খাবারে ভারী ধাতুর রকমফের

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি গবেষক দল বেগুনে ভারী ধাতু পেয়েছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, শুধু কি বেগুনেই পাওয়া যাচ্ছে এ ধরনের ধাতু? আসলে তা নয়। বিভিন্ন খাদ্যে একাধিক গবেষণায় এ ধরনের ধাতু পাওয়া গেছে। সেসব ধাতু ও গবেষণার কথা…

বিভিন্ন খাদ্যে পাওয়া যাচ্ছে ভারী ধাতু

খাবারে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের কৃষিজমি, খাবার, পানি, এমনকি শহরাঞ্চলের মাটিতেও ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। নিত্যদিনের কৃষিপণ্য, যেমন চাল, সবজি, ফল ও মাছেও রয়েছে ভারী ধাতুর উপস্থিতি। 

ভারী ধাতু মানবদেহে সামান্য পরিমাণে প্রবেশ করাও বিপজ্জনক। স্বল্প সময় কিংবা দীর্ঘ সময় ভারী ধাতুর সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্ক, বৃক্ক, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপিণ্ড, পরিপাকতন্ত্রে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। হতে পারে ক্যানসার। ভারী ধাতু যখন খাবারের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে, তখন তা অনেক ক্ষেত্রে বমি, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, স্নায়ুবৈকল্য, দৃষ্টি ও শ্রবণে সমস্যা, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা প্রকাশ পায়। আবার বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভারী ধাতুর কণা নিশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করতে পারে। ফলে হতে পারে শ্বসনতন্ত্রের সমস্যা। কিন্তু ভারী ধাতুর মূল প্রভাব আমাদের কোষে। কোষের ডিএনএর গঠন নষ্ট করে ফেলে এসব ধাতু। আবার মাইটোকন্ড্রিয়ার কাজে বাধা প্রদান করার মাধ্যমে দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এর ফলে হতে পারে মৃত্যুও।

ভারী ধাতুর এই ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাটি, পানি ও ফসলের জন্য বিভিন্ন ভারী ধাতুর সর্বোচ্চ সহনীয় সীমা নির্ধারণ করেছে। খাবারে ভারী ধাতুর উপস্থিতি এই সহনীয় সীমার ঊর্ধ্বে হলে এসব ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায় (যেগুলোর কথা ওপরে লিখেছি)। কিন্তু বাংলাদেশের বড় বড় বাজারগুলোয় চাল, সবজি ও মাংসে আর্সেনিক, জিংক, ক্যাডমিয়াম, তামা, ক্রোমিয়াম ও সীসার মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এগুলোর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি।

'স্প্রিঙ্গার' জার্নালে প্রকাশিত পর্যালোচনামূলক গবেষণাপত্রে এভাবেই দেখানো হয়েছে ভারী ধাতু ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাদ্যে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে নেচার প্রকাশনা সংস্থার বিশ্বখ্যাত জার্নাল স্প্রিঙ্গার-এ একটি পর্যালোচনামূলক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। নাম, ‘হেভি মেটাল কন্টামিনেশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড হেলথ রিস্কস ইন ফুড ওয়েব—আ রিভিউ ফোকাসেস অন ফুড সেফটি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি ইন বাংলাদেশ’। এতে উঠে এসেছে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় খাবারে ভারী ধাতু নিয়ে হওয়া একাধিক গবেষণার সারকথা।

বাংলাদেশের ৩০টি স্থান থেকে সংগৃহীত সবজি ও ফলমূল পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আমে সীসা আর টমেটোতে ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে। রুই, তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের মধ্যে, তেলাপিয়ায় আর্সেনিকের ঘনমাত্রা বাকি দুই মাছের চেয়ে বেশি। বুড়িগঙ্গার গলদা চিংড়িতে পাওয়া গেছে বিপজ্জনক ঘনমাত্রার তামা।

ভারী ধাতু থেকে পানিও মুক্ত নয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাবার পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। 

ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে সবচেয়ে বেশি আছে সীসা, তারপর আর্সেনিক। দুটো ধাতুর পরিমাণই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার ওপরে। এর মানে, ঢাকার পানি পানের অযোগ্য। জামালপুরের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পানি পান করার অযোগ্য।

ভারী ধাতু দিয়ে দূষিত এমন আরও একটি জায়গা শহরের ছাদ বা বারান্দার বাগান। এই বাগানের মাটির ভারী ধাতু চলে আসে এখানে চাষ করা সবজি ও ফলমূলে। আর সেগুলো খাওয়ার মাধ্যমে ভারী ধাতু প্রবেশ করে আমাদের শরীরে, তারপর তা ছড়িয়ে যায় পরিবেশে। এই ছাদবাগানে ভারী ধাতু কতটুকু, তা বের করা সহজ নয়। হয়নি যথেষ্ট গবেষণাও।

কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থায় সমন্বয়ের অভাব, সেচের পানিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি, পোলট্রি ও মাছের খাবারে ভারী ধাতু, কীটনাশক ও সারে ভারী ধাতুর ব্যবহার মাটি, পানি ও ফসলে ভারী ধাতুর উচ্চমাত্রার জন্য দায়ী। এ সমস্যা সমাধানে তাই এসব দিকের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন
রিভিউ জার্নালটিতে এই সারণির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, কী পরিমাণ গবেষণা হয়েছে খাদ্যে ভারী ধাতু নিয়ে

কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থায় সমন্বয়ের অভাব, সেচের পানিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি, পোলট্রি ও মাছের খাবারে ভারী ধাতু, কীটনাশক ও সারে ভারী ধাতুর ব্যবহার মাটি, পানি ও ফসলে ভারী ধাতুর উচ্চমাত্রার জন্য দায়ী। এ সমস্যা সমাধানে তাই এসব দিকের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কিন্তু ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে কিছু গবেষণা হলেও এগুলো কীভাবে পরিবেশে এতটা ছড়িয়ে পড়ছে, আর এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন।

ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক নিয়ে সম্ভবত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। আর্সেনিকের অজৈব লবণ, খনি থেকে প্রাপ্ত বিষাক্ত আর্সিনেট ও আর্সিনাইট যৌগ ভূগর্ভস্থ পানিতেও পাওয়া গেছে। এই দূষিত পানি দিয়ে জমিতে সেচ দেওয়ার ফলে পরিবেশে আর্সেনিক ছড়িয়ে যায়। আর্সেনিক দূষণের ফলে বাস্তুতন্ত্রের সব স্তরে আর্সেনিক ছড়িয়ে যাওয়ার কথা আমরা জানি এর ওপর প্রচুর গবেষণা থেকে। ট্যানারির বর্জ্য শোধন না করার কারণে প্রচুর ভারী ধাতু পরিবেশে মুক্ত হয়, যা মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে।

 দেশের অধিকাংশ নদী কলকারখানার বর্জ্যের কারণে ভারী ধাতু দিয়ে দূষিত। সবচেয়ে বেশি দূষণ পাওয়া গেছে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে, তারপর ধলেশ্বরীতে। একাধিক দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, যেমন গঙ্গা/পদ্মা, হালদায়ও প্রচুর ভারী ধাতুর উপস্থিতি আছে।

দূষিত মাটি ও পানি ভারী ধাতুর নতুন উৎস হিসেবে কাজ করে। এখান থেকে গাছপালা ভারী ধাতু শোষণ করে নেয়। এই গাছপালা থেকে পাওয়া ফলমূল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য খাওয়ার মাধ্যমে ভারী ধাতু চলে আসে আমাদের দেহে। তেমনি দূষিত নদীর মাছে পাওয়া যায় ভারী ধাতু। আর এই মাছ আমাদের খাদ্যে ভারী ধাতুর আরেকটি উৎস।

ধাপে ধাপে ভারী ধাতু বাস্তুসংস্থানের উৎপাদক থেকে উচ্চতর শ্রেণির খাদকে জমা হতে থাকে। আর প্রতি ধাপের প্রাণীতে ভারী ধাতুর ঘনমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই ক্রমবর্ধমান ঘনমাত্রাকে বলে বায়োম্যাগনিফিকেশন। এটি ভবিষ্যতে ভারী ধাতুর ঝুঁকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ভারী ধাতু দিয়ে দূষিত এমন আরও একটি জায়গা শহরের ছাদ বা বারান্দার বাগান। এই বাগানের মাটির ভারী ধাতু চলে আসে এখানে চাষ করা সবজি ও ফলমূলে

সম্প্রতি ঢাকার স্কুলের এবং বাসাবাড়ির ধুলায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি দেখা গেছে। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারী ধাতু দূষণের প্রকোপও বাড়ছে। তাই ভারী ধাতু সব সময়ই নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন নতুন উদ্ভাবন। ‘পোর্ট্রেশিয়া’ নামের লবণাক্ত জলাভূমির ম্যাক্রোফাইটের ভারী ধাতু সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে বর্তমানে গবেষণা চলছে।

ভারী ধাতু সমস্যা ও তার সমাধানের ওপর যেমন আরও নতুন গবেষণা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন এ–সম্পর্কিত আইনগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। ভারী ধাতু গবেষণার ফলাফল জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা ও আইন প্রণয়নে কাজে লাগালে তবেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ

সূত্র: ১. হেভি মেটাল কন্টামিনেশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড হেলথ রিস্কস ইন ফুড ওয়েব—আ রিভিউ ফোকাসেস অন ফুড সেফটি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি ইন বাংলাদেশ, স্প্রিঙ্গার জার্নাল, ২৩ জুলাই ২০২১

২. প্রথম আলো

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন