ডসনের তোলা এ ছবি ২০২৪ সালে আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার পুরস্কার পেয়েছে। তিনি ছবিটি তুলেছেন গ্রিনল্যান্ডের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে। সেখানকার স্থানীয় শিকারিরা প্রায়ই তিমি শিকার করে। তিমির প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে কঙ্কাল আবার সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ডসন ছবিটি তুলেছেন বরফের নিচে পানিতে ডুব দিয়ে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ একটি হাতির দাঁত থেকে আঙুলের ছাপ নিচ্ছেন। যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্ধর থেকে এই ছবি তুলেছেন ফটোগ্রাফার ব্রিটা জ্যাসচিনস্কি। আসলে এখনো প্রচুর বন্যপ্রাণীর দাঁত ও চামড়া বিদেশে চোরাচালান হয়। সেগুলো ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা। হাতির দাঁত থেকে মানুষের হাতের ছাপ সাধারণত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ম্লান হয়ে যায়। তবে যুক্তরাজ্যের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা একটা যুগান্তকারী কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। এই কৌশলের মাধ্যমে কয়েক মাস পরেও হাতের ছাপ শনাক্ত করা যায়। ২০২৩ সালে এমন কয়েক হাজার চোরাচালান বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো দাঁতটি একটা আফ্রিকান হাতির। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্যমতে, হাতির দাঁতের জন্য প্রতিদিন গড়ে ৪০টি আফ্রিকান হাতি হত্যা করা হয়। সেই চোরাচালান বন্ধ করতেই পুলিশের এই ব্যবস্থা। ২০২৪ সালে বিগ পিকচার ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় ‘হিউম্যান অ্যান্ড নেচার’ বিভাগে এটি সেরা ছবির তালিকায় ছিল।
মাছ একটা, পাখি দুটি। ওই মাছ নিয়েই নর্দান গ্যানেটস পাখিদের মধ্যে শুরু হয়েছে লড়াই। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক পাখি এই গ্যানেটস। ডানাসহ এরা প্রায় ৬ ফুট লম্বা হয়। ৯৮ ফুট ওপর থেকে মাছকে অনুসরণ করে শিকার করে। ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার ট্রসি লুন্ড। স্কটল্যান্ডের একটা দ্বীপপুঞ্জে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মাথার ওপর অনেকগুলো গ্যানেটস পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ দুটি পাখি একই মাছকে অনুরসরণ করে ঝাঁপ দেয়। সৌভাগ্যবশত তখন ছবিটি তুলতে পেরেছিলেন ট্রসি লুন্ড। ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড নেচার ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ডসে গ্র্যান্ড প্রাইজ জিতেছে এই ছবি।
ওশান ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার ২০২৪ প্রতিযোগিতায় ওশান পোর্টফোলিও ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন ফটোগ্রাফার শেন গ্রস। এই ছবিতে বড় চোখের শিশু প্লেইনফিন মিডশিপম্যান মাছ দেখা যাচ্ছে। মাছগুলো এখনো কুসুমের থলির সঙ্গে আটকে আছে। এ মাছ রাতে প্রচণ্ড আওয়াজ করে। একসঙ্গে অনেকগুলো মিডশিপম্যান মাছ থাকলে এদের আওয়াজ আপনি বহুদূর থেকে, এমনকি কাছাকাছি এলাকায় বাসা হলে, সেখানে বসেই টের পাবেন। সাধারণত প্রজনকালে এরা বেশি আওয়াজ করে। ছবিটি তোলা হয়েছে কানাডা থেকে।
ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই, এখানে কে শিকারি আর কে শিকার। সাধারণত বড় প্রাণীই ছোটটাকে শিকার করে। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। জার্মানির একটা জঙ্গল থেকে ছবিটা তুলেছেন ইঙ্গো আর্ণ্ডট। লাল কাঠের পিঁপড়ার (Formica rufa) একটি দল একটি নীল গ্রাউন্ড বিটলকে ঘিরে ধরেছে। সাধারণত এই পিঁপড়া ছোট এফিড পোকা খায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে নিজেদের চেয়ে বড় পোকাও ধরে। কারণ, এসব পিঁপড়া অনেক শক্তিশালী। ২০২৪ সালে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় ‘উইনার অব বিহেভিয়ার’ ক্যাটাগরিতে ছবিটি সেরা হয়েছে।
ফটোগ্রাফার ড্যানি থম্পসন ফুলসহ গাছের এই ছবি তুলেছেন। একটাই গাছ, ফুল অনেকগুলো। কিন্তু প্রতিটি ফুলের বয়স আলাদা। দেখে মনে হয়, একটিই ফুল; ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ইকুয়েডরের উঁচু পাহাড়ি জঙ্গলে হাঁটার সময় অ্যাবুটিলন মেগাপোটামিকাম নামের এই সুন্দর ফুলটি দেখতে পান। ব্রিটিশ ইকোলজি সোসাইটির বার্ষিক ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় সব ক্যাটাগরি মিলিয়ে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছে এটি।
একটি ফুটবল পাড়ি দিয়েছে বিশাল অতলান্তিক সমুদ্র। দীর্ঘ এ পথে এর সঙ্গী ছিল অজস্র সাদা শামুক। এই শামুকগুলো ‘গুজ বার্নাকল’ নামে পরিচিত। ফুটবলটি সমুদ্রযাত্রা শেষে গিয়ে পৌঁছায় দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ডরসেট কাউন্টিতে, ইংলিশ চ্যানেলের জুরাসিক কোস্ট বা উপকূলে। সে সময় এ অসাধারণ দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করেন রায়ান স্টকার।তিনি ছবিটির নাম দিয়েছেন ‘ওশেন ড্রিফটার’। তাঁর এ ছবিটিই ২০২৪ সালের ব্রিটিশ ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।