এপ্রিলে বিজ্ঞান জগতে নতুন কী ঘটল? দেখে নিন একনজরে

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, আমাদের ভাণ্ডারে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন তথ্য। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব হয়তো বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. চাঁদে নতুন টাইম জোন

পৃথিবীর মতো চাঁদেরও একটি একক, সর্বজনীন সময় নির্ধারণের জন্য নতুন টাইম জোন তৈরি করতে যাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ২ এপ্রিল নাসাকে এ নির্দেশ দেয় হোয়াইট হাউজ। চাঁদের নতুন এ সময়কে ডাকা হবে কো-অর্ডিনেটেড লুনার টাইম (এলটিসি) নামে। ২০২৬ সালে আর্টেমিস কর্মসূচি ও মহাকাশের অন্যান্য গ্রহের জন্য সময় নির্ধারণের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠানটি এই নতুন উদ্যোগ নেয়। নাসার পরিকল্পনা, ধীরে ধীরে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ ও মহাজাগতিক বস্তুর সময়ের জন্য একক মান নির্ধারণ করা।

আরও পড়ুন

২. বিরল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ

পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ, মেক্সিকোর মাজাটলান শহর
ছবি: রয়টার্স

৮ এপ্রিল এক বিরল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সাক্ষী হয় মানুষ। এ মহাজাগতিক ঘটনা দেখতে পান শুধু উত্তর আমেরিকার দেশ যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডার বাসিন্দারা। এটি ছিল ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। স্থায়ী ছিল ৭.৫ মিনিট। একে ‘গ্রেট নর্থ আমেরিকান ইক্লিপস’ বলা হচ্ছে। কারণ পরবর্তী পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ উত্তর আমেরিকায় দেখা যাবে ২০৭৮ সালে। অর্থাৎ আরও ৫৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে। চাঁদ পৃথিবীর ও সূর্যের মাঝে চলে এলে, সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিলে এ অবস্থা তৈরি হয়।

আরও পড়ুন

৩. সাগরে ভাসমান বিশ্বের বৃহত্তম হিমবাহ

বিশ্বের বৃহত্তম আইসবার্গ আবার গতিশীল হয়েছে। ভাসতে শুরু করেছে সাগরে। এটি লন্ডনের আয়তনের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বড়। এর আগে আইসবার্গটি কয়েক সপ্তাহ অ্যান্টার্কটিকার উপকূলে আটকে ছিল। এই তথ্য পাওয়া গেছে স্যাটেলাইট থেকে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন এ২৩এ। হিমবাহটি প্রায় ৪০০ মিটার পুরু। নাসার তথ্য মতে, এর আয়তন প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল। এটি একসময় অ্যান্টার্কটিকার ফিল্‌চনার-রনি আইস শেলফের অংশ ছিল। ১৯৮৬ সালে ভেঙে ওয়েডেল সাগরের গভীরে তলিয়ে যায়। ২০২২ সালে হিমবাহটি আবার ভেসে ওঠে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে গলতে শুরু করায় কমে যায় বরফের ওজন। তাই এটি আবার ভেসে চলতে শুরু করে। বর্তমানে এর বেগ ঘণ্টায় প্রায় ৪৮ কিলোমিটার। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে গলে যেতে পারে বিশাল এ আইসবার্গ। অথবা ছোট ছোট টুকরো হয়ে তলিয়ে যেতে পারে সমুদ্রের তলদেশে।

৪. সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক সরীসৃপের সন্ধান

বিশাল এক সামুদ্রিক সরীসৃপের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা। ইংল্যান্ডের সমুদ্রতীরে তাঁরা এটা খুঁজে পান। এ প্রজাতির প্রাণী আনুমানিক ২০২ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসর যুগে বাস করত! ধারণা করা হচ্ছে, এটি ছিল ৮২ ফুট লম্বা। বিজ্ঞানীদের ধারণা ঠিক হলে এটিই হবে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক সরীসৃপ। কারণ এটা নীল তিমির চেয়েও বড়। সম্প্রতি আবিষ্কৃত এ প্রজাতির নাম রাখা হয়েছে ‘ইথিওসর’। দেখতে অনেকটা মাছের আকৃতির। পা ছিল চারটা। সাঁতার কাটতে পারত। তবে হুট করে এ প্রাণী আবিষ্কার হয়নি। ২০১৬ সালে প্রথম প্রাণীটির মুখের চোয়াল খুঁজে পান পল ডি লা সালে নামে এক অভিযাত্রী। এরপর ধীরে ধীরে প্রাণীটির আরও জীবাশ্ম উন্মোচিত হতে থাকে। ফলে এখন প্রাণীটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে।

৫. বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ক্যামেরা

দুই দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ক্যামেরার কাজ শেষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। মূলত জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এ ডিজিটাল ক্যামেরা নির্মিত হয়েছে। লিগ্যাসি সার্ভে অব স্পেস অ্যান্ড টাইম বা এলএসএসটি (LSST) নামে এ অসাধারণ যন্ত্রটি আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। ৩ হাজার ২০০ মেগাপিক্সেল রেজ্যুলেশনের এই ডিজিটাল ক্যামেরা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এসএলএসি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরি। ক্যামেরাটি স্থাপন করা হয়েছে চিলির ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরির ভেতরে। এই টেলিস্কোপের ভেতরে রেখেই টানা ১০ বছর গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে ক্যামেরাটি। এর ওজন প্রায় ৩ হাজার কেজি। এর তোলা ছবি এত বড় হবে যে পূর্ণাঙ্গ ছবি প্রদর্শনের জন্য প্রায় ৩৭৮টি আধুনিক টিভি স্ক্রিনের প্রয়োজন হবে। ক্যামেরাটির লেন্সও বিশাল, প্রায় ১.৫৭ মিটার।

আরও পড়ুন

৬. ৭১ বছর পর দেখা গেল ডেভিল কমেট

১২পি/পন্স-ব্রুকস ধূমকেতু

প্রায় ৭১ বছর পর ফের দেখা গেল ডেভিল কমেট বা শিংওয়ালা ধূমকেতু। এটি দেখতে অনেকটা শিংয়ের মতো, তাই এমন নাম। তবে এর আসল নাম ১২পি/পন্স-ব্রুকস। গত ২১ এপ্রিল, রোববার বাংলাদেশ থেকেই এটি দেখা যায়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও বড় ছিল ধূমকেতুটি। এটা কিছুটা ক্রায়োভলকানিক ধরনের, মানে ঠান্ডা আগ্নেয়গিরির মতো। ব্যাস প্রায় ২৯ কিলোমিটার, প্রস্থ প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এতে প্রচুর গ্যাস ও বরফ রয়েছে। এ কারণেই ধূমকেতুটিকে কিছুটা সবুজ দেখায়। পৃথিবী থেকে ধূমকেতুটি আবারও দেখা যাবে ২০৯৫ সালে।

আরও পড়ুন

৭. মানবদেহে অক্সিজেন ব্যাটারি

মানবদেহের অক্সিজেন ব্যবহার করে চালিত নতুন ধরনের ব্যাটারি তৈরি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। এ আবিষ্কারের ফলে পেসমেকারসহ বিভিন্ন মেডিকেল ইমপ্ল্যান্টে ব্যবহৃত ব্যাটারি বদলাতে হবে না। বিশেষ ধরনের এ ব্যাটারি মানবদেহে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন গ্লুকোজ ও অক্সিজেন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করবে। ২৭ মার্চ বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী কেমে-তে ‘এনজাইম্যাটিক বায়োফুয়েল সেল’ নামে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।

বর্তমানে ব্যবহৃত ব্যাটারি মেডিকেল ইমপ্ল্যান্ট নিয়মিত বদলাতে হয়। ফলে বারবার অস্ত্রোপচার করতে হয় রোগীদের। এতে জটিলতা ও ঝুঁকি বাড়ে। এই ব্যাটারির প্রয়োগ শুরু হলে রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, চিকিৎসা খরচও কমবে। তবে এ গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

৮. গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণকারী অণু আবিষ্কার

প্রতীকী ছবি

একটি নতুন কণা আবিষ্কার করেছেন স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় অবস্থিত হেরিওট ওয়াট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। এটি কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ করতে পারে। এই আবিষ্কার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নেচার সিনথেসিস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এই আবিষ্কারের কথা জানা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন এ অণু কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার হেক্সাফ্লোরাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো শোষণ করতে পারে। এ গবেষণার সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল ইউনিভার্সিটি, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটন এবং চীনের ইস্ট চায়না ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা। তাঁরা কম্পিউটার মডেলিং ব্যবহার করে এই নতুন ছিদ্রযুক্ত কণার গঠন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।

৯. নাসার নতুন সোলার সেইল মহাকাশে সফলভাবে স্থাপন

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল একটি নতুন সোলার সেইল বা সৌরপাল প্রযুক্তি সম্পন্ন নভোযান উৎক্ষেপণ করেছে। নভোযানটি পৃথিবী থেকে ১ হাজার কিলোমিটার ওপরে সফলভাবে স্থাপন করা হয়েছে। পালটির দৈর্ঘ্য ৯ মিটার। ৮০ বর্গ মিটার বিস্তৃত পালটি খুলতে প্রায় ২৫ মিনিট সময় লাগে। অ্যাডভান্সড কম্পোজিট সোলার সেল সিস্টেম বা এসিএস ৩ নামের এ নভোযান চলবে সৌরশক্তি ব্যবহার করে। অনেকটা পাল তোলা নৌকার মতো করে কাজ করবে এটি। পার্থক্য হলো, বাতাসের পরিবর্তে নভোযানটি ব্যবহার করবে সৌরশক্তি।

আরও পড়ুন

১০. বাংলাদেশে নতুন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার

Anax ephippiger
ছবি: আশিকুর রহমান সমী

সম্প্রতি বাংলাদেশি গবেষকেরা তিনটি নতুন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার করেছেন। ফড়িংগুলো পাওয়া গেছে টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান, পাথরঘাটা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, চরকুকরি মুকরি ও সিলেট অঞ্চলের আন্তঃসীমানা এলাকার পাহাড়ি ছড়ায়। এগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে ফাইলোথেমিস এল্টোনি (Phyllothemis eltoni), ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি  (Elattoneura campioni)  ও অ্যানাক্স এফিপিগার (Anax ephippiger)। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের  অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান ও বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ আশিকুর রহমান সমী। 

আরও পড়ুন

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স এলার্ট, স্পেস ডটকম, নাসা, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, পোলার জার্নাল, ফিজিকস ডট ওআরজি, বিজ্ঞানিচন্তা