কেমন হতো সমতল পৃথিবী

সমতল পৃথিবী, প্রতীকী ছবি

পৃথিবীটা গোল—এ কথা আজ আমরা সবাই জানি। ‘গোল’ কথাটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক হলো না। পাঠ্যবইতে তাই কথাটা লেখা হতো এভাবে—পৃথিবীটা গোলাকার, তবে দুপাশে কমলালেবুর মতো চাপা। বিষয়টা মোটামুটি তা-ই।

পৃথিবী যে গোলাকার, এই ধারণাটি কিন্তু আজকের নয়। আজ এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। তবে এ ধারণার শুরুটা অনেক আগে। খ্রিস্টপূর্ব ৬১০ থেকে ৫৪৬ সনে আয়োনীয় সভ্যতায় এক জ্ঞানী পণ্ডিত ছিলেন। এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন গ্রিসের আয়োনিয়া অঞ্চলে। সেখানে মিলেটাস নামে এক শহরে বসবাস করতেন তিনি। নাম তাঁর অ্যানাক্সিমেন্ডার। সে কালের অনেক পণ্ডিতের মতোই তিনি ছিলেন মূলত দার্শনিক। যদিও চিন্তার ধারাটি তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান, কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বসহ নানা বিষয়ে ঘুরে ফিরেছে। মানুষটি সক্রেটিসেরও আগের। সে কালেই তিনি ‘পৃথিবী সমতল’—এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মতে, পৃথিবী সিলিন্ডার আকৃতির; এটি ঝুলে আছে শূন্যে, আর একে কেন্দ্র করে ঘুরছে চাঁদ-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র সব।

কখনো কি ভেবেছেন, সত্যিই যদি পৃথিবীটা সমতল, মানে ফ্ল্যাট হতো, তাহলে কী ঘটত? ইংরেজিতে এ ধরনের প্রশ্নকে বলে ‘হোয়াট ইফ’। বাংলায় বলতে পারি, ‘এমন যদি হতো’। আসলেই তো, কেমন হতো সেই পৃথিবীটা?
আরও পড়ুন

এর আগে মানুষ ভাবত, পৃথিবীটা রয়েছে কোনো দৈত্য-দানোর পিঠের ওপর। এ এক সীমাহীন কল্পনা। অযৌক্তিক, তা বলা বাহুল্য। সেখান থেকে মানুষের চিন্তাকে অনেকটা এগিয়ে আনেন অ্যানাক্সিমেন্ডার। তারপর খ্রিস্টপূর্ব ৫ শতকের দিকে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস প্রস্তাব করেন, পৃথিবী গোলাকার। ২৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে গ্রিক দার্শনিক ইরাটোস্থেনিস পৃথিবীর পরিধি মেপে ফেলেন। এভাবে ধীরে ধীরে অ্যারিস্টটল, জিওর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলি, আইজ্যাক নিউটনসহ আরও অনেক বিজ্ঞানীর অবদানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণা। আমরা জানতে পারি, পৃথিবী আসলেই গোলাকার, তবে দুপাশে খানিকটা চাপা বা চ্যাপ্টা।

তবে এই কথাটি আজও অনেকে মানেন না। তাঁরা বলতে চান, পৃথিবীটা সমতল। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফ্ল্যাট আর্থ’।

কখনো কি ভেবেছেন, সত্যিই যদি পৃথিবীটা সমতল, মানে ফ্ল্যাট হতো, তাহলে কী ঘটত? ইংরেজিতে এ ধরনের প্রশ্নকে বলে ‘হোয়াট ইফ’। বাংলায় বলতে পারি, ‘এমন যদি হতো’। আসলেই তো, কেমন হতো সেই পৃথিবীটা? বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে ভেবেছেন। হিসাব কষে দেখেছেন, কী ধরনের ঘটনা ঘটতে পারত একটা সমতল বিশ্বে। এর সব কটি তো আর এই ছোট্ট লেখায় বলা সম্ভব নয়। তবু আসুন, কিছু মৌলিক বিষয় জেনে নেওয়া যাক। বুঝে দেখা যাক, সমতল বিশ্বের প্রকৃতি কেমন হতো।

আমরা এখন জানি, পৃথিবী গোল; এর চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে অনেকগুলো কৃত্রিম উপগ্রহ

পৃথিবী যে গোল—কিংবা অন্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলোও যে স্বাভাবিকভাবে গোলাকারই হয়—এর মূল কারণ মহাকর্ষ। সুষমভাবে মহাকর্ষ কাজ করে কেন্দ্রের দিকে। অর্থাৎ চারপাশের সব কিছুকে সুষমভাবে কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে (সহজ কথায়, টানে) মহাকর্ষ। ফলে চারদিকটা গোলাকার মতন হয়ে যায়।

পৃথিবী যদি সমতল হতো, তাহলে অবশ্যই মহাকর্ষ নামের কিছু থাকতে পারত না। কিংবা থাকলেও সেটি এখনকার মতো কাজ করত না। কারণ, একইভাবে কাজ করলে সমতল সেই পৃথিবী ধীরে ধীরে গোলাকার হয়ে যেতে বাধ্য হতো।

সে ক্ষেত্রে, সমতল সেই পৃথিবীর কেন্দ্র হতো, আজ আমরা যাকে বলি উত্তর মেরু—সেই জায়গাটা। আর সেই পৃথিবীর আকার হতো ডিস্কের মতো। তাহলে, মহাকর্ষ যদি থাকত, উত্তর থেকে যত দূরে যাওয়া যেত, তত আনুভূমিক ধরনের হতো সেই টান। ফলে পৃথিবীজুড়ে একটা ভারসাম্যহীনতা দেখা যেত, হয়তো ধ্বংসযজ্ঞও হয়ে যেত কোথাও কোথাও। কী ভয়ংকর অবস্থা, ভাবুন তো!

এবারে আসুন ধরে নিই, মহাকর্ষ নেই। তার মানেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? সেই পৃথিবীতে কোনো বায়ুমণ্ডল থাকত না। তখন কিন্তু আকাশটা আজকের মতো নীল দেখা যেত না। বরং মহাশূন্যের কালো, নিকষ শূন্যতা প্রকট হয়ে উঠত পৃথিবীর ওপরে। ভূপৃষ্ঠে যে তখন আজকের মতো প্রাণ থাকত না, তা বোধ হয় আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

সূর্য থেকে আসা কণা ও উচ্চশক্তির রশ্মি বায়ুমণ্ডলের আয়নিত অক্সিজেন-নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসব পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো তখন লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি করে, সেটাই সৃষ্টি করে আকাশে রঙের খেলা

বায়ুমণ্ডল নেই মানে, অক্সিজেন ঘিরে থাকবে না চারপাশে। পানি উড়ে যাবে মহাকাশের শূন্যতায়। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা সূর্যের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে কখনো বেড়ে যাবে প্রচণ্ড, কখনো আবার নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়। তবে গভীর সমুদ্রের যেসব অণুজীব অক্সিজেন বা সালোকসংশ্লেষণ ছাড়া বাঁচতে পারে, তারা হয়তো ঠিক ঠিক টিকে যেত সেই পৃথিবীতে।

একটা মজার (এবং দুঃখজনক) ঘটনা ঘটত সেই পৃথিবীতে। রাতের আকাশ পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে একইরকম দেখাত। পৃথিবীর আকাশে থাকত না কোনো মেরুজ্যোতি বা অরোরা। এই অরোরা না থাকাটা পৃথিবীবাসীর জন্য ভালো নয় মোটেও। কারণটা বুঝতে হলে মেরুজ্যোতির ভেতরের কথাটা একটু জানতে হবে।

পৃথিবীর ভেতরটা একটা চুম্বকের মতো। ভেতরে বা কেন্দ্রে গলিত সদা পরিচলনশীল ও ঘূর্ণমান লোহার কারণেই এই চৌম্বকত্ব তৈরি হয়। এই চুম্বককে বলা হয় ভূচুম্বক। এই চুম্বকের কারণেই পৃথিবীজুড়ে সৃষ্টি হয় চৌম্বকক্ষেত্র। পৃথিবীকে ঘিরে রাখে এই চৌম্বকক্ষেত্র, সূর্য থেকে আসা বিভিন্ন কণার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে আমাদের। এই যে কণার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, এ সময় সূর্য থেকে আসা কণা ও উচ্চশক্তির রশ্মি বায়ুমণ্ডলের আয়নিত অক্সিজেন-নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসব পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো তখন লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি করে, সেটাই সৃষ্টি করে আকাশে রঙের খেলা। মানে, মেরুজ্যোতি। সমতল পৃথিবীর ভেতরে এই লোহার পরিচলন বা ঘূর্ণন হতো না; ফলে পৃথিবীকে ঘিরে থাকত না চৌম্বকক্ষেত্র। ফলে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির হামলায় পৃথিবীর বুকে কেমন নরক গুলজার হতো, তা তো বুঝতেই পারছেন!

এআইয়ের চোখে সমতল পৃথিবী
আরও পড়ুন

সেই সমতল পৃথিবীতে মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা যে খুব কম, তা তো বুঝতেই পারছেন। সমতল পৃথিবীর দাবিদাররা বলেন, পৃথিবীর চারপাশে তখন ঘিরে থাকত অ্যান্টার্কটিকার বরফের দেয়াল। সেই দেয়ালের কল্যাণে পৃথিবী থেকে টুপ করে পড়ে যেত না কেউ। ধরা যাক, সেই পৃথিবীতে আমরা বেঁচেই রইলাম। তখন পৃথিবীকে ঘিরে গোলাকার (সত্যি বলতে, ডিমের মতো উপবৃত্তাকার) কক্ষপথে কি ঘুরে বেড়াতে পারত কৃত্রিম উপগ্রহগুলো? পারত যে না, তা বলা বাহুল্য। কারণ, ডিস্কের মতো সেই পৃথিবী তো নিজেই গোল নয়! ফলে টিভি বা স্যাটেলাইট যোগাযোগ কিংবা জিপিএসের মতো সুবিধাগুলো পেতাম না আমরা। বিমানে করে চট করে চলে যাওয়া যেত না এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

দিগন্ত, আকাশহীন, জিপিএস বা যোগাযোগবিহীন সেই পৃথিবীতে আপনি কি থাকতে চাইতেন?

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, উইকিপিডিয়া ও বিজ্ঞানচিন্তা