এক্সোপ্ল্যানেটের খোঁজে
সৌরজগতের বাইরের গ্রহ আবিষ্কারের কাহিনি
মাইকেল মায়োর ও দিদিয়ের কুইলোজ আবিষ্কার করলেন প্রথম বহিঃসৌরগ্রহ। বদলে গেল জ্যোতির্বিজ্ঞানের খোলনলচে, শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। পদে পদে নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে প্রথম বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কারের কাহিনি...
বরফের গর্তে পা পিছলে আরেকটু হলেই নিজের জীবনের পাশাপাশি প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কারের সুযোগও হাতছাড়া করতে বসেছিলেন জ্যোতিঃপদার্থবিদ মাইকেল মায়োর। রোমাঞ্চপ্রিয় মায়োরের জন্ম সুইজারল্যান্ডের জেনেভা লেকের উপকণ্ঠে লাউসান শহরে, ১৯৪২ সালে। তাঁর পরিবারের সব সদস্যই বিপদজনক এরকম নানা বিষয়ে কম-বেশি পারদর্শী ছিলেন। ফলে ছোটবেলা থেকেই উঁচু পাহাড়ে চড়া কিংবা স্কিইং করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতেন তিনি। ফলাফল, ছাব্বিশ বছর পরে ঘটা বরফের গর্তে পা হড়কানোর সেই ঘটনা।
মায়োর ডক্টরাল থিসিস করেন জেনেভা ইউনিভার্সিটি থেকে। এ গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল মহাকর্ষের প্রভাবে নক্ষত্রের গতিপথের বিচ্যুতি খুঁজে বের করা। এ জন্য তিনি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সর্পিলাকার বাহুগুলোর নক্ষত্রদের বেছে নেন। মহাকর্ষের প্রভাবে নক্ষত্রগুলোর গতিপথের কতটা বিচ্যুতি হয়, তা মাপার জন্য প্রথমেই এগুলোর গতিবেগ সম্পর্কে গভীরভাবে জানা প্রয়োজন। সূক্ষ্ম নানা বিষয়ও বের করতে হয় সে জন্য। তবে সেই সময়ে কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। তাই গবেষণার শুরুতে এ সীমাবদ্ধতা দূর করার কাজে নামেন মায়োর। তিনি নক্ষত্রের গতিবেগ মাপার তৎকালীন পদ্ধতিগুলোর আধুনিকায়নের চেষ্টা শুরু করেন। সফলও হন অনেকাংশে। ফলে নক্ষত্রদের গতিপথের খুব সামান্য বিচ্যুতিও শনাক্ত করতে পারতেন তিনি। এভাবে খুব নিভৃতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে ঘটে যায় এক নিরব বিপ্লব। খুলে যায় পৃথিবীতে বসেই এক্সোপ্ল্যানেট বা সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর খোঁজ পাওয়ার বদ্ধ দুয়ার।
আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির কথাই ধরা যাক। এটি সূর্যের আলোর এক বিলিয়ন ভাগের মাত্র এক ভাগ প্রতিফলিত করতে পারে। অর্থাৎ, বৃহস্পতির উজ্জ্বলতা সূর্যের এক বিলিয়ন ভাগের মাত্র এক ভাগ। এ কারণে পৃথিবীতে বসে সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দূরের কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলা এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ শনাক্ত করা খুব কঠিন
এক্সোপ্ল্যানেট খুঁজে পাওয়া কেন এত কঠিন
এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করার কাজে মূল বাধা ছিল সুবিশাল উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো। কোনো গ্রহই নক্ষত্রদের মতো করে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় আলো ও শক্তি তৈরি করতে পারে না। কারণ ফিউশন ঘটাতে যে পরিমাণ ভরের প্রয়োজন, গ্রহদের সেটা থাকে না। তবে নিজে আলো তৈরি করতে না পারলেও তারা খুব সহজেই নিজ নক্ষত্রের (যাকে কেন্দ্র করে কোনো গ্রহ ঘোরে) আলো প্রতিফলিত করতে পারে। এই আলো শনাক্ত করার মাধ্যমে সরাসরি খুঁজে পাওয়া যায় গ্রহদের। কিন্তু সমস্যা হলো, গ্রহদের আকার নক্ষত্রদের তুলনায় বহুগুণ কম। তাই এদের আলো প্রতিফলিত করার মাত্রাও খুব কম।
আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির কথাই ধরা যাক। এটি সূর্যের আলোর এক বিলিয়ন ভাগের মাত্র এক ভাগ প্রতিফলিত করতে পারে। অর্থাৎ, বৃহস্পতির উজ্জ্বলতা সূর্যের এক বিলিয়ন ভাগের মাত্র এক ভাগ। এ কারণে পৃথিবীতে বসে সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দূরের কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলা এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ শনাক্ত করা খুব কঠিন। বলা উচিৎ, প্রায় অসম্ভব। খড়ের গাদায় চিকন সুচ খুঁজে বের করাও এর চেয়ে অনেক সহজ।
তবে কথায় আছে, যত মুশকিল তত আসান। মাইকেল মায়োরের থিসিসের ওপর ভিত্তি করে এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করার অভিনব এক পদ্ধতির নাগাল পাওয়া যায়। এতে সরাসরি অজানা গ্রহটিকে পর্যবেক্ষণের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং মহাকর্ষের জন্য কোনো নক্ষত্রের কক্ষপথের নড়াচড়া বা বিচ্যুতি (Wobble) পরিমাপের মাধ্যমেই খোঁজ মিলবে তাদের।
ভরকেন্দ্রের ধারণা
মায়োরের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভ্রান্তি দূর করে নেওয়া যাক। আমরা যখন কক্ষপথ নিয়ে কথা বলি, তখন প্রথমেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে দুটি বস্তুর ছবি। সাধারণত এদের একটির ভর অন্যটির চেয়ে বেশি হয়। কম ভরের বস্তুটি ঘূর্ণমান থাকে বেশি ভরের বস্তুকে কেন্দ্র করে। প্রকৃতিতে এমন কক্ষপথের অসংখ্য উদাহরণ আছে। যেমন পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের ঘূর্ণন অথবা সূর্যের চারদিকে পৃথিবীসহ অন্য সব গ্রহের ঘূর্ণন ইত্যাদি। মজার বিষয় হলো, কক্ষপথে ঘূর্ণনের এই মডেলটি কিন্তু পুরোপুরি সঠিক নয়। অর্থাৎ, কেবল কম ভরের বস্তুটিই বেশি ভরের বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরবে, বিষয়টা এমন নয়। বেশি ভরের বস্তুটিও কম ভরের বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘোরে। খুব অল্প মাত্রায় হলেও। আসলে মাঝে থাকা ভরকেন্দ্রকে (Center of mass) ঘিরে দুটো বস্তুই ঘোরে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এই ভরকেন্দ্রকে বলে ব্যারিসেন্টার (Barycenter)। বাংলায় বলে সাধারণ ভরকেন্দ্র।
এই ভরকেন্দ্রের অবস্থান কোথায় হবে, তা নির্ভর করে বস্তু দুটোর ভরের ওপর। যদি দুটি বস্তুর ভর একদম সমানে সমান হয়, তাহলে সাধারণ ভরকেন্দ্রের অবস্থান হবে এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ঠিক মাঝখানে। আর ভরের পার্থক্য যত বেশি হবে, ততই একপাশে (ভারী বস্তুর দিকে) সরে যাবে সাধারণ ভরকেন্দ্র। প্লুটো এবং এর উপগ্রহ ক্যারনের কথাই ধরুন। ক্যারনের ভর প্লুটোর প্রায় ১২ শতাংশ। উপগ্রহের বিশাল ভরের কারণে এদের সাধারণ ভরকেন্দ্রের অবস্থান প্লুটোর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরে। অন্যদিকে ক্যারনের পৃষ্ঠ থেকে এই ভরকেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার।
পৃথিবী ও চাঁদের জন্য বিষয়টি কেমন? সাধারণ ভরকেন্দ্রকে ঘিরে এদের আবর্তন প্লুটো ও ক্যারনের মতো এতটা দৃশ্যমান নয়। কারণ চাঁদ ও পৃথিবীর ভরের পার্থক্য অনেক বেশি। চাঁদের ভর পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ। তাই সাধারণ ভরকেন্দ্রের অবস্থান পৃথিবীর খুব কাছে। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার ভেতরে। তাই ভরকেন্দ্রকে ঘিরে পৃথিবীর আবর্তনকে সেই অর্থে কক্ষপথে পরিভ্রমণ বলা যায় না। বরং একে ঘিরে পৃথিবী খানিকটা নড়াচড়া করে বলাই বেশি যৌক্তিক।
নক্ষত্র এবং গ্রহের মধ্যেও ঠিক এ ঘটনাই ঘটে। নক্ষত্রের ভর গ্রহের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি। তাই সাধারণ ভরকেন্দ্রের অবস্থান হয় নক্ষত্রকেন্দ্রের খুব কাছে। সে জন্য গ্রহগুলোর কক্ষপথ হয় নক্ষত্রের নিজের ভরকেন্দ্রকে ঘিরে (প্রায়)। সে জন্য নক্ষত্রগুলোতে খুব সামান্য পরিমাণ নড়াচড়াই (Wobble) দেখা যায়।
রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক
১৯৯৪ সালের শেষ ভাগে মায়োরের ছাত্র দিদিয়ের কুইলোজ (সঠিক উচ্চারণ ডিডিয়ের কেলোজ) একটি টেলিস্কোপ নিয়ে একাই কাজ করছিলেন। এমন সময় পৃথিবী থেকে প্রায় ৫১ আলোকবর্ষ দূরের একটি নক্ষত্রের গতিপথে এমন একটি নড়াচড়া শনাক্ত করতে সক্ষম হন। নক্ষত্রটির নাম ছিল ৫১ পেগাসি। এর অবস্থান পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জে। নক্ষত্রটিকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া একটি এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহের কারণে সেটি এমন আচরণ করছিল। তবে শুরুতেই এ উপসংহারে পৌঁছানোর সাহস করেননি কুইলোজ। অতদূরের সেই গ্রহটির সন্ধান তিনি পৃথিবীতে বসেই পেয়েছিলেন ডপলার ইফেক্টের মাধ্যমে।
আমরা জানি, ডপলার ইফেক্ট বলে, কোনো তরঙ্গ যখন আমাদের কাছে আসে, তখন সেটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়, বেড়ে যায় কম্পাঙ্ক বা তীব্রতা। আর তরঙ্গ দূরে সরে গেলে বেড়ে যায় তরঙ্গদৈর্ঘ্য। কম্পাঙ্ক বা তীব্রতা এ ক্ষেত্রে কমে যায়। সে জন্যই সাইরেন বাজিয়ে কোনো অ্যাম্বুলেন্স আমাদের দিকে এগিয়ে এলে শব্দের তীব্রতা বেড়ে যায়। আর দূরে সরে গেলে কমে যায় শব্দের তীব্রতা। উৎস ও শ্রোতার মাঝের দূরত্ব কমা-বাড়ার সঙ্গে কম্পাঙ্কের এই হ্রাস-বৃদ্ধির নামই ডপলার ইফেক্ট বা ডপলার বিচ্যুতি।
নক্ষত্র থেকে পৃথিবীতে আসা আলোতেও ঠিক এই ঘটনা ঘটে। গ্রহের উপস্থিতির জন্য কোনো নক্ষত্র যখন নিজেদের সাধারণ ভরকেন্দ্রকে ঘিরে আবর্তিত হয় (আসলে খুব সামান্য নড়াচড়া করে), তখন যদি সেটা পৃথিবীর দিকে সামান্য সরে আসে, তাহলে নক্ষত্র থেকে পৃথিবীতে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সামান্য কমে যায়। আর পৃথিবীর সাপেক্ষে নক্ষত্র সামান্য দূরে সরে গেলে সেখান থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সামান্য বেড়ে যায়। অর্থাৎ, বর্ণালির লাল অংশের দিকে সরে যায় (লোহিত বিচ্যুতি বা লাল সরণ)। সাধারণ ভরকেন্দ্রকে ঘিরে নক্ষত্রের ঘুরপাকের ফলে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়মিত বিরতিতে কমতে-বাড়তে থাকে। অর্থাৎ, স্পন্দিত হয়।
যাহোক, মূল কথা হলো, আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পার্থক্য পরিমাপের মাধ্যমে আমরা নক্ষত্রের গতি সম্পর্কে জানতে পারি। নক্ষত্রের এমন গতির নাম দেওয়া হয়েছে রেডিয়াল ভেলোসিটি। এর ঋণাত্মক মান নক্ষত্রের পৃথিবীর দিকে সরে আসা বোঝায়। আর ধনাত্মক মান নক্ষত্রের পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাওয়া নির্দেশ করে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে নক্ষত্রের নড়াচড়া শনাক্ত করার মাধ্যমে এক্সোপ্ল্যানেট বা সৌরজগতের বাইরের গ্রহ খুঁজে বের করার পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক।
রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক ব্যবহার করে এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্তের পাশাপাশি এ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যও পাওয়া সম্ভব। যেমন গ্রহটি একবার নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করতে কত সময় নেয় বা এর ভরের মান সর্বনিম্ন কতে হতে পারে ইত্যাদি।
তাহলে কি মায়োর এবং কুইলেজের হিসাবে ভুল হয়েছে? নাকি গ্রহ-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বগুলোতেই রয়েছে ঝামেলা? অথবা অজানা বস্তুটি হয়তো কোনো গ্রহই নয়?
শেষ রক্ষা হবে তো?
১৯৯৪ সালের শেষ ভাগ পর্যন্ত মায়োর এবং কুইলোজ ফ্রান্সের দক্ষিণে অবস্থিত হাউট-প্রোভিন্স মানমন্দিরের টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ৫১ পেগাসি নক্ষত্রের রেডিয়াল ভেলোসিটির মোট বারোটি পুর্ণাঙ্গ মান মাপতে সক্ষম হন। ফলাফল দেখে তাঁরা অচিরেই বুঝতে পারেন, খুব সম্ভবত প্রথমবারের মতো নিশ্চিতভাবে খুঁজে পাওয়া গেছে সৌরজগতের বাইরের প্রথম গ্রহ। কিন্তু ফলাফল প্রকাশ করা নিয়ে তাঁরা বেশ দ্বিধায় ছিলেন। কারণ বিগত পঞ্চাশ বছরে বেশ কয়েকবার এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবগুলোই ভুল প্রমাণিত হয়েছে শেষ পর্যন্ত।
আরেকটি গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁরা। অজানা গ্রহটির ভরের সম্ভাব্য সর্বনিম্ন মান এবং পর্যায়কাল পরিমাপ করে তাঁরা বেশ ধাক্কা খান। কারণ তাঁদের প্রাপ্ত মানগুলো ছিল খুব অদ্ভুত। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। গ্রহটির সম্ভাব্য ভর ছিল আমাদের সৌরজগতের বৃহস্পতি গ্রহের অন্তত অর্ধেক। অর্থাৎ, পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ১৫০ গুণ বড়। এ ধরনের বিশাল ভরের গ্রহগুলোকে ডাকা হয় গ্যাসদানব নামে। এদের কোর বা কেন্দ্র কঠিন পদার্থের তৈরি, তবে পৃথিবীর মতো কঠিন পৃষ্ঠের অস্তিত্ব নেই। হাজারো কিলোমিটার বিস্তৃত সুবিশাল বায়ুমণ্ডলের পুরোটাই গঠিত গ্যাসীয় পদার্থের সমন্বয়ে। আমাদের সৌরজগতে ইউরেনাস, শনি এবং নেপচুন গ্রহের গঠনও ঠিক এরকম। সাধারণত গ্যাসদানব গ্রহগুলোর অবস্থান হয় মূল নক্ষত্র থেকে অনেকটা দূরে। সৌরজগতের বাইরের প্রান্তে। এদের অবস্থান যদি মূল নক্ষত্রের (যেমন সূর্য) কাছে হতো, তাহলে প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে এগুলোতে কোনো গ্যাসীয় পৃষ্ঠের অস্তিত্বই থাকত না। বাস্পীভূত হয়ে যেত। তাই এ ধরনের গ্রহগুলোকে অবশ্যই মূল নক্ষত্র থেকে দূরে হতে হবে।
অবাক করা বিষয় হলো, মায়োর এবং কুইলোজের আবিষ্কৃত অজানা গ্রহটির অবস্থান ছিল মূল নক্ষত্রের অনেক কাছে। আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট গ্রহের নাম বুধ। এর অবস্থান সূর্যের সবচেয়ে কাছে। মায়োরের অজানা গ্রহটির অবস্থান ছিল বুধ-সূর্যের দূরত্বের চেয়েও কম দূরে। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই এ গ্রহটির গ্যাসদানব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এর আকার বলছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। অজানা গ্রহটির পর্যায়কাল নিয়েও ছিল অসঙ্গতি। গ্রহটি মূল নক্ষত্রকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় মাত্র চার দিন। গ্রহের আকার বিবেচনায় এটাও বেশ অস্বাভাবিক।
তাহলে কি মায়োর এবং কুইলেজের হিসাবে ভুল হয়েছে? নাকি গ্রহ-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বগুলোতেই রয়েছে ঝামেলা? অথবা অজানা বস্তুটি হয়তো কোনো গ্রহই নয়?
মায়োর এবং কুইলোজ ধৈর্য্যের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন ৫১ পেগাসিকে। ১৯৯৫ সালের জুলাই নাগাদ তাঁরা নতুন করে রেডিয়াল ভেলোসিটির আরও আটটি মান নেন। বার বার একই ধরনের তথ্য পাওয়ায় তাঁরা অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান। যতই অসম্ভব মনে হোক না কেন, ৫১ পেগাসিকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণমান বস্তুটিকে অবশ্যই একটি গ্রহই হতে হবে।
মায়োরের আবিষ্কৃত গ্রহটির নাম রাখা হয় ৫১ পেগাসি বি (51 Pegasi b)। এখানে ‘বি’ অক্ষরটি লেখা হয় ছোট হাতের অক্ষরে। কারণ, প্রচলিত রীতি অনুসারে আগেই মূল নক্ষত্রের নাম রাখা হয়েছিল ৫১ পেগাসি এ (বড় হাতের অক্ষর)। পরে যদি এই নক্ষত্রের আরও কোনো গ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে পর্যায়ক্রমে সেগুলোর নামকরণ করা হবে ৫১ পেগাসি সি, ৫১ পেগাসি ডি ইত্যাদি। গ্রহদের নামের শেষের অক্ষরগুলো লিখতে হবে ছোট হাতের অক্ষরে। আর যদি এই সিস্টেমে আরেকটি মূল নক্ষত্র থাকত, অর্থাৎ বাইনারি স্টার সিস্টেম হলে অন্য নক্ষত্রের নামের শেষে যুক্ত করা হতো বড় হাতের ‘বি’ (B)। এখনো সেরকম কোনো নক্ষত্র পাওয়া যায়নি। ৫১ পেগাসি এ নক্ষত্রটিকে তাই প্রচলিতভাবে ‘৫১ পেগাসি’ নামেই ডাকা হয়।
১৯৯৫ সালের ৬ অক্টোবর মায়োর ইতালির ফ্লোরেন্সে একটি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে কিছুটা দেরি করে ফেলেছিলেন তিনি। তাই তাঁকে শুধু একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সময় বরাদ্দ করা হয় মাত্র ৫ মিনিট। বৈঠক শুরুর আগেই মায়োর এবং কুইলোজের যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে শুরু হয় কানাঘুষা। গুরুত্ব আঁচ করতে পেরে আয়োজকেরা তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত সময় বাড়িয়ে ৪৫ মিনিট করে দেন। সেখানেই প্রথমবারের মতো নিশ্চিতভাবে এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কারের খবর জানিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দেন মায়োর। শুরু হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়।
লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)
সূত্র: এলিজাবেথ জে টাস্কার, দ্য প্ল্যানেট ফ্যাক্টরি: এক্সোপ্ল্যানেটস অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর আ সেকেন্ড আর্থ অবলম্বনে