চলে গেলেন জলবায়ুগবেষক সালিমুল হক

ছবি: সংগৃহীত
গত ২৮ অক্টোবর, শনিবার রাতে বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে দ্রুত রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক ৭১ বছর বয়সী এই জলবায়ুবিদকে মৃত ঘোষণা করেন।

জলবায়ুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সালিমুল হক মারা গেছেন। গত ২৮ অক্টোবর, শনিবার রাতে বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে দ্রুত রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক ৭১ বছর বয়সী এই জলবায়ুবিদকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিজ্ঞানের জগতে যেসব ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে, গত বছর খ্যাতনামা জার্নাল নেচার তার নেপথ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে শ্রেষ্ঠ ১০ বিজ্ঞানীর তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ জলবায়ুগবেষক সালিমুল হক। তিনি ধনী দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘটা ক্ষয়ক্ষতির দায় মেটাতে বাধ্য করতে সাহায্য করেছেন। গত ৬-২০ নভেম্বর মিসরের শার্ম আল শেখ শহরে একটি জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরে ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিসিএডি) পরিচালক ছিলেন। দীর্ঘ তিন দশক ধরে কাজ করেছেন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সব কটি জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সম্মানজনক ‘অফিসার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ উপাধিতে ভূষিত করে। সম্মানজনক উপাধি দেয় যুক্তরাজ্যের নর্থামব্রিয়া ইউনিভার্সিটি, নিউক্যাসেল। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে সালিমুল হকের শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

সালিমুল হকের জন্ম ১৯৫২ সালে, করাচিতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তানে কূটনৈতিক চাকরি করতেন তাঁর বাবা-মা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিলেন।

নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করা প্রয়োজন উচ্চ আয়ের দেশগুলোর। এটা অবশ্য শুধু সহায়তা নয়। জলবায়ুকর্মীদের মতে, এটা তাদের প্রাপ্য। কারণ, উচ্চ আয়ের দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এটাকে তাই ক্ষতিপূরণও বলা হচ্ছে। সে জন্য তহবিল গঠনের কথা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো এই চুক্তি করতে অন্তত ৩০ বছর সময় নিয়েছে। নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া নিয়ে আলোচনা পুরোদমে চলেছে এ সময়। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই আলোচনার অনানুষ্ঠানিক নেতা ছিলেন সালিমুল হক। বাংলাদেশি-ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানী মূলত একজন উদ্ভিদবিদ। সেই সঙ্গে ছিলেন ঢাকার আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন কেন্দ্রের পরামর্শক।

ক্ষয়ক্ষতির জন্য সাহায্য করা নয়, দূষণকারী দেশ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে—শার্ম আল শেখের জলবায়ু চুক্তির জন্ম এই ভাবনা থেকে। তিনি মনে করতেন, অর্থ যখন সাহায্য হিসাবে দেওয়া হয়, তখন সব ক্ষমতা দাতার হাতে থাকে। তাই বিষয়টিকে তিনি ক্ষতিপূরণ হিসেবেই ভেবেছেন সবসময়।

সালিমুল হকের জন্ম ১৯৫২ সালে, করাচিতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তানে কূটনৈতিক চাকরি করতেন তাঁর বাবা-মা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিলেন। একাত্তর সালে প্রথমে আফগানিস্তান হয়ে ভারতে যান তাঁরা। সেখান থেকে আসেন বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে পরিবেশগত বিপর্যয়, বিশেষ করে বন্যার ইতিহাস দীর্ঘ। সালিমুল হক ও তাঁর সহকর্মীরা সরকারকে রাজি করিয়েছিলেন, সরকারের পরিবেশ বিভাগ চালু করার জন্য।

বাবা-মায়ের কূটনৈতিক পোস্টিংয়ের কারণে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা। বিজ্ঞানকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসতেন। জৈব রসায়ন পড়ার জন্য লন্ডন যান। পিএইচডি করেন লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে। বাংলাদেশে ফিরে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)। বিসিএএস পরিবেশ নীতি নিয়ে কাজ করে।

বাংলাদেশে পরিবেশগত বিপর্যয়, বিশেষ করে বন্যার ইতিহাস দীর্ঘ। সালিমুল হক ও তাঁর সহকর্মীরা সরকারকে রাজি করিয়েছিলেন, সরকারের পরিবেশ বিভাগ চালু করার জন্য। এই বিভাগের জন্য বিসিএএসকে গবেষণা শাখা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন তাঁরা। সরকারের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক পরিচালক মির্জা শওকত আলী ২০২২ সালে বলেছেন, বিসিএএস বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশগত কর্মপরিকল্পনা লিখতে বিভাগটিকে সহায়তা করেছে।

ক্ষতিগ্রস্থ দেশকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে উচ্চ কার্বননিঃসরণকারী দেশগুলোকে রাজি করিয়ে শেষ পর্যন্ত তহবিল গঠনে সম্মতি আনা গেছে, সালিমুল হকসহ জলবায়ুকর্মীদের সাফল্য এখানেই। সালিমুল হকের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

সূত্র: নেচার ও প্রথম আলো

লেখক: সহসম্পাদক, কিশোর আলো

আরও পড়ুন