বিজ্ঞানের চোখে সবাই সমান

বৈজ্ঞানিক প্রাপ্তিকে দেশ কালের সীমানায় বাঁধতে চান অনেকে। দেখাতে চান একক অগ্রগতি হিসেবে। অথচ এসব অগ্রগতি সামগ্রিক। পিথাগোরাস, ম্যাগেলান, নিউটন বা আইনস্টাইনের পথ ধরে আজকের বিজ্ঞানচর্চা ও বৈজ্ঞানিক প্রাপ্তি সবার...

একটা সময় সৌরজগৎকেই বিশ্বজগৎ হিসেবে জানতাম। পরবর্তীকালে হাজার বছরের সংগ্রামে সৃষ্টিশীল মানবমন উন্মোচন করে, শুধু সূর্য আর সৌরজগৎ নিয়েই এ মহাবিশ্ব নয়। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই সৌরজগতের মতো ১৩ হাজার কোটি গ্রহমণ্ডল রয়েছে। আরও কোটি কোটি গ্যালাক্সি তো হিসাবের বাইরে রয়েই গেছে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, স্বল্প কিছু মানবমনের অন্তহীন সংগ্রামে এই যে আমরা এত কিছু জানতে পেরেছি, সেই মন যে মানবসম্প্রদায়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছে, যাকে আমরা সমাজ বলি, তার কতটুকু পরিবর্তন ঘটেছে? সৌরজগৎ সম্পর্কে কয়েক হাজার বছরের প্রচেষ্টায় অর্জিত সব ধারণায় যে বিকেন্দ্রীকরণের ইঙ্গিত রয়েছে, তা কি সমাজ নিতে পেরেছে?

বিকেন্দ্রীকরণ তো মানবিক পথের প্রতিফলন—সবার একজন হয়ে বাঁচা, সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। যদি নিত, তাহলে তো একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক আচরণ, ক্ষমতায় থাকার জন্য এত যুদ্ধংদেহী মনোভাব, এত ভয়ংকর হয়ে ওঠার কথা ছিল না। তাহলে কেন বিশ্বের কিছু প্রভাবশালী দেশের মধ্যে এবং ক্ষমতাবান কিছু ব্যক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রবণতা এত প্রবল হয়ে উঠছে? যেমন বছরখানেক আগে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সময় ১২ জুলাই রাত তিনটায় জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ ঘটনা পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এই উন্মোচন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। বিজ্ঞান মানেই হচ্ছে ক্রম অগ্রগতির প্রক্রিয়া; পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যুক্তিতর্কে গাণিতিকভাবে সাজানো, হঠাৎই কিছু পাওয়ার বিষয় নয়। এর ফলেই অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান নিয়ে আমরা মানুষেরা আরও গভীর চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছি। যদিও সেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবি উন্মোচনের ঘোষণার মধ্যে ছিল রাজনীতি, ছিল কর্তৃত্ববাদী আচরণ।

নীল আর্মস্ট্রংয়ের বক্তব্যে মানবজাতির পক্ষে প্রতিনিধিত্বের রেশ ছিল—একটা মানুষের জন্য ছোট পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য বিশাল পদক্ষেপ

এমন একটা ব্যাপার ১৯৬৯ সালে চন্দ্রাভিযানে ঘটেছিল। চাঁদে পদার্পণটা মানবজাতির অগ্রগতি ছিল না। শুধু ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। অবশ্য মানুষের চাঁদে যাওয়ার উদ্যোগটায় শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই থাকলেও নীল আর্মস্ট্রংয়ের বক্তব্যে মানবজাতির পক্ষে প্রতিনিধিত্বের রেশই ছিল—একটা মানুষের জন্য ছোট পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য বিশাল পদক্ষেপ।

যদি ওয়েব টেলিস্কোপ বা চাঁদে অভিযানের তথ্য ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান পদ্ধতিগতভাবে ঘটত, তাহলে সমাজগুলো হয়ে উঠত বিজ্ঞানমনস্ক। ধারণাগুলো আত্তীকরণে মানুষ সামর্থ্যবান হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা নিত, বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটত, চাঁদে অভিযানগুলোর ধারাবাহিক বিশ্লেষণ, প্রতিবেদন তুলে ধরা হতো। কিন্তু তা ঘটেনি, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক প্রাপ্তি নিজেদের একক অগ্রগতি হিসেবে দেখানো বা দেখা হচ্ছে। কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম একক রাষ্ট্রের সীমানা থেকে আসেনি; সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময় উদ্ভূত হয়েছে। সেই প্রাকৃতিক নিয়ম বা মৌলিক পদ্ধতিগুলোরও একটা ধারাবাহিক বিকাশ রয়েছে। তাকে তো রাষ্ট্রের সীমানা দিয়ে আটকে রাখা যায় না। ফলে শুধু মহাকাশ অভিযানে নয়, পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে এসব সংকীর্ণ আচরণে, প্রতিবিপরীত তথ্য ও ধারণার জালে আমরা এমনভাবে আটকা পড়ে গেছি, আমাদের বৌদ্ধিক জায়গায় বিষয়টার প্রভাব ফেলছে না। ফলে আমাদের বৈজ্ঞানিক ধারণা ও প্রাযুক্তিক অগ্রগতির সঙ্গে মানসিক সংস্কৃতির প্রবল ফারাক তৈরি হয়ে গেছে।

পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান জাহাজে গোটা পৃথিবী ঘুরে বাস্তবে প্রমাণ দেখিয়েছিলেন যে পৃথিবী গোল

সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘সৌরজগৎ: দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইতিহাস’ শিরোনামের আলোচনার বক্তৃতায় এ প্রশ্নগুলোই আমাকে আলোড়িত করেছিল। জগতের রহস্য উন্মোচনে মানুষ কীভাবে চিন্তা করেছিল? প্রাচীন মানুষদের অনেকে ভাবতেন, পৃথিবী আকারে চ্যাপটা চাকতির মতো বা একটু উত্তল, কিছু একটার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন ভারতের লোকেরা ভাবতেন, পৃথিবী একটা গোলার্ধ, ভর দিয়ে আছে চারটি দিগ্‌হস্তীর ওপর, আর দিগ্‌হস্তীগুলো দাঁড়িয়ে থাকে বিরাট একটা কাছিমের ওপর। কাছিমটি আছে জলের ওপর। আবার রুশদের ধারণা ছিল, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে তিমিদের ওপর। তিমিগুলো লেজ নাড়ালেই ভূমিকম্প। তিমিগুলো থাকে জলে। কিন্তু এই পানি কিসের ওপর আছে, ভাবলেই এক অন্তহীন প্রশ্নের সূচনা হবে। তবে মানুষের এসব উদ্ভট কল্পনা মনে হলেও পৃথিবীকে কেন্দ্রস্থলে রাখতে চেয়েছে। পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটল, টলেমির প্রকল্পেও তা–ই দেখি। যদিও এসব বিশৃঙ্খল ধারণার মধ্য দিয়ে মানুষ সুশৃঙ্খল ধারণায় পৌঁছাতে পেরেছিল। তবে নিজেকে, মানে পৃথিবীকে রাখতে চেয়েছিল থালার কেন্দ্রস্থলে। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে বলা যায়, মানব বিকাশে এই প্রবৃত্তির উদ্ভব ঘটেছে, যা এখন অসংগতি বা অসুস্থতা তৈরি করছে।

সেই সুশৃঙ্খল ধারণায় কয়েকজনের মধ্যে পিথাগোরাসের নাম এমনিই চলে আসে। জর্জ সার্টনের ভাষায়, ‘তিনি হলেন গণিতের সব যুগের অভিভাবক।’ ২ হাজার ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবী গোল; চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের ওপর পৃথিবীর বক্র ছায়া পড়ার কারণে অথবা জাহাজ স্যামস দ্বীপ থেকে দূরে সরে গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ‘পৃথিবী হলো গোল’। আমি বহু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, পৃথিবী যে গোল, তা কীভাবে বোঝা যায়? তারা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছে, ‘বই পড়ে।’ কথা হলো, আমাদের চারপাশের কোনো কিছু থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। ঢাকা শহরের কোনো জায়গা থেকে তো সম্ভবই নয়; যেখানে ভালোভাবে আকাশ দেখা যায় না প্রশস্ত খালি জায়গার অভাবে। এমনকি কংক্রিটের উঁচু ভবনের ছাদে দাঁড়িয়েও দিগন্ত দেখা যায় না, তাহলে কীভাবে সম্ভব?

পিথাগোরাসকে বলা হয় গণিতের সব যুগের অভিভাবক

তারপর খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে ইরাতোস্থেনিস পৃথিবী যে গোল, তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন, পৃথিবীর পরিধি মাপতে সক্ষম হলেন। তারপরও হাজার বছর সময় লেগে গিয়েছিল মানুষের তা স্বীকার করতে। এর একটা কারণ হচ্ছে, গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। কেননা আটকে থাকার মহাকর্ষের ধারণা তখন ছিল না। তবে ইরাতোস্থেনিসের পৃথিবী যে গোল, তা মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। পৃথিবীর সর্বত্র একই রকম। বসবাসের যোগ্য এক আবাসভূমি। এই ধারণা মানুষকে পৃথিবী প্রদক্ষিণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এতে অনেকে সাড়া দিয়েছিলেন।

তাঁদের মধ্যে পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি জীবনের বিনিময়ে পৃথিবীটাকে ঘুরেই দেখেছিলেন। দেখিয়েছিলেন তার বাস্তব প্রমাণ—পৃথিবী যে সত্যিকার অর্থেই গোল। ১৫১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ২৩৯ জনের বেশি নাবিক নিয়ে তিনি স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে যাত্রা করেন। স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে আরম্ভ করে লোহিত সাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বাঁক ঘুরে আটলান্টিক হয়ে, প্রশান্ত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে ম্যাগেলানের জাহাজ ফিরে এসেছিল মাত্র ১৮ জন নিয়ে। এই মহাভ্রমণে তিন বছর সময় লেগেছিল। ২২১ জন নাবিকের জীবনের বিনিময়ে বোঝা গেল পৃথিবী গোল, পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বসবাস। প্রকৃতিতে উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই। তবে ব্যাখ্যা করা গেল না, কেন পৃথিবী গোল।

স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে আরম্ভ করে লোহিত সাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বাঁক ঘুরে আটলান্টিক হয়ে, প্রশান্ত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে ম্যাগেলানের জাহাজ ফিরে এসেছিল মাত্র ১৮ জন নিয়ে

নিকোলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও গ্যালিলি, জোহানস কেপলার হয়ে আইজ্যাক নিউটন তাঁদের ধারণাগুলো দিয়ে আমাদের শিখিয়ে গেলেন, কেন শুধু পৃথিবীই নয়, গ্রহগুলোও গোল। কারণ, মহাকর্ষ, প্রতিটি বস্তু প্রতিটি বস্তুকে টানে, ভরের সমানুপাতে, দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে এবং গোল হওয়ার পরও আমরা পৃথিবী বা গ্রহপৃষ্ঠ থেকে পড়ে যাই না, উঁচু-নিচু বলে কোনো বাস্তবতা পৃথিবীতে নেই, সৌরজগৎ বা গ্যালাক্সিতে নেই; শুধু মানববিশ্বে আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে তা নির্মাণ করেছি। ১৯২৪ সালে হাবল এবং হুমাসনের আবিষ্কার থেকে জানা গেল, মিল্কিওয়ের মতো অসংখ্য গ্যালাক্সি মহাশূন্যে অপরিমেয় দূরত্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ১৯২২ সালের দিকে রুশ গণিতবিদ আলেক্সান্দার ফ্রিডম্যান আইনস্টানীয় মডেলকে একটি প্রসারণশীল মহাবিশ্ব ও পরাবৃত্তিক স্থান বলে অনুমোদন দেন। এসব ধারণা মহাবিশ্বকে আমাদের কাছে এমন এক জগতে পরিণত করে, যার প্রতিটা বিন্দুই প্রাণ ও প্রতিটা বিন্দু কেন্দ্র।

তবে পাঠ্যবইগুলো এ ঘটনাগুলোকে সেই অর্থে সামাজিকীকরণ না করলেও এই ধারণা যোগাযোগের জাল বিস্তারে লাভ-ক্ষতির তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করল। আমরা ক্রমেই সাংস্কৃতিক সংঘাতের পথে এগোতে থাকলাম।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

অথচ ভূকেন্দ্রিক মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, পৃথিবীকে স্থির ও কেন্দ্রে রেখে বিশ্বজগৎকে দেখা। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষের বিক্ষিপ্ত ভাবনা, অসংলগ্ন ধারণাগুলো পেছনে রেখে একটা যৌক্তিক বিন্যাস তৈরির প্রচেষ্টা। আবার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বা শুধু আমার অঞ্চলটিকে সর্বোত্কৃষ্ট ভাবার প্রবণতারও উত্স এটা।

পৃথিবী এখন নিউটন, ম্যান্ডেল, রিম্যান, আইনস্টাইন, ফ্রিডম্যান হয়ে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে বিশ্বজগৎ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। দুই হাজার বছর পার হয়ে গেছে। আমরা আধুনিক ধারণা থেকে দেখেছি, কেন্দ্র আর প্রান্তের ভীষণ ঐক্য। অথচ কী আশ্চর্য, বিশ্ব মারামারি করে চলেছে—আমিই উঁচুতে, আমারটাই শ্রেষ্ঠ, আমিই শ্রেষ্ঠ জাতির অংশ, আমিই কেন্দ্র। এর যেন শেষ নেই।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত