চন্দ্রজয়ীদের ঢাকা বিজয়

আজ ২৭ অক্টোবর। আজ থেকে প্রায় ৫৪ বছর আগের কথা। চন্দ্র বিজয়ীরা এয়ারফোর্স ওয়ানে চড়ে এসে নামলেন ঢাকায়। তাঁরা কালজয়ী তিন পুরুষ—নীল অলডেন আর্মস্ট্রং, এডউইন ইউজিন বাজ অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের সহধর্মিণীরা। তাঁরা চন্দ্র বিজয়ী। নানা সংবর্ধনা, র‍্যালি ও সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অজস্র মানুষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছায় তাঁরা ফিরে যান। সেই অবিস্মরণীয় ঘটনার বর্ণনা পড়ুন...

১৯৬৯ সালের ২৭ অক্টোবর, তেজগাঁও বিমানবন্দর। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে অ্যাপোলো ১১-এর তিন চন্দ্র বিজয়ী ও তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’ বিমানটি ঢাকার মাটি স্পর্শ করল। বিমানবন্দরের বিমান ভবন, টারমাক ও আশপাশের উপস্থিত হাজারো উত্ফুল্ল জনতা নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে ছুটে চলল বিমানের দিকে। নভোচারীদের সফরসঙ্গী বি বার্নস এই ‘কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার অভিজ্ঞতা’ সম্পর্কে বলেন—

 ‘আমরা যখন বিমানাঙ্গনের দিকে এগোচ্ছিলাম, তখন বিমানবন্দরে নভোচারীদের দেখার জন্য অপেক্ষমান জনতাকে দেখা যাচ্ছিল। নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের বিমানের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিতে হলো, কারণ জনতা সব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে বিমানাঙ্গনের দিকে দৌড়ে আসতে থাকে। যেহেতু আমরা টার্মিনাল পর্যন্ত যেতে পারলাম না, তাই হোটেল পর্যন্ত আমাদের শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার জন্য মোটরগাড়িগুলোকে বিমানের কাছে পাঠানো হলো। দিনটি ছিল উষ্ণ। বেশ উষ্ণ।’

জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যেই প্রথমে আর্মস্ট্রং ও তাঁর পেছনে অলড্রিন, কলিন্স, মিসেস কলিন্স ও মিসেস অলড্রিন বিমান থেকে নেমে আসেন। আর্মস্ট্রংয়ের পরনে ছিল পীত বর্ণের স্যুট, কলিন্সের অনেকটা সাদা এবং অলড্রিনের ধূসর বর্ণের। মিসেস আর্মস্ট্রং অসুস্থ থাকায় তিনি বিমানেই অবস্থান করেন। প্লেন থেকে নেমে এলে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য সচিব শফিউল আজম ও প্রধান প্রটোকল অফিসার ইশরাত হোসেন অতিথিদের স্বাগত জানান। ছোট ছোট মেয়ে অতিথিদের ফুলের মালা ও তোড়া উপহার দেয়। বিশেষ বিমান থেকে অতিথিদের গাড়ি পর্যন্ত লালগালিচা বিছানো ছিল। গালিচার পাশে দাঁড়ানো ছিলেন শহরের গণ্যমান্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিরা, মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জেমস ডব্লিউ স্পাইক ও ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল লেসলি অ্যালবিয়ন স্কোয়ার্স। পাকিস্তানের অনেক মার্কিন নাগরিকও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।

হাজারো মানুষের ঢল নামে ঢাকার রাজপথে। চন্দ্র বিজয়ীদের সঙ্গে হাত মেলাতে চায় উৎসুক জনতার অনেকে

প্রজেক্ট জায়ান্ট স্টেপ

১৯৬৯ সালের ২৪ জুলাই অ্যাপোলো ১১-এর তিন নভোচারী লে. কর্নেল নীল এ আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন ই অলড্রিন চন্দ্রজয় করে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। মহাশূন্যে বা চাঁদে অবস্থানকালে নভোচারীদের শরীরে কোনো রোগ সংক্রমণ হলো কি না, তা পরীক্ষা ও প্রতিরোধের জন্য এর পরের ২১ দিন তাঁদের রাখা হয় তীক্ষ পর্যবেক্ষণে। তার পরই শুরু হয়ে যায় চন্দ্র বিজয়ের আনন্দ উৎসব। ১৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউজ থেকে জানানো হয়, চন্দ্র বিজয়ের অভিজ্ঞতার বর্ণনা এবং আমেরিকার মহাশূন্য অভিযানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করার জন্য চন্দ্র বিজয়ীরা বিশ্বভ্রমণ করবেন। বিশ্বভ্রমণের নামকরণ করা হয় ‘প্রজেক্ট জায়ান্ট স্টেপ’।

 সফরে ব্যবহার করা হয় প্রেসিডেন্টের বিলাসবহুল বোয়িং ডিসি-১৩৭বি-সংশোধিত ৭০৭ বিমানটি, যার টেইল নম্বর ছিল ৮৬৯৭০। আমেরিকার বিমান বাহিনীর বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ বিমানের কল সাইন ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’। এ কারণে বিমানটি সবার কাছে ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’ নামেই বেশি পরিচিত। এয়ারফোর্স ওয়ানের যাত্রী ছিলেন মাত্র ছয়জন, চন্দ্র বিজয়ী তিনজন এবং তাঁদের স্ত্রীত্রয় জেনেট আর্মস্ট্রং, পেট্রিসিয়া কলিন্স ও জোয়ান অলড্রিন। সফরের সহযোগী যাত্রী ছিলেন ২১ জন, যার মধ্যে ছিলেন চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম কার্পেন্টিয়ার এবং নাসা, ইউএসআইএস ও ভয়েস অব আমেরিকার কর্মীরা। বিমানে ক্রু ছিলেন আমেরিকার বিমান বাহিনীর বাছাই করা ২৪ জন সদস্য। বিমানের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল কার্ল এ পেডেন।

 প্রজেক্ট জায়ান্ট স্টেপ শুরু হয় ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন ডিসি থেকে। এদিন চন্দ্র বিজয়ীরা তাদের প্রথম গন্তব্য মেক্সিকো সিটিতে এসে পৌঁছেন। বিভিন্ন দেশ ঘুরে ‘প্রজেক্ট জায়ান্ট স্টেপ’-এর শেষ গন্তব্য ছিল টোকিও শহরে, সেখানে তাঁরা পৌঁছেন ৪ নভেম্বর। ৫ নভেম্বর আলাস্কা হয়ে ফিরে আসেন ওয়াশিংটন ডিসি। এই ৩৮ দিনে তাঁরা সফর করেন ২৩টি দেশের ২৭টি শহর। এর মধ্যে ছিল লাতিন আমেরিকার পাঁচটি, ইউরোপের ১৩টি, আফ্রিকার একটি, এশিয়ার ছয়টি ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি শহর। সফরসূচিতে আরও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের টেরিটরি গুয়ামের রাজধানী আগানা ও আলাস্কার এলমেনড্রফ শহর।

 নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক নেন রবার্টসনের তথ্যমতে, চন্দ্র বিজয়ীরা এ সফরে ২০ জন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে মিলিত হন, ২২টি সংবাদ সম্মেলন করেন, কমপক্ষে ১০ কোটি মানুষকে দর্শন দেন, ২৫ হাজার ব্যক্তির সঙ্গে হাত মেলান, অর্জন করেন ফরাসি ‘লিজিয়ন অব অনার’ ও ‘মেডাল দ্য ভার্মেইল’, কঙ্গোর ‘অর্ডার অব দ্য লেপার্ড’, জাপানের ‘অর্ডার অব দ্য কালচার’, ব্রাজিলের ‘ন্যাশনাল অর্ডার অব দ্য সাদার্ন ক্রশ’, বেলজিয়ামের ‘ডিগ্রি অব অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব লিওগোল্ড’সহ অসংখ্য ভূষণ। উপঢৌকন হিসেবে পেয়েছেন বিটোফেনের রেকর্ড সেট (জার্মান), স্বর্ণমুদ্রা (জার্মান ও ভ্যাটিকান), স্বর্ণপদক (পাকিস্তান), ষাঁড়ের লড়াইয়ের পোশাক (স্পেন) ইত্যাদি।

ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রেডিও, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সাংবাদিকদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন চন্দ্র বিজয়ীরা।

অভ্যর্থনা ও শোভাযাত্রা

দৈনিক পূর্বদেশে ২ অক্টোবর প্রথম প্রকাশ পায় যে চন্দ্র বিজয়ীরা ২৭ অক্টোবর ঢাকা সফরে আসছেন। তাঁরা ঢাকায় এক রাত অবস্থান করে পরদিন ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। ১৬ অক্টোবর ঢাকায় চন্দ্র বিজয়ীদের সংবর্ধনার প্রস্তুতি নিয়ে প্রকাশিত সরকারি বিজ্ঞপ্তির বরাতে ১৭ অক্টোবর পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশ পায়,

 ‘চন্দ্র বিজয়ীদের যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সংবর্ধনা জানানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় এক ব্যাপক প্রস্তুতি পর্ব চলছে। অ্যাপোলো ১১-এর তিনজন নভোচারী আগামী ২৭ অক্টোবর এখানে আগমন করবেন।

 নভোচারী নেইল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স একটি মোটর গাড়ি করে ঢাকার রাজপথ অতিক্রম করবেন। এতে অধিক সংখ্যক লোক তাদের দেখতে ও সংবর্ধনা জানাতে সুযোগ পাবে।

 প্রাদেশিক চিফ সেক্রেটারি ও অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যরা বিমান বন্দরে নভোচারী ও তাদের স্ত্রীদের অভ্যর্থনা জানাবেন। তারা ঢাকায় মাত্র একদিন অবস্থান করবেন এবং সেই দিনই প্রাদেশিক গভর্নর প্রদত্ত এক সংবর্ধনায় যোগ দেবেন। চন্দ্রবীররা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করবেন।

 তাদের দেখার উদ্দেশ্যে স্কুলের ছেলেমেয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। চন্দ্রবীরেরা পরের দিন ঢাকা ত্যাগ করবেন।’

 ২৬ অক্টোবর চন্দ্র বিজয়ীদের শোভাযাত্রার চূড়ান্ত প্রদক্ষিণ পথ প্রকাশ পায়। পূর্বে প্রকাশিত যাত্রাপথের কিছু কিছু অংশ ছেঁটে যাত্রাপথটিকে কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়। চূড়ান্ত প্রদক্ষিণ পথের একটি নকশাও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পায়। চূড়ান্ত প্রদক্ষিণ পথটি ছিল বিমানবন্দর থেকে পরিষদ ভবন (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) গেট, পলিটেকনিক স্কুল, কারওয়ান বাজার (কারওয়ান বাজার রেলওয়ে ক্রসিং), পাক মোটর (বর্তমানে বাংলা মোটর), শাহবাগ, জিন্না এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ), ডিআইটি এভিনিউ, দিলকুশা রোড, স্টেট ব্যাংকের সামনের রাস্তা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, মর্নিং নিউজ অফিস, তোপখানা রোড হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল।

 ২৭ অক্টোবর, চন্দ্র বিজয়ীদের ঢাকা আগমনের দিনে সব জাতীয় পত্রিকা চন্দ্র বিজয়ীদের শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানিয়ে একাধিক বিশিষ্টজনের লেখা, সম্পাদকীয় আর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বেশির ভাগ জাতীয় পত্রিকা চন্দ্র বিজয়ীদের আগমন উপলক্ষে এদিন বর্ণিল ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। ক্রোড়পত্রগুলোয় চন্দ্র বিজয়ীদের জীবনী, দাম্পত্য জীবন, চন্দ্র বিজয়ের ইতিহাস, চাঁদ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, আকাশ ভ্রমণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর রচনা প্রকাশ পায়। ক্রোড়পত্রগুলোয় চন্দ্র বিজয়ীদের স্বাগত জানিয়ে বেশ কিছু সংস্থার বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়। এর মধ্যে নাবিস্কো বিস্কুটের বিজ্ঞাপনটি অনেকের নজর কাড়ে। চন্দ্র বিজয়ীদের উদ্দেশে সেখানে লেখা ছিল—‘আমরা পারলাম না...তোমাদের চন্দ্র বিজয়ের এ দফার খাদ্যতালিকায় যুক্ত হতে! হয়তো এ অবস্থা দীর্ঘদিন এ রকম থাকবে না।’

নাবিস্কোর সেই বিজ্ঞাপন

দুপুরে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চন্দ্র বিজয়ীরা একটি খোলা শেভ্রলে গাড়িতে ওঠেন। গাড়ির ডান দিকে আর্মস্ট্রং, বাঁ দিকে অলড্রিন আর মধ্যে কলিন্স বসেন। পেছনের গাড়িতে ছিলেন নভোচারীদের স্ত্রীরা। তাঁদের পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি আর তারপর সাংবাদিকদের বাস। চন্দ্র বিজয়ীদের গাড়ির সামনে ছিল ফটোগ্রাফারদের জন্য খোলা ট্রাক।

নভোচারীদের গাড়ির মিছিল ময়মনসিংহ রোড (বর্তমান এয়ারপোর্ট রোড) ধরে যাত্রা করে। পথে সর্বত্র হাজার হাজার জনতা বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানায়। রাস্তার দুপাশের মানুষ পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা আন্দোলিত করে সংবর্ধনা জানানোর সময় অনেকে গাড়ির পাশে ছুটে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করেন। যাঁরা পথের পাশে জায়গা পাননি, তাঁরা বাড়ির দোতলা বা তিনতলার বারান্দায়, ছাদে, পাঁচিলে, এমনকি গাছে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানান। নভোচারীরাও হাত নেড়ে তাঁদের অভিনন্দন গ্রহণ করেন। এদিন ঢাকার কর্মচঞ্চল জীবন সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ হয়ে যায়। জনতা নভোচারীদের একটুখানি পরশ পাওয়ার জন্য পুলিশি বেষ্টনী ভেদ করে বহু জায়গায় তাঁদের গাড়ি ঘিরে ফেলে। কারওয়ান বাজারের কাছে এক যুবতী অলড্রিনের সঙ্গে হাত মেলাতে পেরে অপার আনন্দে রাস্তায় রীতিমতো নাচ শুরু করে দেন। কারওয়ান বাজার পেরিয়ে আরেকটু আগে গেলে আরো দুই যুবতী রাস্তার পাশ থেকে ছুটে এসে অলড্রিনের সঙ্গে হাত মেলান।

পাকিস্তান রেডিওর শাহবাগ অফিসের কাছে নভোচারীদের পত্নীদের গাড়ি বিকল হয়ে গেলে তাঁরা অন্য একটি গাড়িতে আরোহণ করেন। প্রহরায় থাকা পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য নিজেদের দায়িত্ব ভুলে দর্শকে রূপান্তরিত হওয়ায় পথের বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে মোটর শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নভোচারীদের বহনকারী গাড়িটি মূল শোভাযাত্রা থেকে কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ বিষয়ে ২৯ অক্টোবরের পূর্বদেশ লেখে—

‘তিন চন্দ্র বিজয়ী মানব প্রাচ্যের এক ক্ষুদ্র শহর ঢাকায় প্রায় দশ মিনিটের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন। ... ... আর্মস্ট্রং, অলড্রিন আর কলিন্স সোমবার বিমানবন্দর থেকে মোটর মিছিল যোগে শাহবাগের চৌমাথার নিকট এসেই তাঁরা নিখোঁজ হয়ে যান। সে সময় তাঁদের স্ত্রীদের বহনকারী গাড়িটি বিকল হয়ে পড়ায় মোটর মিছিলটি থেমে যায়। কিন্তু নভোচারীদের বহনকারী খোলা গাড়িটি থামেনি। তাঁরা সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ... ... নভোচারীদের গাড়িটি দ্রুতবেগে শহরের নির্দিষ্ট পথে ছুটতে থাকে। ... ... সে সময় তাঁদের প্রধান প্রহরীর কাজ করেছে ছয়টি স্কুটারের বারজন দুঃসাহসী যুবক। ... ... সেই স্কুটারধারী যুবকগণ বিমান বন্দর থেকেই নভোচারীদের গাড়ির পেছন পেছন আসছিল। তারা ইচ্ছাকৃতভবে কর্তৃপক্ষের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি নাকচ করে দিয়ে মোটর মিছিলের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নেয়। বহু নিষেধের পরও দুর্ঘটনার আশংকা থাকা সত্ত্বেও তারা এক স্বঘোষিত দুঃসাহসিক আনন্দাভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই হয়ে দাঁড়ায় ‘নিখোঁজ নভোচারীদের প্রহরী।’

এদিন শহরের অধিকাংশ শিক্ষায়তন অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। হাইকোর্ট থেকে পার্ক এভিনিউ ও মিন্টো রোড হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত পথে স্কুল-কলেজের ছাত্রী ও মহিলারা সুশৃঙ্খলভাবে নভোচারীদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। প্রায় ১ ঘণ্টা সফরের পর নভোচারীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে পৌঁছেন। বিমানবন্দর ও নভোচারীদের নির্দিষ্ট নয় মাইল পথে প্রায় দুই লাখ লোক নভোচারীদের দেখার জন্য ভিড় করেছিল বলে পূর্বদেশ-এ প্রকাশ পায়।

আসিফ সিদ্দিকী নামের একজন বাংলাদেশী একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আর্মস্ট্রং ঢাকা সফরের মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে মন্তব্য করেন—

‘আমি এখনো আমার ঢাকা সফরের কথা মনে করতে পারি, আমি যদি ভুল না করে থাকি তবে তাকে পূর্ব পাকিস্তান বলা হতো। হয়তো কখনো ঘটে থাকতে পারে তবুও কদাচিৎ, আপনি যে মোটর শোভাযাত্রার কথা উল্লেখ করলেন তা দেখার জন্য জনতার মধ্যে একধরনের প্রবল উৎসাহ লক্ষ করেছি।’

পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রার ওপর ভিত্তি করে আধা ঘণ্টার প্রোগ্রাম সরাসরি টেলিকাস্ট করে।

চন্দ্র বিজয়ীদের সংবর্ধনা দিতে রাস্তায় ঢল নামে মানুষের। স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে স্বাগত জানায় তাঁদের।

কর্মব্যস্ত সময়

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছানোর পর নভোচারীরা আনুমানিক আড়াইটার সময় হোটেলেই পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। ১ ঘণ্টার এ সভায় নভোচারীরা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। সভায় চন্দ্রাবতরণের একটি প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়, বিভিন্ন পর্যায়ে নভোচারীরা ছবির ধারাবিবরণী দেন। দৈনিক ইত্তেফাক এ সম্মেলনকে ‘ঢাকার ইতিহাসে বৃহত্তম সংবাদ সম্মেলন’ বলে উল্লেখ করে। সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্ন-

উত্তর নিয়ে ২৯ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাক-এ একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। ঢাকায় সংবর্ধনা সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরটি ছিল এ রকম—

‘প্রশ্ন: পাকিস্তানের এই অঞ্চল সফর এবং চন্দ্র অভিযান সম্পর্কিত ছবি প্রদর্শনের জন্য এই দেশের সাংবাদিকদের পক্ষ হইতে আমরা উপস্থিত সাংবাদিকরা আপনাদের—মানবজাতির কৃতী সন্তানদের—কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি। আমাদের জনগণ আপনাদের যে সম্বর্ধনা জানাইয়াছে, সে সম্পর্কে আপনাদের মনোভাব কি?

উত্তর: সর্বত্রই উৎসাহী জনতার সাক্ষাৎ পাইলেও আমাদের সফরের পথে কোথাও জনতার মধ্যে এত উদ্দীপনার পরিচয় পাই নাই। ঢাকার জনগণ আমাদের যে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানাইয়াছেন, উহাতে আমরা মুগ্ধ হইয়াছি। পরে গভর্ণরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হইতে পারিয়া আমরা আরও খুশি হইব। অবশ্যই ইহা এই দেশে আমাদের সর্বশেষ সফর হইবে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এ সফর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। অ্যাপোলো ১২-এর ব্যাপারে আমাদের ১৪ই নভেম্বরের মধ্যে ফিরিয়া যাইতে হইবে। সে কারণেই আমরা সমস্ত কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করিতে বাধ্য হইয়াছি। তবে আজ এখানে আসিতে পারাটা আমাদের কাছে আনন্দদায়ক হইয়াছে—আমরা এই দিনটিকে প্রাণ ভরিয়া বরণ করিয়া নিতেছি।

সংবর্ধনা

বিকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) চন্দ্রবিজয়ী ও তাঁদের পত্নীদের সংবর্ধনা জানান। গভর্নর হাউজের উত্তরের খোলা চত্বরে এ আড়ম্বর ও জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসক লে. জেনারেল শাহেবজাদা ইয়াকুব খান, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা, রাজনৈতিক, শ্রমিক ও ছাত্রনেতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বয়স্কাউট ও গার্ল গাইডস এবং শহরের বিশিষ্ট নাগরিকরাসহ কয়েকশ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। গভর্নর হাউজের উত্তরের বারান্দা থেকে মাঠ পর্যন্ত চন্দ্রবিজয়ীদের প্রবেশপথে লালগালিচা বিছানো হয়। ফ্যানফেয়ারের মাধ্যমে নভোচারীদের আগমনবার্তা জানানো হলে মহিলা ও শিশুরা গালিচার দুপাশে এসে দাঁড়ান।

গভর্নর সমভিব্যাহারে নভোচারী ও তাঁদের পত্নীরা খোলা প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছলে সবাই দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানান। প্রথমে গভর্নর নভোচারীদের উদ্দেশে স্বাগত ভাষণ দেন। ভাষণ শেষে পূর্ব পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে তিনি নভোচারীদের একটি করে স্বর্ণপদক উপহার দেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে নভোচারীদের পত্নীদেরও প্রীতি উপহার দেওয়া হয়। এরপর নভোচারীরা বক্তব্য দেন। বক্তৃতা শেষে আর্মস্ট্রং গভর্নরকে চাঁদে রেখে আসা একটি ডিস্কের রেপ্লিকা ডিস্ক উপহার দেন। চাঁদের পিঠে রেখে আসা মূল ডিস্কটিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানসহ ৭৩ জন বিশ্বনেতার বাণীসহ স্বাক্ষর ছিল। ডিস্কের লেখাগুলো খুব ছোট হওয়ায় তা পড়ার জন্য কলিন্স গভর্নরকে একটি আতশি কাচ দেন। অলড্রিন গভর্নরকে চাঁদে রেখে আসা নিক্সন, আর্মস্ট্রং, কলিন্স ও তাঁর নিজের স্বাক্ষর করা বাণীর একটি নকল দেন। পরবর্তী সময়ে গভর্নর এবং নভোচারী ও তাদের পত্নীরা অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের মধ্যে ঘুরে বেড়ান। অনুষ্ঠান চলাকালে নেপথ্যে সেনাবাহিনীর বাদক দল জনপ্রিয় কিছু সুর বাজাতে থাকে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক, তিন নভোচারীকে তাঁদের পক্ষ থেকে একটি করে রৌপ্যপদক উপহার দেয়। পদকে উত্কীর্ণ ছিল, ‘এটা একজন মানুষের ছোট পদক্ষেপ হলেও গোটা মানবজাতির জন্য বিরাট উত্তরণ।’ হাবিব ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘এই সামান্য উপহার হাজার হাজার হাবিবিয়ানের অন্তর নিঃসৃত প্রীতি ভালোবাসার প্রতীক।’

সংবর্ধনা শেষে চন্দ্রবিজয়ীরা ফিরে আসেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এবং রাত যাপন করেন।

সহধর্মিণীরাও ছিলেন ব্যস্ত

দুপুরে যখন নভোচারীদের সঙ্গে সাংবাদিকদের আলাপ চলছিল, তখন হোটেলের আরেকটি কক্ষে চন্দ্রবিজয়ীদের স্ত্রীদ্বয় (মিসেস আর্মস্ট্রং ব্যতীত) পূর্ব পাকিস্তানের ৩০ জন মহিলা সাংবাদিকের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপচারিতায় মগ্ন হন। অনুষ্ঠানের শুরুতে ঢাকায় ইউএসআইএসের পরিচালক ব্রায়ান বেলের স্ত্রী মিসেস সুই বেল উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে নভোচারীদের স্ত্রীদ্বয়কে পরিচয় করিয়ে দেন। আলাপচারিতার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল—

মিসেস প্যাট্রিসিয়া কলিন্স ও মিসেস জোয়ান অলড্রিন গত সোমবার ঢাকায় এক ঘরোয়া সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৩০ জন সাংবাদিকের স্ত্রী ও মহিলা সাংবাদিকদের কাছে মহাশূন্যচারীদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে ও মহাশূন্য অভিযানকে নভোচারীদের স্ত্রীরা কোন দৃষ্টিতে দেখেন, তার বর্ণনা দেন। মিসেস জ্যানেট আমস্ট্রং কিছুটা অসুস্থ ছিলেন বলে এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।

নভোচারীদের রাত্রিনিবাস

চন্দ্রবিজয়ীদের ঢাকায় অবস্থান ও রাত্রিযাপনের জন্য সে সময়ের একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল, ১১ তলাবিশিষ্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে বেছে নেয়া হয়। হোটেলের মোট ২৯৬টি কামরার মধ্যে ৬৭টি চন্দ্রবিজয়ী ও তাদের সফরসঙ্গীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। চন্দ্রবিজয়ীদের কামরাগুলোকে হিউস্টনে তাদের বাসগৃহের পরিবেশে সাজানো হয়। স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা ছবিও কক্ষসজ্জায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চন্দ্রবিজয়ীদের মাত্র একদিনের খাওয়ার প্রস্তুতির জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ মার্কিন ও ইউরোপীয় পাচকের ব্যবস্থা করে, তবে খাদ্যতালিকায় পাশ্চাত্য মেনুর পাশাপাশি উপমহাদেশীয় মেনুও রাখা হয়।

সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তান চন্দ্রবিজয়ীদের ঢাকা সফরের ওপর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে।

বিদায়

পরদিন সকালে নভোচারীরা ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।

বিদায়কালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দর পর্যন্ত রাস্তার দুধারে প্রায় ১০ হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। নভোচারীরা তাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তারা উল্লাস করে। বিমানবন্দরেও সহস্র জনতার ঢল নামে। বিমানবন্দরের টার্মিনাল বিল্ডিংসহ সর্বত্র জনতা ভিড় জমায়। বিদায় অনুষ্ঠানে তিনজন শিশুকে চন্দ্রবিজয়ীদের সাজে সজ্জিত হয়ে নভোচারীদের সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা যায়।

 অটোগ্রাফশিকারিদের জন্য প্রথম দিনটি ছিল অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। তাদের পক্ষে নভোচারীদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করা, চন্দ্রবিজয়ের চেয়েও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। সেদিন বিমানবন্দর থেকে শুরু করে গভর্নর হাউজের অনুষ্ঠান পর্যন্ত সব জায়গাতেই অটোগ্রাফশিকারিরা নভোচারীদের ঘিরে ধরেছিলেন। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই ছিলেন। কিন্তু তারা কোথাও সুবিধা করতে পারেনি। নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা অটোগ্রাফপ্রার্থীদের চন্দ্রবিজয়ীদের ধারে-কাছে আসতে দেননি। পরের দিন নভোচারীরা যখন ঢাকা ত্যাগ করছিলেন, তখন কয়েকজন অটোগ্রাফশিকারি সফলতার মুখ দেখেন। তবে অটোগ্রাফ লাভে ভাগ্যবানদের বেশির ভাগই ছিলেন নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিযুক্ত। নভোচারীরা অটোগ্রাফ দিচ্ছেন দেখে একটি আট-নয় বছরের বালক তার অটোগ্রাফের খাতা হাতে করে বিমানের সিঁড়ির কাছে জায়গা করে নিতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু সরকারের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বালকটিকে কয়েকবার নিরস্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি যতবারই বালককে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন, ততবারই সে মানুষের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে। বালকের এ কাণ্ড দেখে শেষে কর্মকর্তা আর তার হাসি ধরে রাখতে পারেননি।

 ২১ ঘণ্টা ঢাকায় অবস্থানের পর বিদায়কালে নভোচারীরা বলেন, ঢাকা সফরের সুযোগ লাভ করে তারা আনন্দিত হয়েছেন এবং এখানে আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা পেয়ে সম্মানিত বোধ করছেন। নভোচারী ও তাদের স্ত্রীরা সবার সঙ্গে করমর্দন করেন ও আনুষ্ঠানিক বিদায় জানিয়ে বিশেষ বিমানে আরোহণ করেন।

উপসংহার

২৭ অক্টোবর সরকারি ছুটি থাকায় ২৮ অক্টোবর কোনো পত্রিকা প্রকাশ পায়নি। ফলে চন্দ্রবিজয়ীদের আগমনের যাবতীয় সংবাদ ২৯ অক্টোবর প্রকাশ পায়।

২৭ অক্টোবরের পূর্বদেশ-এর সাংবাদিক কামাল লোহানী লিখেছিলেন—

‘ওরা তিনজন—চাঁদের মানুষ আজ ঢাকায় আসছে। ওরা অলোকের সন্তান, আসছে হেমন্তের শিশিরস্নাত এই রূপসী বাংলার বুকে।

ইতিহাসের তিনজন অবিস্মরণীয় পুরুষ, অনাবিষ্কারের শিকল ছিঁড়ে নিঃসীম শূন্যে পাড়ি জমিয়েছিল গগন অঙ্গন পেরিয়ে চিরলোকের স্বপ্নময় চাঁদের ধূলি ধূসরিত নিস্তরঙ্গ শান্তির সমুদ্রে, উড়িয়ে দিয়েছিল বিজয়-কেতন গৌরবের ওই স্বর্ণশিখরে। মানবসভ্যতার সেই দুঃসাহসী নাবিকেরা—নীল আমস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন আর মাইকেল কলিন্স বিস্ময়ের আনন্দরাশি নিয়ে আজ আসছে নদী মেঘলা ছায়া সুনিবিড় এই বাংলার বুকে।...

তোমাদের আগমন আনন্দে আকাশে আজ জোত্স্নার মেলা। মাটির এ ধরাতলে হাসির কলরোল। তাই আহ্বান জানাই সবাই মিলে—নতুন জীবন গড়ি আয়। আমরাও তোমাদের সাথে স্বপ্নীল—সোনার কামনায়।

হেমন্তের এদেশে এখন আমরা ভরবো খামার—তোমাদের তারই আনন্দে জানাই স্বাগতম, এই বাংলার মাটির বুকে। এ শুভলগ্নে নতুন পৃথিবী চায় শিল্পীর বরাভয়। নবসৃষ্টির শুভলগ্নে। তোমরা এসো এই সোনালী বাংলার বুকে, এসো জনতার মুখরিত সখ্যে, এসো দুঃখতিমির ভেদ করে, দুর্গম ধ্বংসের নিষ্ঠুর ভয় চূর্ণ করে, এসো প্রাণের ভুবন কর পূর্ণ। ...

ওরা তিন মানবশ্রেষ্ঠ আজ দুপুরে আসছে রাজধানীর শহর সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের এই ঢাকা নগরীতে। হাজার হাজার মানুষ আজ আকুল আগ্রহে অধীর প্রতীক্ষায় ক্ষণ গুনছে তোমাদের প্রাণভরে জানাবে অভিনন্দন, জানাবে প্রাণস্পর্শী সংবর্ধনা।’

সূত্র : চন্দ্রজয়ের ৫০ বছর, প্রকাশক : প্রথমা, প্রথম প্রকাশ : ২০১৯