বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

মাত্র একজন মানুষও বদলে দিতে পারে অনেক কিছু। এর উদাহরণ গীতাঞ্জলি রাও। পানিদূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে সে, বানিয়েছে ব্যথানাশকের আসক্তি শনাক্ত করার যন্ত্র। এই কিশোর বিজ্ঞানী সবার জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা...

পেটেন্ট সার্টিফিকেট নিচ্ছেন গীতাঞ্জলি

পানিদূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শিরোপা অর্জন করে, তখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর। পড়ত সপ্তম শ্রেণিতে। ছোট্ট শিশুটির বিজ্ঞান-প্রতিভা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে সেদিন সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু গীতাঞ্জলির বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের তখন সবে শুরু।

২০১৯ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সে উদ্ভাবন করে ফেলল ড্রাগ আসক্তির পরিমাণ নির্ণয়ের নতুন পদ্ধতি ‘এপিওন’। ২০২১ সালে টেথিসের জন্য পেয়ে যায় মার্কিন পেটেন্ট। কোভিডের সময় সে ঘরে বসে তৈরি করেছে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে দুর্ব্যবহার কমানোর মোবাইল অ্যাপ ‘কাইন্ডলি’। এই অ্যাপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনলাইন মেসেজে লেখা ঘৃণাবাচক শব্দ বদলে দিতে সাহায্য করে। গীতাঞ্জলির এই অ্যাপ বর্তমানে আরও ব্যবহারোপযোগী করে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে ইউনিসেফ।

টাইম সাময়িকীর প্রচ্ছদে গীতাঞ্জলি রাও

কোভিডের সময় সারা বিশ্বের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে গীতাঞ্জলি শুরু করেছিল অনলাইনে ক্লাস নেওয়া। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ৯০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে গীতাঞ্জলি রাওয়ের ক্লাস করে অনলাইনে। ২০২০ সালে বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকীর ‘বর্ষসেরা শিশু’ শিরোপা অর্জন করে গীতাঞ্জলি রাও স্থান করে নিয়েছে সাময়িকীটির প্রচ্ছদে। ২০২৩ সালে জিতে নিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে দেওয়া ‘গার্লস লিডিং চেঞ্জ’ পুরস্কার। ১৭ বছর বয়সে ভর্তি হয়েছে বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমআইটিতে।

ভারতী রাও ও রাম রাও দম্পতি ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল অন্য সব অভিবাসীর মতোই উন্নততর অর্জন ও জীবনযাপনের লক্ষ্যে। শত পরিশ্রমের মধ্যেও তাঁদের লক্ষ্য ছিল সন্তানদের উন্নত চিন্তা ও মানবিকতায় মানুষ করা।

এই দম্পতির প্রথম সন্তান গীতাঞ্জলির জন্ম ২০০৫ সালে ওহাইও রাজ্যের কলম্বাস শহরে। এর কয়েক বছর পর দ্বিতীয় সন্তান অনিরুদ্ধর জন্ম। সন্তানদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বাড়িতে এমন পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা, যাতে একেবারে শৈশব থেকেই মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়, মানুষের সমস্যার সমাধান করার তাগিদ তৈরি হয়।

আরও পড়ুন

গীতাঞ্জলির বয়স যখন তিন, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে মা এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন নার্সিংহোমে। সেখানে সবার মন খারাপ দেখে সে মাকে প্রশ্ন করেছিল, কীভাবে সবার মন ভালো করা যায়? মা বলেছিলেন, সংগীত অনেক সময় মন ভালো করে দিতে পারে। সেই শুরু গীতাঞ্জলির পিয়ানো শেখা। নিজের জন্য নয়, অন্যকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। তখন থেকেই গীতাঞ্জলির জীবনদর্শন হয়ে পড়ে অন্যের কষ্ট দূর করা। এক বছর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে নার্সিংহোমে গিয়ে সে পিয়ানো বাজিয়ে মন-খারাপ মানুষের মন ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কয়েক বছর পর তার ছোট ভাইও বেহালা হাতে যোগ দেয় তার সঙ্গে।

পানিদূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শিরোপা অর্জন করে, তখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর।

একেবারে ছোটবেলা থেকেই সমস্যা আড়াল না করে সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সেগুলো সমাধানের পদ্ধতি খুঁজে বের করার অনুপ্রেরণা পেয়েছে গীতাঞ্জলি। তাদের খেলাধুলার মধ্যেই থাকত উদ্ভাবনী চিন্তার চেষ্টা। যেমন খাদ্যসমস্যা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বা বাসস্থানের সমস্যা—এগুলোর আদর্শ সমাধান কী হতে পারে, কীভাবে এগুলো সমাধান করা যায়। তাদের বাসায় বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের সাময়িকী কেনা হয় নিয়মিত। সেখান থেকে নতুন প্রযুক্তির খবর পড়ে গীতাঞ্জলি। বিজ্ঞান যে অনেক মানুষের কল্যাণ অনেক কম সময়ের মধ্যেই করতে পারে, তা সে বুঝতে পেরেছে অনেক ছোটবেলাতেই। তাই যেকোনো বড় সমস্যা সমাধানে তার আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চিন্তা মাথায় আসে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই তার মনে হয়, রোবট আর ড্রোন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।

যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের প্রতিভা বিকাশের জন্য অনেক রকম প্রতিযোগিতা থাকে। ‘রিডিনেস ফ্রিডম টু রিড’ রচনা প্রতিযোগিতা এ রকম একটি, যেখানে শিশুরা তাদের পড়া কোনো বই নিয়ে মতামত লিখে পাঠায়। সাত বছর বয়সে সেই রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করে গীতাঞ্জলি। তার লেখার দক্ষতায় মুগ্ধ হয় প্রতিযোগিতার বিচারকদের সবাই। এ প্রতিযোগিতার আয়োজক জেনিফার হার্টসেল স্টকডেল গীতাঞ্জলিকে বিভিন্ন ধরনের লেখার ব্যাপারে উৎসাহ জোগানো ছাড়াও বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটির সময় সৃজনশীল লেখার কর্মশালায় অংশ নিয়ে গীতাঞ্জলি লিখে ফেলে তার ছোট ভাই অনিরুদ্ধর মাকড়সাপ্রীতি সম্পর্কে একটি বই—বেবি ব্রাদার ওয়ান্ডার্স। গীতাঞ্জলি নিজেই বইয়ের জন্য ছবি আঁকল। বইটি ‘পিবিএস কিডস’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার পায়, প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে।

আরও পড়ুন
গীতাঞ্জলি রাও

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি গীতাঞ্জলির আগ্রহ দেখে অ্যাডভোকেট জেনিফার স্টকডেল গীতাঞ্জলিকে তাঁর ৪-এইচ স্টেম ফান ক্লাসে ভর্তি করে নেন। ৪-এইচ হলো তরুণদের মেধা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সংগঠন, যারা গোটা যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ লাখের বেশি শিশু-কিশোরের প্রতিভা বিকাশে নিয়মিত অনুশীলনের ব্যবস্থা করে। ৪-এইচ বলতে বোঝায় হেড (মাথা), হার্ট (হৃৎপিণ্ড), হ্যান্ডস (হাত) ও হেলথ (স্বাস্থ্য)। ৯ বছর বয়সী গীতাঞ্জলি এই ক্লাসগুলোতে মজা করতে করতে হাতে–কলমে শিখে যায় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কলাকৌশল। জেনিফার স্টকডেলের বাবা একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তিনি নিজের হাতে গীতাঞ্জলিকে শেখান কীভাবে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি কাজ করে, কীভাবে ইলেকট্রনিকস সংযোগ দিতে হয়। কিছুদিন পরই গীতাঞ্জলি এই বিদ্যা কাজে লাগায় নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে।

২০১৪ সালে মিশিগানের ফ্লিন্ট শহরের পানি সরবরাহে দূষণ দেখা দেয়। পানি বিশুদ্ধকরণ ও সরবরাহপ্রক্রিয়ার কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে খাওয়ার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত সিসা ও ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। টেলিভিশনে প্রতিদিন যখন এই সংবাদ এবং পানির সিসা ও ব্যাকটেরিয়া থেকে কী রকম বিপদ হতে পারে, তা দেখায়, তখন গীতাঞ্জলির মন খারাপ হয়। বিশুদ্ধ পানি মানুষের মৌলিক অধিকার। তাদের বাসার পানিতেও সিসা আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখেন তার বাবা। কিন্তু গীতাঞ্জলি খেয়াল করে, যে যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, সেটা অনেক বেশি সময় নেয় ফলাফল দিতে। সে ভাবতে থাকে, কীভাবে কম সময়ে পানি বিশুদ্ধ করা যায় কিংবা কত দ্রুত এ বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করা যায়।

২০১৫ সালে গীতাঞ্জলির হাতে পড়ল এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ। সেখানে সে প্রথম পড়ে কার্বন ন্যানোটিউবের কথা। এমআইটির বিজ্ঞানীরা কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার করে খাদ্যে কোনো বিষক্রিয়া হয়েছে কি না, তা বের করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন।

গীতাঞ্জলি নিজের সবটা মনোযোগ দিয়ে ভাবতে থাকে এ ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য। স্কুলের বিজ্ঞান বইয়ে সে পড়েছে, কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা খারাপ ব্যাকটেরিয়া খেয়ে ফেলে। গীতাঞ্জলি ভাবল, পানিতে সে রকম ব্যাকটেরিয়া ছেড়ে দিলে কি ওরা পানির সিসা খেয়ে ফেলতে পারবে? কিন্তু তাতেও তো সমস্যার সমাধান হবে না। পানিতে ব্যাকটেরিয়া রয়েই যাবে। ২০১৫ সালে গীতাঞ্জলির হাতে পড়ল এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ। সেখানে সে প্রথম পড়ে কার্বন ন্যানোটিউবের কথা। এমআইটির বিজ্ঞানীরা কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার করে খাদ্যে কোনো বিষক্রিয়া হয়েছে কি না, তা বের করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। খাদ্য পচে গেলে সেখান থেকে গ্যাস বের হয়। কার্বন ন্যানোটিউব সেই গ্যাস শনাক্ত করতে পারে। পচন যত বেশি, গ্যাসের পরিমাণও তত বেশি। গীতাঞ্জলির মনে হলো, কার্বন ন্যানোটিউব কি তবে পানির ভেতর কি পরিমাণ সিসা আছে, তা–ও বের করতে পারবে? কিন্তু ১০ বছর বয়সী গীতাঞ্জলি তো কার্বন ন্যানোটিউব সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। তাহলে উপায়?

গবেষণাগারে গীতাঞ্জলি রাও

৪-এইচ স্টেম ফান ক্লাস করার সময় গীতাঞ্জলি শুনেছিল ‘ডিসকভারি এডুকেশন থ্রি-এম ইয়াং সায়েন্টিস্ট চ্যালেঞ্জ’-এর কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গবেষণা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থ্রি–এম। ১৯০২ সালে মিনেসোটা রাজ্যে ‘মিনেসোটা মাইনিং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’ হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। এরপর এই ১২২ বছরে কোম্পানিটি এখন পৃথিবীর ৭০টি দেশে ২০০–এর বেশি শাখা কোম্পানি চালাচ্ছে। বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ও গবেষণায় এই কোম্পানির অবদান অনেক। লক্ষাধিক উদ্ভাবনের পেটেন্ট আছে তাদের। সারা পৃথিবী থেকে তরুণ উদ্ভাবনী প্রতিভা খুঁজে বের করে তাদের মেধাকে সত্যিকারের কাজে লাগানোর জন্য কোম্পানিটি প্রতিবছর ‘ডিসকভারি এডুকেশন থ্রি-এম ইয়াং সায়েন্টিস্ট চ্যালেঞ্জ’ আয়োজন করে। এতে অংশ নিতে প্রতিযোগীকে এক-দুই মিনিটের একটি ভিডিও বানিয়ে পাঠাতে হয়, যেখানে উদ্ভাবনের বিষয়, কীভাবে কাজ করবে, সেটা কী কাজে লাগাবে এবং দৈনন্দিন জীবনের কী সমস্যার সমাধানে তা কাজে আসবে—সেসব ব্যাখ্যা করতে হয়। গীতাঞ্জলি পানিদূষণের মাত্রা পরিমাপের জন্য তার উদ্ভাবনের ধারণা ব্যাখ্যা করে একটি ভিডিও তৈরি করে পাঠায় থ্রি-এম চ্যালেঞ্জে। বিশুদ্ধ পানির গ্রিক দেবী টেথিসের নামে সে এ যন্ত্রের নাম দেয় ‘টেথিস’।

২০১৭ সালে অন্য সব উদ্ভাবন পেছনে ফেলে গীতাঞ্জলির টেথিস হলো শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন। ১২ বছর বয়সেই গীতাঞ্জলি রাও স্বীকৃতি পেল যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের। থ্রি-এম থেকে ২৫ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হলো গীতাঞ্জলিকে।

শুরু হলো যন্ত্রের প্রোটোটাইপ তৈরির কাজ। দরকারি কার্বন ন্যানোটিউব তখনো পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের কাছে এবং রাসায়নিক কোম্পানিতে ই–মেইল করেও তেমন সাড়া পায়নি সে। ১১ বছরের বাচ্চা মেয়ের ই–মেইলের গুরুত্ব নেই কারও কাছে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী নয় গীতাঞ্জলি। ইউটিউব ভিডিও দেখে শিখে ফেলল মাইক্রোকন্ট্রোলার কীভাবে কাজ করে। কার্বন ন্যানোটিউব যদি পানির মধ্যে সিসার উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে, তাহলে রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যাবে, কমে যাবে বিদ্যুৎ-প্রবাহের মান। মাইক্রোকন্ট্রোলারের মাধ্যমে সেই সংকেত পাঠানো যাবে মোবাইল অ্যাপে। কিন্তু কার্বন ন্যানোটিউব পাওয়া যায়নি তখনো।

হতাশ হতে শেখেনি গীতাঞ্জলি। সে জানে, অনবরত চেষ্টার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা যায়। সেই সময় থ্রি-এম থেকে ফোন এল। পাঁচ শতাধিক উদ্ভাবনের আইডিয়ার মধ্য থেকে গীতাঞ্জলির টেথিস প্রজেক্ট ফাইনাল রাউন্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, কার্যকর প্রোটোটাইপ তৈরির জন্য গীতাঞ্জলিকে সব ধরনের সহযোগিতা করার ব্যবস্থাও করা হলো। তাকে বৈজ্ঞানিক কাজ শেখানোর জন্য থ্রি-এম করপোরেট ম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী ড. ক্যাথলিন স্যাফার দায়িত্ব নিলেন।

গীতাঞ্জলিরা তখন কলোরাডো রাজ্যে চলে এসেছে। সেখানে নতুন স্কুলে একটি থ্রি-ডি প্রিন্টার ছিল। সেটা ব্যবহার করে টেথিসের কভার তৈরি করা হলো। ড. স্যাফারের সহযোগিতায় ভারমন্টের একটি কোম্পানির কাছ থেকে কেনা হলো বিশেষ ক্লোরাইড মেশানো কার্বন ন্যানোটিউব, যেগুলো পানির সিসা শনাক্ত করতে পারে। দীর্ঘ এক বছরের অনবরত চেষ্টার পর তৈরি হলো কার্যকর টেথিস।

২০১৭ সালে অন্য সব উদ্ভাবন পেছনে ফেলে গীতাঞ্জলির টেথিস হলো শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন। ১২ বছর বয়সেই গীতাঞ্জলি রাও স্বীকৃতি পেল যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের। থ্রি-এম থেকে ২৫ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হলো গীতাঞ্জলিকে। পেটেন্টের জন্য দরখাস্ত করা হলো। ২০২১ সালে মার্কিন প্যাটেন্ট লাভ করে গীতাঞ্জলির টেথিস। পেটেন্ট নম্বর ১১০৮৫৯০৭।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের পুরস্কার পাওয়ার পর বিখ্যাত হয়ে ওঠে গীতাঞ্জলি রাও। বিভিন্ন দেশের তরুণদের অনুপ্রেরণার অন্যতম নাম হয়ে ওঠে সে। মার্ভেল কমিকস কোম্পানি তাদের মার্ভেল হিরো সিরিজের প্রথম বই করে গীতাঞ্জলি রাওকে নিয়ে। বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকী ২০২০ সাল থেকে চালু করে ‘বর্ষসেরা শিশু’ নির্বাচন। শিক্ষা, বিজ্ঞান, সামাজিক সমস্যার সমাধানসহ নানা বিষয়ে শিশু-কিশোরদের উদ্যোগ ও অর্জনকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাময়িকীটি প্রথমবারের মতো এ প্রকল্প চালু করে। প্রতিযোগিতায় গীতাঞ্জলিকে মনোনয়ন দেয় মার্কিন পেটেন্ট অফিস। পাঁচ হাজারের বেশি মনোনয়ন থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ২০২০ সালের বর্ষসেরা শিশু নির্বাচিত হয় গীতাঞ্জলি রাও। টাইম সাময়িকীর পক্ষ থেকে সে সময় তার সাক্ষাৎকার নেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী ও জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।

ফ্লিন্ট শহরের পানিদূষণ সমস্যা মিটে গেলেও পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নেই। গীতাঞ্জলির উদ্ভাবন সেসব দেশে কাজে লাগছে।

টেথিসের পর গীতাঞ্জলি নতুন প্রকল্প শুরু করে ব্যথানাশকের আসক্তি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে। সে দেখেছে, চিকিৎসাকাজে ব্যবহৃত ব্যথানাশক মরফিন–জাতীয় ওষুধের প্রতি অনেকের আসক্তি জন্মে যায়। পড়াশোনা করে সে জানতে পেরেছে, এই আসক্তি জন্মে শরীরে অপিয়ড রিসেপ্টর জিনের মিউটেশনের ফলে। গীতাঞ্জলি ভাবল, এমন কোনো যন্ত্র তৈরি করতে হবে, যেটা দিয়ে এই আসক্তি পরিমাপ করা যাবে খুব সহজে। কিন্তু সে তো জানে না জিনের মিউটেশন কীভাবে ঘটে। তখন সে মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রফেসরদের অনেকে তার সত্যিকারের প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। এ রকম একজন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেল বায়োলজির প্রফেসর মাইকেল ম্যাকমারি। তিনি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গবেষণার সুযোগ করে দিলেন গীতাঞ্জলিকে।

স্কুলশিক্ষার্থী গীতাঞ্জলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গবেষণা করে উদ্ভাবন করল অপিয়ড ড্রাগের আসক্তি মাপার যন্ত্র ‘এপিওন’। বেদনানাশী গ্রিক দেবী এপিওনের নামে এই যন্ত্রের নাম দেয় সে। যন্ত্রটির কার্যপদ্ধতি খুব সহজ। স্পেকট্রোফটোমিটারে ছত্রাকের জিনের ছবি বিশ্লেষণ করে সে প্রমাণ করে, আসক্তির ফলে জিনের মিউটেশন হলে কোষে প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন তাদের রং স্বাভাবিকের চেয়ে গাঢ় হয়ে যায়। তবে মানুষের ডিএনএ পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই যে তার এ যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে। তখন জিন এডিটিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। এ পদ্ধতিতে গীতাঞ্জলির যন্ত্র ব্যবহার করে দেখার আগেই বিশ্বব্যাপী কোভিডের আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। সেই সময় গীতাঞ্জলি উদ্ভাবন করল অনলাইনে দুর্ব্যবহার রোধের অ্যাপ ‘কাইন্ডলি’, যার কথা আগেই বলেছি।

শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবক হওয়ার পর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কিশোর-তরুণেরা তার কাছে জানতে চাইছে, কীভাবে বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করা যায়? গীতাঞ্জলি অনলাইনে তাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে নিয়মিত, যে কথা আগেই বলেছি। এত শিক্ষার্থীর চাপ সামাল দিতে গীতাঞ্জলি ইতিমধ্যে দুটি বই লিখে প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ইয়াং ইনোভেটরস গাইড টু স্টেম এবং সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ইয়াং ইনোভেটরস গাইড টু প্ল্যানিং ফর সাকসেস। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি হতদরিদ্র দেশে গীতাঞ্জলি তার নিজের বই ও আসবাব দান করেছে, যেন ওরা নিজেদের মতো করে গবেষণা করতে পারে।

স্কুলশিক্ষার্থী গীতাঞ্জলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গবেষণা করে উদ্ভাবন করল অপিয়ড ড্রাগের আসক্তি মাপার যন্ত্র ‘এপিওন’। বেদনানাশী গ্রিক দেবী এপিওনের নামে এই যন্ত্রের নাম দেয় সে। যন্ত্রটির কার্যপদ্ধতি খুব সহজ।

২০২১ সালে গীতাঞ্জলি পেয়েছে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের ইয়াং এক্সপ্লোরার পুরস্কার। এ পুরস্কারের সব টাকা দিয়ে সে কেনিয়ার একটি স্কুলে তৈরি করে দিয়েছে বিজ্ঞান গবেষণাগার, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিখছে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়, উদ্ভাবনের চিন্তা করতে হয় এবং তা বাস্তবায়ন করতে হয়।

বিজ্ঞান গবেষণায় আগ্রহ তৈরির পর থেকেই গীতাঞ্জলির স্বপ্ন এমআইটিতে পড়ার। নিজ যোগ্যতায় সে ১৭ বছর বয়সে, ২০২২ সালে ভর্তি হয়েছেন এমআইটিতে। ইঞ্জিনিয়ারিং বায়োলজি মেজর আর শিল্পোদ্যোগ তার মাইনর সাবজেক্ট।

গীতাঞ্জলির মতো উদীয়মান প্রতিভাকে যথাযোগ্য সম্মান, স্বীকৃতি, অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহিত করার পাশাপাশি তাদের মেধা বিকাশে সহায়তা করার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যুক্তরাষ্ট্রে। তাই সেখানে মেধার বিকাশ হয় সবচেয়ে বেশি। গীতাঞ্জলি রাওকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় সম্প্রতি। ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন গীতাঞ্জলিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘গার্লস লিডিং চেঞ্জ’ পুরস্কার তুলে দেন।

গীতাঞ্জলি শুধু বিজ্ঞান গবেষণার পেছনেই যে সব সময় লেগে থাকে, তা নয়। ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর সম্প্রতি সে এভিয়েশন লাইসেন্স পেয়ে ছোট্ট বিমান চালানো শুরু করেছে।

এমআইটির উজ্জ্বল ছাত্রী গীতাঞ্জলির কাছ থেকে আরও নতুন নতুন কী কী উদ্ভাবন পাওয়া যায়, তা দেখার জন্য বিজ্ঞানজগৎ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: ১. লরেন সারকি ও মনজিত থাপ, রেজিস্টারস, রেন অ্যান্ড রুক, লন্ডন, ২০১৯

২. Gitanjalirao.net, ৩. time.com/5916772/kid-of-the-year-2020

৪. 3m.com, ৫. ইউনাইটেড স্টেটস পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অফিস

৬. এমআইটি: web.mit.edu

৭. ইউনিসেফ: unicef.org/innovation/kindly

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন