নিকোলা টেসলা : বিদ্যুৎ যুগের স্থপতি

আজ উদ্ভাবক নিকোলা টেসলার জন্মদিন। তাঁর জন্ম বর্তমান ক্রোয়েশিয়ায়। ১৮৮২ সালে তিনি এডিসন কোম্পানির প্যারিস শাখায় যোগ দেন। প্রথমবারের মতো অল্টারনেটিং কারেন্ট (এসি) ইন্ডাকশন মোটর তৈরি করেন ১৮৮৩ সালে। এডিসন কোম্পানির প্যারিস শাখার ম্যানেজার চার্লস ব্যাচেলর যখন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন, তখন তিনি টেসলাকে এখানে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেন। ফলে টেসলা যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন ১৮৮৪ সালে। এসে যোগ দেন এডিসন পাওয়ার কোম্পানিতে।

তখনকার পরিস্থিতির কথা যদি ভাবেন, ২৮ বছরের তরুণ টেসলা যখন যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখেন, সেখানে তখন সমৃদ্ধির জোয়ার বইছে। সবাই প্রাণপণে কাজ করছে শিল্প কারখানায়। কিন্তু এ সবই হতো দিনের বেলা। কিন্তু, সূর্য ডোবার সাথে সাথেই থেমে যেত সমৃদ্ধির এ চাকা। অন্ধকারে ডুবে যেত গোটা যুক্তরাষ্ট্র। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত মোমবাতি আর লণ্ঠনের মৃদু আলো। টমাস আলভা এডিসন তখন প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে বৈদ্যুতিক বাল্ব উৎপাদন শুরু করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে শুধু বৈদ্যুতিক বাল্ব পৌঁছে দিলেই তো হবে না, পৌঁছে দিতে হবে বিদ্যুৎ সংযোগও।

এডিসনের বাতি জ্বলত ডিরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) দিয়ে। আমাদের পরিচিত উদাহরণ হলো, ব্যাটারি। ব্যাটারিতে ডিসি কারেন্ট থেকে। এ জিনিস অনেক বিশাল এলাকাজুড়ে তো ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পড়ে টেসলার ঘাড়ে। এর পেছনেও গল্প আছে। টেসলা ততদিনে সম্ভাব্য কিছু সমাধান ডিজাইন করেও দিয়েছেন এডিসন মেশিন ওয়ার্কস কোম্পানিকে। কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানো হয়নি, সম্ভবত আর্ক লাইটিং কোম্পানির সঙ্গে আরেকটি চুক্তি থাকার কারণে। সে যা-ই হোক, টেসলা দ্রুতই সমস্যা সমাধান করে ফেললেন। তারপরেই গোল বাঁধল। চাকরি ছেড়ে দিলেন টেসলা।

এই ঝামেলার ব্যাপারে পরবর্তীতে জানা গেছে ভাসাভাসাভাবে। নিজের আত্মজীবনীতে টেসলা লিখেছেন, এডিসন মেশিন ওয়ার্কসের ম্যানেজার তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি এ সমস্যা সমাধান করতে পারো, তাহলে তোমাকে ৫০ হাজার ডলার বোনাস দেওয়া হবে।’ কাজটা ছিল ২৪টি ভিন্ন ধরনের আদর্শ মেশিন বানানো। কাজ শেষে টেসলা যখন বোনাস চাইলেন, তাঁকে বলা হয়, ‘তুমি দেখি আমাদের মার্কিন কৌতুক বোঝ না!’ এখানে মার্কিন কৌতুক বলার কারণ, টেসলা জন্মসূত্রে মার্কিন নন। এই গল্পের আরেকটি ভার্সনে জানা যায়, স্বয়ং এডিসন তাঁকে ৫০ হাজার ডলার বোনাস দিতে চেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি টেসলাকে এই জবাব দেন। বলে রাখা ভালো, মার্ক জে. সিফারের লেখা টেসলার এক জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, আগেও তাঁকে নানা সময়ে বোনাস দেওয়ার কথা বলে দেওয়া হয়নি। টেসলার ডায়েরিতে এ বিষয়ে শুধু একটি বাক্য লেখা আছে। ‘গুড বাই টু দ্য এডিসন মেশিন ওয়ার্কস।’

এডিসনের বাতি জ্বলত ডিরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) দিয়ে। আমাদের পরিচিত উদাহরণ হলো, ব্যাটারি। ব্যাটারিতে ডিসি কারেন্ট থেকে। এ জিনিস অনেক বিশাল এলাকাজুড়ে তো ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পড়ে টেসলার ঘাড়ে।

চাকরি ছেড়ে দিয়ে টেসলা এবার নিজেই কিছু করার চেষ্টায় নামেন। ইচ্ছে, একটি কোম্পানি বানাবেন। সেজন্য তো টাকা লাগবে। কোথায় পাবেন টাকা? টাকার জন্য নিত্য-নতুন জিনিস বানাতে লাগলেন তিনি, পেটেন্ট করতে লাগলেন একের পর এক। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে সবখানে। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স টেসলাকে তখন একটা লেকচার দিতে নিমন্ত্রণ করেন। সেই লেকচারেই টেসলার পরিচয় হয় জর্জ ওয়েস্টিংহাউজের সঙ্গে। ওয়েস্টিংহাউজ ছিলেন এডিসনের অন্যতম প্রতিদ্বন্ধী। তিনি টেসলাকে নিজের কোম্পানিতে কাজ করার প্রস্তাব দেন। দুজনে মিলে এসি কারেন্ট নিয়ে শুরু করেন গবেষণা। পরে জর্জ ওয়েস্টিংহাউজের সঙ্গে মিলে নায়াগ্রা ফলস ক্যাটারাক্ট কনস্ট্রাকশন কোম্পানির জন্য নায়াগ্রা জলপ্রপাতের এখানে বৈদ্যুতিক পাওয়ার কোম্পানি তৈরি করেন। এটি নিউইয়র্কের বাফেলো শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত।

এডিসন নানা ধরনের চেষ্টা-চরিত্র করেও ঠেকাতে পারেননি টেসলাকে। টেসলা ঠিকই প্রতিষ্ঠা করেন দ্য নিকোলা টেসলা কোম্পানি। কিন্তু পরবর্তীতে ওয়্যারলেস সিস্টেমসহ নানা ধরনের গবেষণায় তিনি বহু টাকা খরচ করে ফেলেন। এসব প্রজেক্টে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সফল হতে পারেননি তিনি।

এডিসন যেখানে কুকুরকে বিদ্যুৎ শক দিয়ে মেরে ফেলছেন (এটা অবশ্য এসি কারেন্ট দিয়ে মেরেছিলেন মানুষকে বোঝাতে যে এসি কারেন্ট নিরাপদ নয়), বা টপসি নামের হাতিকে বৈদ্যুতিক শকে খুন করা নিয়ে বানাচ্ছেন ডকুমেন্টরি শর্টফিল্ম, টেসলা সেখানে মানুষকে বলছেন, এসি কারেন্ট নিরাপদ। এটি বাসা–বাড়িতে ব্যবহার করা যাবে চাইলেই। বর্তমানে প্রায় সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এসি কারেন্টে চলে। আমাদের বাসা-বাড়ি, অফিস ইত্যাদি সবখানেই ব্যবহৃত হয় এসি কারেন্ট। মোবাইলের মতো ক্ষুদে যন্ত্রপাতি ব্যাটারি চালিত হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এজন্য এসি কারেন্টকে ডিসি কারেন্টে রূপান্তরিত করা হয়। শুধু ডিসি কারেন্ট দিয়ে চলার মতো খুব বেশি যন্ত্র এখন আসলে আর নেই।

এডিসন নানা ধরনের চেষ্টা-চরিত্র করেও ঠেকাতে পারেননি টেসলাকে। টেসলা ঠিকই প্রতিষ্ঠা করেন দ্য নিকোলা টেসলা কোম্পানি। কিন্তু পরবর্তীতে ওয়্যারলেস সিস্টেমসহ নানা ধরনের গবেষণায় তিনি বহু টাকা খরচ করে ফেলেন। এসব প্রজেক্টে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সফল হতে পারেননি তিনি। সেজন্য পরবর্তীতে ফান্ডিং পাননি সেভাবে। এডিসনও স্যাবোটাজ করেছেন। সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা পরের দিকে এসে বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়। তাঁর অনেক প্যাটেন্ট চুরিও হয়ে যায়। প্রায় এক হাজারের বেশি উদ্ভাবন করেছেন, কিন্তু বর্তমানে তাঁর ২৭৮টির মতো প্যাটেন্টের খবর পাওয়া যায়।

শেষ জীবন প্রচণ্ড দারিদ্রে কাটে টেসলার। ৮৬ বছর বয়সে, ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি এই গুণি উদ্ভাবক মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক : শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র

১. মাই ইনভেনশনস : দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব নিকোলা টেসলা, নিকোলা টেসলা

২. প্রোডিগাল জিনিয়াস : দ্য লাইফ অব নিকোলা টেসলা, জন জে. ও’নিল

৩. টেসলা : ইনভেন্টর অব দ্য ইলেকট্রিক্যাল এজ, ডব্লিউ বার্নার্ড কার্লসন

৪. উইকিপিডিয়া