বিজ্ঞানী
ফিরদৌসী কাদরী: গণমানুষের গবেষক
ফিরদৌসী কাদরী আইসিডিডিআরবির অন্যতম বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কলেরা নির্মূলে তাঁর গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের মধ্যে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধেও তিনি অগ্রণী সৈনিক। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে পেয়েছেন ল’রিয়েল-ইউনেসকো ফর উইমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড। এশিয়ান সায়েন্টিস্ট-এর চোখে তিনি এশিয়ার অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী। তাঁর সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন সৌমিত্র চক্রবর্তী
কলেরার টিকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার উপযোগী করে তৈরি হয়। কারণ, কলেরার জীবাণু সাধারণত রক্তে যায় না, পৌষ্টিকতন্ত্রের ভেতরেই অবস্থান করে। একুশ শতকের শুরুর দিকে কলেরার টিকা ডুকোরাল (Dukoral) বেশ ব্যবহৃত হতো। মুখে খাওয়ার এই টিকা প্রয়োগের জন্য দুটি আলাদা ধারকে রাখা দ্রবণ ও দ্রাবক একত্রে মেশাতে হতো এবং অল্প সময়ের মধ্যে তা টিকাগ্রহীতাকে গ্রহণ করতে হতো। দুই ঘণ্টা পর এই মিশ্রণের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেত। তা ছাড়া টিকার দুটি উপাদানই ফ্রিজে ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হতো। প্রয়োগ করার আগমুহূর্তে ফ্রিজ থেকে বের করে সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে খাইয়ে দিতে হতো। তার ওপর এর দুটি ডোজ নিতে হতো কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে। এসব কারণে মাঠপর্যায়ে টিকাটি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করাটা অসুবিধাজনক ছিল। অন্তত সেকালে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে এ সমস্যা ছিল আরও ব্যাপক। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত শ্যানকল নামে একটি টিকা ভারতীয় গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। এই টিকা তুলনামূলক সহজে প্রয়োগের সম্ভাবনা ছিল। এ সম্ভাবনা ফিরদৌসী কাদরীকেও নাড়া দেয়। তিনি এমন কিছু করার কথা ভাবেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহায়তায় বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করেন তিনি। উদ্দেশ্য, কীভাবে এই টিকার সুফল বাংলাদেশ পেতে পারে। তাঁর এ উদ্যোগের ফলে এক মাসের মধ্যে ঢাকায় একটি বিশাল সম্মেলন হয়। সেই সম্মেলনে শুধু বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি, দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য টিকা বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী এবং পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতার ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেন এমন ব্যক্তি—সবাই উপস্থিত ছিলেন। সেই সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা ও গবেষণার জন্য যে ফান্ড পাওয়া গেল, তা নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল ফিরদৌসী কাদরী ও তাঁর দল।
বাংলাদেশের শহুরে বস্তি এলাকার অনেকগুলো পরিবারকে তিনটি ক্লাস্টারে ভাগ করে গবেষণাটি করা হলো। একটি ক্লাস্টারে শুধু টিকা দেওয়া হলো; দ্বিতীয় ক্লাস্টার টিকার পাশাপাশি নিরাপদ পানি এবং হাত ধোয়ার সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ পেল; আর তৃতীয় ক্লাস্টার ছিল কন্ট্রোল গ্রুপ, অর্থাৎ তাদের জীবনযাত্রায় কোনো হস্তক্ষেপ করা হলো না। প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের ওপর এ গবেষণা করা হলো। তাতে দেখা গেল, এক বছরের ওপরে যে কাউকে এই টিকা দেওয়া যায়। তবে এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দুটি ডোজ দেওয়া বাধ্যতামূলক। আর পাঁচ বছরের ওপরে যেকোনো বয়সের মানুষের জন্য একটি ডোজই যথেষ্ট। ফ্রিজের বাইরেও এটি রাখা যায়, এমনকি ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখলেও ১৪ দিন পর্যন্ত কার্যকারিতা কমে না। এই টিকা আগে থেকে মেশানো দ্রবণ হিসেবে থাকে, ডুকোরালের মতো মিশিয়ে প্রয়োগ করা লাগে না। ফলে কলেরার টিকা মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের জন্য যেসব বাধাবিপত্তি ছিল, ফিরদৌসী কাদরী ও তাঁর দলের গবেষণায় এর অনেকখানি দূর হলো। এ গবেষণা শুধু বাংলাদেশে নয়, আফ্রিকার অনেক দেশ, যেখানে গরম অনেক বেশি এবং সুযোগ-সুবিধা অনেক কম, সেখানেও চমৎকার সফল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফিরদৌসী কাদরীর গবেষণার ভিত্তিতে কলেরা টিকার গাইডলাইন প্রস্তুত করে। যদিও নিরাপদ পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ ও হাত ধোয়ার স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে কলেরার টিকার প্রয়োজন হয় না, তবু বাংলাদেশের মতো বন্যাপ্রবণ এলাকায় তা সব সময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এর চেয়ে বরং টিকা অনেক বেশি সাশ্রয়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, উভয় পদ্ধতি একই সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না হলে শুধু টিকা প্রয়োগ করেও বড় বিপদ এড়ানো যেতে পারে।
উল্লিখিত গবেষণার ফল সম্প্রতি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতে কত বড় বিপদ ঠেকিয়ে দিয়েছে, তা বলে বোঝানো মুশকিল। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ট্র্যাজেডি হলো, তাঁরা তাঁদের কাজ ঠিকমতো করলে মানুষ বুঝতেই পারে না যে কিছু একটা করা হয়েছে! বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইসিডিডিআরবি, ফিরদৌসী কাদরীসহ অনেকের প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও এর আশপাশের এলাকায় অতি দ্রুত প্রায় শতভাগ মানুষকে কলেরার টিকা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। ধরে নিন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কলেরা টিকা দেওয়া হয়নি, তাহলে কী হতো? এই বিতাড়িত অসহায় মানুষগুলো যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে আশ্রয় নেন, তখন রাতারাতি তো আর স্বাস্থ্যসম্মত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নিরাপদ খাওয়ার পানি থেকে স্যানিটারি ল্যাট্রিন—কোনোটাই পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল না। তার ওপর শিক্ষার অভাব। পর্দার আড়ালে যাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে, তাঁদের দ্রুত ও সুচিন্তিত উদ্যোগে এই বিশাল জনগোষ্ঠী যদি কলেরার টিকা না পেত, তাহলে যে মহামারি সৃষ্টি হতে পারত, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
বর্তমানে আইসিডিডিআরবির আটতলায় ফিরদৌসী কাদরীর গবেষণাগারে কাজ করছেন একঝাঁক তরুণ গবেষক। তাঁদের কেউ কলেরা, কেউবা টাইফয়েড, কেউ আবার এন্টারোটক্সিজেনিক ই. কোলাইয়ের নাড়িনক্ষত্র উদঘাটনে ব্যস্ত। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ অতিমারি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার সুযোগ নেই। তাই তাঁর গবেষণাগারে যিনি যেটা নিয়েই কাজ করুন না কেন, সবাইকে একটা ফুরসত বের করে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে কোভিড নিয়েও। নিয়মিত কাজের পাশাপাশি চলছে কোভিড নিয়ে গবেষণা। সম্প্রতি আইসিডিডিআরবির গবেষণায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে অর্ধেকের বেশি মানুষের দেহে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা কমে যায়, সেটাও দেখা গেছে। তাহলে কি গোষ্ঠীগত অনাক্রম্যতা বা হার্ড ইমিউনিটি সম্ভব? অর্থাৎ যে পর্যায়ে একটা নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষের দেহে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠার কারণে তা আর ছড়ায় না এবং অতিমারির অবসান হয়, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ কি আদৌ আসবে?
ফিরদৌসী কাদরীর মতে, এই প্রশ্নের জবাব খুব সোজাসাপটাভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। কোনো অ্যান্টিজেনের (এ ক্ষেত্রে SARS- CoV- 2 বা এর টিকা) বিরুদ্ধে শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, এর মাত্রা স্বাভাবিক নিয়মে একসময় কমে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা পাওয়া যাবে কি না, তা নির্ভর করে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার একজাতীয় কোষ, মেমোরি সেলের ওপরে। এই কোষগুলো এমনিতে খুব বেশি সংখ্যায় থাকে না, তবে কোন সংক্রমণের বিরুদ্ধে কেমন অ্যান্টিবডি কার্যকর, সেটা ‘মনে’ রাখে। সেই একই অ্যান্টিজেন বা জীবাণু আবার শরীরে ঢুকলে তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা নিতে পারে এসব মেমোরি সেল। প্রথমবারের সংক্রমণ, যখন তার বিরুদ্ধে তখনো মেমোরি সেল তৈরি হয়নি, সেই তুলনায় পরবর্তী সময়ে হওয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা হয় তাৎক্ষণিক। কেননা মেমোরি সেল থাকে। অনেক সময় আমরা লক্ষণটাও বুঝতে পারি না। তার আগেই অ্যান্টিজেনের বিনাশ হয়। যদিও কোভিডের প্রাকৃতিক সংক্রমণ কিংবা টিকা—উভয়ভাবেই মেমোরি সেল তৈরি হতে দেখা গেছে, তবু প্রাকৃতিক সংক্রমণের মাধ্যমে সুরক্ষার ব্যাপারটি অনেক বেশি র্যান্ডম। কারও বেশি কারও কম, কারও একেবারেই হয় না। সেই তুলনায় টিকার মাধ্যমে অ্যান্টিবডি ও মেমোরি সেল তৈরি হওয়ার নিশ্চয়তা অনেক। এমনকি টিকা যদি এক শ ভাগ সুরক্ষা না–ও দেয়, তবু শেষ পর্যন্ত টিকাতেই সমাধান। আরও বেশি বেশি ভেরিয়েন্ট বা প্রকরণের উদ্ভব ঘটার আগেই পুরো পৃথিবীকে টিকার আওতায় আনতে হবে। এটা কোনো বিশেষ দেশ বা এলাকার জনগোষ্ঠীকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হবে না। কোনো দেশে শতভাগ টিকা প্রদান করে কোনো লাভ নেই, যদি টিকাবঞ্চিত এলাকায় নতুন প্রকরণ জন্ম নিতে থাকে। তাহলে কোনো একটা পর্যায়ে সেই টিকাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী পুনরায় নতুন প্রকরণের শিকার হবে। বিশ্বায়নের যুগে এটা অবশ্যম্ভাবী। যতক্ষণ না পৃথিবীর সবাই সুরক্ষিত, ততক্ষণ কেউই সুরক্ষিত নয়। ফিরদৌসী কাদরীর আশা, যাতে এ সত্য বিশ্বনেতারা দ্রুত উপলব্ধি করেন।
সংক্রামক রোগের পাশাপাশি অসংক্রামক রোগ নিয়েও কাজ করেছেন ফিরদৌসী কাদরী। গল্পের শুরু গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে ক্রিস্টফ রডল্ফ গ্র্যান্ড প্রাইজ নামক একটি পুরস্কার পাওয়া থেকে। টাকার অঙ্কটা নেহাত কম ছিল না। ফিরদৌসী কাদরীর ভাষায়, ‘তখন তো টাকা ছিল না, তবে কম্পিউটারে ফাইল ছিল।’ তখন চেষ্টা ছিল কীভাবে দেশেই প্রাইভেট উদ্যোগে গড়ে তোলা যায় একটি উন্নত গবেষণাগার। যেখানে হবে ফলিত চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা। যে গবেষণা সরাসরি দেশের মানুষের কাজে লাগবে। শেষে যখন সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির সুবাদে সাধ ও সাধ্যের বিবাদ মিটল, তখন তিনি হাত দিলেন তাঁর বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে। জাতীয় অধ্যাপক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খানের বাসায় ফিরদৌসী কাদরীসহ বাংলাদেশের চিকিৎসা-গবেষণা পরিমণ্ডলের অনেক নক্ষত্র আড্ডা দিতেন। সেখান থেকে প্রাইভেট গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য কমিটি গঠন করা হলো। নাম ঠিক করা হলো ‘আইদেশি’ (ideSHi), যা ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথের সংক্ষিপ্ত রূপ। মজার ব্যাপার হলো, প্রতিষ্ঠানটির এই চমৎকার নাম দিয়েছেন তরুণ গবেষকেরা। সেটাও একটি আড্ডায় ঠিক করা হয়। এভাবে ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে আইদেশি। শুরুতে সরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মেডিকেল বায়োটেকনোলজির ভবনে গবেষণাগার শেয়ার করলেও বর্তমানে একটি বাণিজ্যিক ভবনে নিজস্ব পৃথক স্পেস রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
আইদেশির উদ্যোক্তা হিসেবে ফিরদৌসী কাদরীর গল্পটা নিয়ে একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করা যেতে পারে। ঠিক করা হলো, আইদেশিতে জিনগত ব্যাধি নিয়ে গবেষণা করা হবে। কেননা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এগুলো নিয়ে গবেষণা বাংলাদেশে খুব একটা হয় না। অথচ অনেক শিশুর জন্ম থেকে এমন সব জিনগত সমস্যা থাকে, যা দেরিতে ধরা পড়া কিংবা একেবারে শনাক্ত না হওয়ায় সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। এতে তাদের অকালমৃত্যু হয় কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। তা ছাড়া এসব রোগ নির্ণয় করার জন্য বিদেশে যাওয়া অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে। তাই নবজাতকের নিউরোমেটাবলিক স্ক্রিনিং হিসেবে উন্নত বিশ্বে যে ২২টি পরীক্ষা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে রুটিনমাফিক করা হয়, তা বাংলাদেশে চালু করার উদ্দেশ্যে গবেষণা শুরু করা হলো। তা ছাড়া জিনগত রক্তস্বল্পতা, যেমন থ্যালাসেমিয়া ও হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজ দেশের কত ভাগ মানুষের মধ্যে আছে এবং কারা না জেনেই তা বয়ে বেড়াচ্ছেন, সেসব জানার জন্যও আইদেশি গবেষণা করেছে। এ রকম দুজন বাহক যদি মা–বাবা হন, তখন তাঁদের প্রতিটি সন্তানের অন্তত ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে সেই অসুখ নিয়ে জন্মানোর। আর ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তানেরাও অজান্তে রোগটির জিনগত বাহক হন। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বেঁচে থাকার জন্য আজীবন রক্ত নিতে হয় এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে ঘন ঘন রক্ত নেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আবার নানা শারীরিক জটিলতায় পড়তে হয়। এর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাধারণত ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলে একটি জটিল মিউটেশনের কারণে এ ধরনের অসুখ বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশ এর মধ্যে পড়ে। আইদেশি ও ফিরদৌসী কাদরীর গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এই মারাত্মক অসুখ প্রতিরোধের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। অবশ্য কোভিড পরিস্থিতির কারণে সে কার্যক্রম বর্তমানে কিছুটা বাধাগ্রস্ত।
সব্যসাচী গবেষক ফিরদৌসী কাদরী কাজ করেছেন সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার সঙ্গে। কাজের অভিজ্ঞতায় এ ক্ষেত্রে কোনো হেরফের হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার যেমন কিছু সুবিধা আছে, আবার অসুবিধাও আছে। একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেও। একটি বিষয় তাঁর বিশেষভাবে ভালো লেগেছে, বাংলাদেশ সরকার খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকারের সহায়তা ছাড়া বড় মাপের প্রকল্প, যেমন কলেরার টিকা নিয়ে গবেষণা সম্ভব হতো না। তিনি চাইলেই সবার সহযোগিতা পেয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই। এমনকি যখন তাঁর এত পরিচিতি ছিল না, তখনো তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন অনেকে। এ জন্য তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। তাই গবেষণার বেলায় তাঁর ভাষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কোলাবরেশন, কোলাবরেশন ও কোলাবরেশন।
আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় নারী হিসেবে যেকোনো পেশায় সাফল্যের শিখরে উঠতে হলে পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, এ ব্যাপারে ফিরদৌসী কাদরী একমত। শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই কমবেশি এটি প্রযোজ্য। তবে তিনি এটাও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে একটি সুবিধা আছে, যেটা হলো পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা। পরিবারই অনেক সময় এখানে নারীর বিকাশে বাধা হতে পারে, এটা ঠিক। অন্যদিকে সন্তানের দেখাশোনা করার জন্য দাদি-নানিদের যে ভূমিকা সাধারণভাবে বাংলাদেশি পরিবারগুলোতে দেখা যায়, তা না থাকলে নারীদের পক্ষে ক্যারিয়ার গড়া অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়। মা-বাবার কর্মব্যস্ততার মধ্যে তিনি নিজেও নানির হাতে মানুষ হয়েছেন। এটা সব সময় গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন ফিরদৌসী কাদরী। কাজের সময় নিজের পুরোটা দিয়ে যেমন মনেপ্রাণে গবেষক হয়ে উঠতে হবে, তেমনি বাড়ি ফিরে পরিবার ও সন্তানদের সঙ্গেও কোয়ালিটি সময় কাটাতে হবে। দুটিই গুরুত্বপূর্ণ।
ফিরদৌসী কাদরী গবেষণাগারের ভেতরে নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ করেন না। অবশ্য কখনো যদি কোনো নারী গবেষককে অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাবে কাজ করতে হয়, তাহলে সেই গবেষক যাতে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে কখনো ভুল হয় না তাঁর। নারীদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করাটা সব জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। নিরাপত্তার পাশাপাশি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে শিশুদের দেখাশোনার জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে নারীরা আরও অনেক বেশি সংখ্যায় বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট পেশায় আসতে আগ্রহী হতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।
কীভাবে তরুণ গবেষকেরা ফিরদৌসী কাদরীর সঙ্গে কাজ করতে পারেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাইকে নিতে চাই, কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।’ বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণায় আরও অগ্রগতি হোক, তরুণ গবেষকদের কাজের ক্ষেত্র বাড়ুক। কোভিড-১৯ অতিমারি যেমন মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কারণ হয়েছে, অন্যদিকে তা স্বাস্থ্য গবেষণার গুরুত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এখন দেশের আনাচকানাচে পিসিআর ল্যাব পৌঁছে গেছে। অনেকগুলো কেন্দ্রে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে। এগুলো যেন হারিয়ে না যায়। উদ্যোগগুলো যেন থেমে না যায়। সুযোগ-সুবিধা যেন উত্তরোত্তর বাড়ানো হয়। তাহলে আইসিডিডিআরবিতে যদি সবাই কাজের সুযোগ না-ও পান, তবু তরুণ গবেষকেরা দেশে থেকে গবেষণা করে দেশটাকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
এশিয়ান সায়েন্টিস্ট–এর সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় যাঁদের নাম এসেছে, তাঁরা কেউই নিজে থেকে আবেদন করেননি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজেদের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের কাজ অনলাইনে যাচাই-বাছাই করে তালিকাটি প্রস্তুত করেন। তাই এটা ফিরদৌসী কাদরীর কাছে একটা সারপ্রাইজ ছিল। খবর পেয়ে তিনি একই সঙ্গে বিস্মিত ও আনন্দিত হন। তবে তাঁর মতে, বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। ভারত থেকে যেখানে বিশের অধিক বিজ্ঞানীর নাম ওই তালিকায় এসেছে, সেখানে বাংলাদেশ থেকে আছে তিনজনের নাম। ফিরদৌসী কাদরী বলেন, ভারত বেশ বড় একটা দেশ, সে হিসেবে বিজ্ঞানীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু তারপরও তাঁরা যেভাবে গবেষণার অর্থায়ন, অন্যান্য প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা সরকারিভাবে পান; সে তুলনায় আমাদের দেশে সুযোগ-সুবিধা এখনো অপ্রতুল। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। এ প্রক্রিয়া যেন চলমান থাকে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে দেশীয় গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা