ফুটবলের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের ফুটবল

কোপা আমেরিকা ও ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ চলছে। গোটা বিশ্ব মেতে আছে ফুটবলে। কিন্তু এটা নিছকই একটা খেলা নয়। এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিজ্ঞান। ফুটবল কিংবা বিজ্ঞান—যেটারই ইতিহাস ঘাঁটুন, পেয়ে যাবেন পরস্পরের সম্পর্কের রসায়ন। ফুটবলের পেছনে বিজ্ঞানটাই বা কী?

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত খেলাধুলার বিজ্ঞান নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতেন না। এখন ফুটবলের বিজ্ঞান নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব সায়েন্স অ্যান্ড ফুটবল। প্রতি চার বছর পরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তা হচ্ছে। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, তুরস্ক, জাপান ও ডেনমার্কে সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর আগামী বছর মেলবোর্নে হবে এই কংগ্রেস। ফুটবলের বৈজ্ঞানিক গবেষণা এত বেশি হয়ে যাচ্ছে যে একটা কংগ্রেসে কুলাচ্ছিল না বলে ২০০৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে সায়েন্স অ্যান্ড সকার কনফারেন্স। এখন বিজ্ঞানীরা অনুধাবন করছেন, ফুটবল থেকে অনেক নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আবার ফুটবলের অর্থও কিন্তু সব দেশে এক নয়। অস্ট্রেলিয়াতেই  লোকে অন্য নামে চেনে।

অনেক বছর আগের কথা। অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে এসেছি এক মাসও হয়নি তখনো। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপ অফিসের একটি অনুষ্ঠানে ভাইস চ্যান্সেলর নিজে এগিয়ে এসে কথা বলছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। এখানে চ্যান্সেলর-ভাইস চ্যান্সেলররা সাঙ্গপাঙ্গ ছাড়া সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করেন—এটাই আমার কাছে আশ্চর্যের ঘটনা। তাঁদের কেউ যখন আটপৌরে মানুষের মতো শিক্ষার্থীদের কাছে ফুটবল টিম সম্পর্কে জানতে চান, তখন যেন ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। ভাইস চ্যান্সেলর হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ফুটবল টিম কোনটি?’ ভাইস চ্যান্সেলরের প্রশ্নে আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।

আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ফুটবলের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে শুরু করলেন। অস্ট্রেলিয়ার সব মানুষই নাকি কোনো না কোনো ফুটবল দলের সমর্থক। অনেকে বংশানুক্রমিকভাবে কোনো কোনো দলের সমর্থক। আমি ভাবলাম, এ আর নতুন কী? আমরাও তো ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার পতাকা দিয়ে পুরো বাংলাদেশ ঢেকে ফেলি বিশ্বকাপের সময়।

কিন্তু ক্রমে ক্রমে জানলাম, অস্ট্রেলিয়ার মানুষ যে ফুটবল দলের সমর্থক, সেই সব কটি দল তাদের নিজেদের দেশের টিম। আবার যে ফুটবল নিয়ে তারা এত মাতামাতি করে, সেটা আমাদের ফুটবলের মতো গোলাকার নয়, সেটা উপগোলক আকৃতির। তা ছাড়া তারা এই বল হাত-পা-মাথাসহ সারা গা দিয়ে ধাক্কাধাক্কি, মারামারি করতে করতে খেলে। গোলাকার বল নিয়ে শুধু পা ব্যবহার করে যে ফুটবল আমরা খেলি, তাকে এরা বলে সকার (Soccer)। ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলকে এরা বলে ওয়ার্ল্ড কাপ সকার।

সকার শব্দটা আমার খুব একটা ভালো লাগে না। পা বা ফুট দিয়ে যে বল খেলি সেটা ফুটবল—সোজা হিসাব। সেখানে সকার! আসলে তাদেরও দোষ নেই খুব একটা। আমরা মানুষ নামক প্রাণীরা জন্মের পর হাঁটতে শিখেই লাথি মারতে শুরু করি। সে হিসেবে ফুটবল খেলার জন্মের ইতিহাস অনেক পুরোনো। খ্রিষ্টাব্দ শুরু হওয়ার কয়েক শ বছর আগে থেকেই চীনের হ্যান সাম্রাজ্যের সৈনিকেরা অনুশীলনের অংশ হিসেবে ফুটবল খেলত। চামড়ার তৈরি এই ফুটবলের ভেতর থাকত পাখির পালক ও মানুষের চুল। তারা ফুটবলকে বলত সু চু (Tsu’ Chu)। ফুটবলের সংগঠন তৈরি করে দলগতভাবে তুলনামূলকভাবে আধুনিক ফুটবল খেলা শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে ১৮৬৩ সালে। ১৮৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর ফুটবল খেলার নিয়মকানুন ঠিক করে দলগত ফুটবল বা Association Football শুরু হয়েছিল। এর আগে দলগত রাগবি খেলার চল ছিল। দলগত ফুটবল খেলা শুরু হওয়ার পর রাগবি দলের লোকজনকে কথ্য ভাষায় রাগার (rugger) আর দলগত ফুটবলের লোকজনকে Assoccer থেকে Soccer বা সসার বলে ডাকা শুরু হলো। ক্রমে এই সসার হয়ে গেল সকার। কিন্তু আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা—এই কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকি সারা পৃথিবীতে ফুটবল হিসেবেই এই খেলা চলছে।

অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবল

ফুটবলের বলটি একটি পারফেক্ট স্ফিয়ার বা নিখুঁত গোলক, যার আয়তন 4πr3/3। এটি আমাদের পৃথিবী ও চাঁদের মতো গোলাকার। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী, ফুটবলের পরিসীমা হতে হবে ৬৮ থেকে ৭০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। গোলকের পরিসীমা  2πr। এখান থেকে খুব সহজেই আমরা হিসাব করে বের করতে পারি, ফুটবলের আদর্শ ব্যাসার্ধ হবে ১১ সেন্টিমিটার। এই ব্যাসার্ধের মান কাজে লাগিয়ে আমরা ফুটবলের আদর্শ আয়তন হিসাব করে নিতে পারি ৫৫৭৫ ঘন সেন্টিমিটার।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলের উপগোলক  আকৃতিটাই তো ভালো লাগে না। তা ছাড়া তার আয়তন বের করার জন্য যে ফর্মুলা ব্যবহার করতে হয় সেটাও বেশ খটমটে। জ্যামিতিক গণিতের বিভিন্ন আকৃতির পদার্থের আয়তন ইত্যাদি নির্ণয় করতে গিয়ে স্কুল-কলেজে আমার ‘গণিতের মার্কস কাটা গেল সবই’ অবস্থা হয়েছিল। আমার সুপারভাইজার প্রফেসর অ্যামোস ভাবলেন, তাঁদের ফুটবলের আকৃতির কারণেই আমি তাঁদের ফুটবল খেলা পছন্দ করছি না। একদিন দুপুরে আমাকে বোঝাতে বসলেন কেন অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল আমাদের ফুটবলের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে।

‘তুমি তো জানো, সব ধরনের বলই কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক বলবিদ্যা মেনে চলে। ক্রিকেট, টেনিস, ফুটবল, সকার, বেসবল, গলফ—সবই নিউটনের গতির সব কটি সূত্র মেনে চলে। তবে আমাদের ফুটবলে কিন্তু ম্যাগনাস ইফেক্ট খুব কম।’

ম্যাগনাস ইফেক্টের ব্যাপারটা কমবেশি সবাই জানে। ফুটবল খেলায় কর্নার কিক থেকে বল সরাসরি গোলবক্সে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ না ঘটলেও মাঝেমধ্যে ঘটে যায়। বল যখন লাথি খেয়ে শূন্যে উঠে ঘুরতে থাকে—তখন বলের ঘূর্ণনের ফলে বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার কারণে বলের আদি ভরবেগ ও শেষ ভরবেগ সমান হতেই হবে। ভরবেগ সমান করার জন্য বাতাস যেদিকে যায়, বলটি তার বিপরীত দিকে ছুটে যায়। এ কারণেই দেখা যায়, কর্নার থেকে বল সোজা গোলপোস্টের সামনে গিয়ে হঠাত্ ঘুরে গোলপোস্টে ঢুকে যায়। তবে এ ঘটনা ঘটানোর জন্য খেলোয়াড়দের প্রচুর দক্ষতা দরকার।

অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলে ম্যাগনাস ইফেক্ট কম হওয়ার কারণ হলো, বলের অসাম্যতা। ঘূর্ণন খুব কম হয়। কিন্তু আমার পয়েন্ট সেখানে নয়। ফুটবল খেলা দেখার সময় তার বিজ্ঞান নিয়ে কেউ ভাবে না। সবাই ভাবে, গোল নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলে ম্যাগনাস ইফেক্ট কম হলে কী আসে-যায়? অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলে কর্নারই তো নেই। কারণ, ফুটবলের মাঠটাই তো তাদের বলের মতো উপগোলাকার।

প্রফেসর অ্যামোস এবার অ্যাটমিক ফিজিকস দিয়ে আমাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। বলেন, দেখো সকার বল কিন্তু বোর মডেল, আর আমাদের ফুটবল সমারফেল্ড মডেল। সমারফেল্ড মডেল ছাড়া অ্যাটমিক মডেল অসম্পূর্ণ।

আমি দেখলাম, প্রফেসর অ্যামোসের কথা অনেকটা সত্য। আমাদের ফুটবলের আকৃতি বোর মডেলের ইলেকট্রনের কক্ষপথের মতো। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলের আকৃতি সমারফেল্ড মডেলের ইলেকট্রনের কক্ষপথের মতো। কিন্তু ফুটবলকে টেনেটুনে বিজ্ঞানের তত্ত্বে নিয়ে আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সমারফেল্ড কি ফুটবল খেলতেন?’

‘তা তো জানি না।’

‘তাহলে সমারফেল্ডকে ফুটবলে টেনে আনবেন না। ফুটবলের ক্ষেত্রে বোরই কথা বলার অধিকার রাখেন। কারণ, বোর ফুটবল খেলতেন।’

১৯৩০ সালে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত সলভে কনফারেন্সের অবসরে রাজপথে আইনস্টাইন ও বোর

পারমাণবিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত ড্যানিশ বিজ্ঞানী নিলস বোর একজন ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল টিমের দুর্দান্ত গোলকিপার ছিলেন নিলস বোর। নিউক্লিয়ার ফিজিকসের জনক আর্নেস্ট রাদারফোর্ড—যিনি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ও প্রোটন আবিষ্কার করেছেন—নিউজিল্যান্ডের নেলসন কলেজে এবং ক্যান্টারবারি ইউনিভার্সিটিতে নিয়মিত রাগবি খেলতেন। ফুটবল খেলোয়াড়দের খুব পছন্দ করতেন তিনি। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে সব সময়। রাদারফোর্ড তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের সহ্যই করতে পারতেন না। কিন্তু নিলস বোরের ব্যাপারে তিনি বলতেন, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হলেও বোর কিন্তু ভালো মানুষ, কারণ তিনি ফুটবলার।

ফুটবলাররা যে ভালো মানুষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী যদি ফুটবল না খেলেন, তাহলে যে তিনি খারাপ মানুষ হবেন, এমন কোনো কথা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান প্রজেক্টের পরিচালক ছিলেন রবার্ট ওপেনহেইমার। তাঁর জীবদ্দশায় বিজ্ঞানের এমন কোনো বিষয় ছিল না যে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল না। কিন্তু খেলাধুলা সম্পর্কে একেবারে কিছুই জানতেন না ওপেনহেইমার।

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামও ফুটবল পছন্দ করতেন না

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামও ফুটবল পছন্দ করতেন না। ইংল্যান্ড থেকে পিএইচডি করে  পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ফিরে যাওয়ার পর প্রফেসর আবদুস সালামকে লাহোর সরকারি কলেজে ফিজিকস পড়ানোর পাশাপাশি ফুটবল কোচের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেই কাজটি মোটেও পছন্দ করেননি।

নিউ সায়েন্টিস্ট-এর ৩০ জুন ২০১৬-এর একটা প্রতিবেদন অনুসারে, ফুটবলের সেরা খেলোয়াড়েরা প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। তাঁদের ব্রেনওয়ার্ক অনেক জটিল। জেতার জন্য পায়ের স্কিলের চেয়েও মস্তিষ্কের স্কিল অনেক বেশি জরুরি। বিশ্বকাপে যে টিমগুলো খেলে, তাদের প্রত্যেক খেলোয়াড়ই দক্ষ।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে দল মানসিকভাবে যত শক্ত, সেই দলের জেতার সম্ভাবনা তত বেশি। বিশেষ করে পেনাল্টি শুট আউটের ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের মানসিক দক্ষতা অনেক বেশি কার্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮২ থেকে ২০১৫-এর মধ্যে জার্মানরা ছয়টি পেনাল্টি শুটের মধ্যে ছয়টিতে জিতেছে। পেনাল্টিতে জার্মানরা ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রে গোল করেছে। অন্যদিকে ইংল্যান্ড জিতেছে সাতটির মধ্যে মাত্র একটিতে। তাদের খেলোয়াড়েরা পেনাল্টির মাত্র ৬৭ শতাংশ গোল করতে পেরেছেন। এবারের বিশ্বকাপ থেকে আমাদের আনন্দের পাশাপাশি ফুটবলের অনেক অনেক নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য সামনে আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, স্কুল অব বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস, আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: ফিফা ডট কম, সায়েন্স অ্যান্ড সকার/ থমাস রেইলি

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত