মানুষ কি মস্তিষ্কের মাত্র ১০ ভাগ ব্যবহার করে

হলিউডের একটি জনপ্রিয় সিনেমার নাম লুসি। পরিচালক লুক বেসন। সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্কারলেট জোহানসন।

লুসির বয়স ২৫। লেখাপড়া করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন মাফিয়াদের সঙ্গে। ড্রাগ পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয় তাঁর শরীর। মানে শরীরে ঢুকিয়ে ড্রাগ পাচার করে মাফিয়ারা। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ড্রাগের প্যাকেট শরীরের ভেতরেই ফেটে যায়। ড্রাগের প্রভাবে লুসির মস্তিষ্ক আগের তুলনায় বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে চাইলে দেখতে পায় অতীত। আর প্রতিনিয়ত ড্রাগের প্রভাবে তার অতীত দেখার ক্ষমতা বাড়তে থাকে। একসময় তার মস্তিষ্ক শতভাগ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে সে আদিম  গুহাবাসীদের জীবনযাপনও দেখতে পায়।

লুসি সিনেমার পোষ্টার
ছবি: সংগৃহীত

বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে ঘটা করে এ গল্প বোঝার কারণ বুঝে গেছেন। সাধারণ মানুষ তার মস্তিষ্কের শতভাগ ব্যবহার করতে পারে না—এটাই দেখানো হয়েছে সিনেমাটিতে। আসলে কি এ বিষয়টি সত্যি? না, সিনেমাটির মতো করে ১০০ ভাগ মস্তিষ্ক ব্যবহারের কথা বলছি না। কিন্তু কথাটা নিশ্চয়ই আপনি অনেকবার শুনেছেন—মানুষ তার মস্তিষ্কের সবটা ব্যবহার করে না। সবচেয়ে প্রচলিত কথায় বলা হয়, মানুষ নিজের মস্তিষ্কের মাত্র ১০ ভাগ ব্যবহার করে। প্রশ্ন হলো, এ কথা কি সত্যি? আমরা কি আসলেই নিজেদের মস্তিষ্কের পুরোটা ব্যবহার করতে পারি না? চলুন, বিজ্ঞানের আলোয় বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখা যাক। 

মানুষের মস্তিষ্কের গড় ওজন প্রায় ৩ পাউন্ড। মানে ১ কেজি ৩০০ গ্রামের মতো। এতটুকু মস্তিষ্কের মধ্যে আছে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন।

মস্তিষ্কের সাহায্যে মানুষ হাজারো কোটি কাজ করে। আবেগ, অনুভূতি, রাগ, ভালোবাসা—সব নির্ধারিত হয় মস্তিষ্ক থেকে। সাধারণ হাঁটা-চলার জন্যও ব্যবহার করতে হয় মস্তিষ্ক। আপনি যে এখন এই লেখাটা পড়ছেন, তাতেও আছে মস্তিষ্কের ব্যবহার। কিন্তু কতখানি মস্তিষ্ক ব্যবহার করছেন লেখাটি পড়তে? ২ ভাগ? ১০ ভাগ? নাকি আরও বেশি? আসলে আপনি মস্তিষ্কের প্রায় পুরোটা ব্যবহার করছেন। কীভাবে? বলছি।

মানুষের মস্তিষ্কের গড় ওজন প্রায় ৩ পাউন্ড। মানে ১ কেজি ৩০০ গ্রামের মতো। এতটুকু মস্তিষ্কের মধ্যে আছে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন। এই নিউরনগুলো প্রায় সব সময় সক্রিয় থাকে, এমনকি ঘুমালেও। তবে সব কটি নিউরন কখনো একই বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে না। একেক অংশের কাজ একেক রকম। যেমন মস্তিষ্কের মোটর ফাংশন কাজ করে চলাচল ও ভারসাম্য রাখতে। আবার কিছু দেখার জন্য কাজ করে মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল অংশ। কিন্তু সবগুলোই সক্রিয় থাকে বা প্রয়োজন অনুসারে সক্রিয় হয়। 

মানুষের মস্তিষ্কের থ্রিডি মডেল
ছবি: সংগৃহীত

ধরুন, সকালে চা পান করবেন। এ জন্য একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতে হবে। প্রথমে যেতে হবে পাকঘরে। পানি গরম করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় পাত্র খুঁজবেন, পানি নেবেন। কাপ ধুতে হবে। পানি গরম হলে কাপে ঢেলে নিয়ে চা বানাবেন। চিনি দেবেন কি না, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। ইতিমধ্যেই কিন্ত আপনি অনেক কাজ করেছেন। এসব কাজ করতে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ব্যবহৃত হয়।

তবে হ্যাঁ, মস্তিষ্কের পুরোটা, মানে ৩ পাউন্ডই কিন্তু সক্রিয় থাকে না। আসলে সক্রিয় থাকার সুযোগও নেই। কারণ মস্তিষ্কের যে অংশ সক্রিয় থাকে, তাকে বলে কর্টেক্স। আমাদের মস্তিষ্কের মাত্র ১৯ শতাংশ জায়গা জুড়ে আছে এই কর্টেক্স। এই জায়গাটা শুধু সক্রিয় থাকে। বাকি ৮১ ভাগ নিজের মতো করে সব সময় কাজ করে। আলাদা করে তার আর সক্রিয় হতে হয় না। 

মানুষের মাথায় আঘাত লাগলে খুব একটা সমস্যা হয় না। কারণ মানুষের ১০ ভাগ মস্তিষ্ক কাজ করে। সুতরাং ওই নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া অন্য কোথাও আঘাত লাগলে ভয়ের কিছু নেই।

মস্তিষ্ক জিনিসটাই খুব রহস্যময়। না, এটা মন গড়া কথা নয়। বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের পুরোটা এখনো ব্যাখ্যা করতে পারেননি। রহস্যময় না বলে উপায় আছে! কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। মানুষ মস্তিষ্কের মাত্র ১০ ভাগ ব্যবহার করে, এই মিথ চালু হলো কীভাবে? কে চালু করল?

কয়েকটি ধারণা প্রচলিত আছে। এক এক করে বলি। যুক্তরাষ্ট্রের লেখক ডেল কার্নেগির জনপ্রিয় বই হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল। বইটি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর সর্বাধিক বিক্রিত বই। এই বইয়ের প্রস্তাবনায় কার্নেগি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক উইলিয়াম জেমসের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন। ‘মানুষের মস্তিষ্ক গড়ে ১০ শতাংশ বিকশিত হয়।’

হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

বলা বাহুল্য, তাঁর এ ধারণা ভুল। এ ব্যাপারে বাল্টিমোর জন হপকিন্স স্কুল অব মেডিসিনের নিউরোলজিস্ট ব্যারি গর্ডনের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, ‘১০ শতাংশের ব্যাপারটি শুধু ভুলই নয়, হাস্যকরও বটে। মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে কোনো কাজই করা সম্ভব নয়।’

কথা হলো, উইলিয়ামস জেমসের এই বাণী কোথায় পেলেন ডেল কার্নেগি? সে আরেক মজার গল্প। ১৯০৮ সালের ঘটনা। উইলিয়াম জেমস দ্য এনার্জিস অব মেন বইয়ে ওই লাইন লিখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ চেষ্টা করলে আরও মেধাবী হতে পারে। তবে মানুষের মস্তিষ্কে কী পরিমাণ কোষ আছে, সে কথা জেমস কোথাও উল্লেখ করেননি। মস্তিষ্কের কত ভাগ জায়গা জুড়ে কর্টেক্স থাকতে পারে, সে ব্যাপারেও কিছু জানা যায় না তাঁর বই থেকে। 

তবে উইলিয়াম জেমসের এই ভুল ধারণা ডেল কার্নেগির মাধ্যমে পৌঁছে যায় অনেকের কাছে। একটা উদাহরণ দিই। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্নায়ুবিজ্ঞানী সোফি স্কট। তিনি সদ্য প্রাথমিক চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। একদিন বসকে বোঝালেন, মানুষের মাথায় আঘাত লাগলে খুব একটা সমস্যা হয় না। কারণ মানুষের ১০ ভাগ মস্তিষ্ক কাজ করে। সুতরাং ওই নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া অন্য কোথাও আঘাত লাগলে ভয়ের কিছু নেই। আঘাত লাগলেও ১০ ভাগের আর কতটুকুই-বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাকি ৯০ ভাগ তো আছেই। তাঁর বস সেটা বিশ্বাস করেছিলেন কি না, তা আর এখন জানার উপায় নেই। তবে সোফি যে ভুল ছিলেন, তা বলা বাহুল্য। কারণ মস্তিষ্কে সামান্য আঘাত লাগলেও তা গুরুতর হতে পারে। 

আইনস্টাইন কে, সেটা জানা ছিল না। কিন্তু পরে যখন বুঝতে শিখেছি, তখন কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম। স্বয়ং আইনস্টাইন বলে কথা। বিশ্বাস না করে উপায় আছে!

শেষ করার আগে এই মিথ নিয়ে আরেকটি কাহিনি বলা যাক। এটা আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা।

মস্তিষ্ক নিয়ে এই মিথ আমি শৈশবে এক শিক্ষকের মুখে প্রথম শুনেছিলাম। সেদিন সে কথা বিশ্বাসও করেছিলাম। তাঁর কথাটা ছিল অনেকটা এরকম—আইনস্টাইন তাঁর মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তাতেই তিনি কত জ্ঞানী, পৃথিবী বদলে দিয়েছেন। যদি পুরোটা ব্যবহার করতেন, তা হলে না জানি আরও কত কী করতে পারতেন। আর সে তুলনায় তোরা তো এক ভাগও ব্যবহার করছিস না। চেষ্টা কর মস্তিষ্ক আরও বেশি ব্যবহার করতে। তোরাও একদিন…।

এরকম নানা কথা বলেছিলেন তিনি। তখন যদিও অত গুরুত্ব দিইনি। আইনস্টাইন কে, সেটা জানা ছিল না। কিন্তু পরে যখন বুঝতে শিখেছি, তখন কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম। স্বয়ং আইনস্টাইন বলে কথা। বিশ্বাস না করে উপায় আছে!

আলবার্ট আইনস্টাইন
ছবি: সংগৃহীত

এখন বুঝি, স্যার বানিয়ে বলেননি। মিথটা শুনেছিলেন কোথাও। পরে আরও অনেকের মুখেই এ কথা শুনেছি। কথায় আছে, গুজব বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়ায়। এটাও যে সেরকম গুজব ছিল, তা আর বলতে।

এ গুজব পৌঁছে গিয়েছিল আইনস্টাইনের আর্কাইভ পর্যন্ত। আসলেই আইনস্টাইন এমন কোনো কথা কোনোদিন বলেছিলেন কি না, খোঁজা হচ্ছিল তা। পরে আর্কাইভ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, তাঁদের কাছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। অর্থাৎ আইনস্টাইনের নামে কেউ মিথটা চালু করেছিল। সেটা কান থেকে কান হয়ে দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের নানা কোণে। পরিণত হয়েছে কিংবদন্তিতে। 

সবশেষ কথা, মানুষ মস্তিষ্কের ১০ শতাংশ ব্যবহার করে, এটা নিছক গুজব। মানুষ সব সময় মস্তিষ্কের পুরোটাই ব্যবহার করে নানা কাজ করে। চাইলে নিজের ইচ্ছায় মস্তিষ্কের ব্যবহার বাড়ানো বা কমানো যায় না। মস্তিষ্ক তার নিজের নিয়মেই চলবে অবিরাম।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, বিবিসি ও লাইভ সায়েন্স