পর্দা নামল ১৫তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের

পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

শেষ হলো ১৫তম বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্ব। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রাজধানীর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশে (এআইইউবি) আয়োজিত হয় এ পর্ব। চার ক্যাটাগরিতে মোট ১৮৮ শিক্ষার্থীকে জাতীয় পর্বে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার হিসাবে তুলে দেওয়া হয় টি-শার্ট, সনদপত্র, মেডেল, ট্রফি এবং বই।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরীক্ষার্থীরা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের মধ্যেই উপস্থিত হয় ক্যাম্পাসে। জাতীয় পর্বের পরীক্ষা শুরু হয় সকাল ৯টায়। একটানা দুই ঘণ্টা, অর্থাৎ বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে পরীক্ষা। ১১টা ৩০ মিনিটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য পরীক্ষার্থীরা জড়ো হয় মাঠে। এরপর জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।

পরীক্ষার্থীরা মাঠে জেলা অনুযায়ী সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড ন্যাচারাল সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান আ ফ ম ইউসুফ হায়দার। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অ্যান্ড নেপাল অক্সফোর্ড একিউএ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. শাহিন রেজা, পিয়ারসন বাংলাদেশের আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপক জান্নাতুল ফেরদৌস সিগমা, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দলের কোচ আরশাদ মোমেন, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান এবং ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর মাসুদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এআইইউবির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহমান।

অতিথিরা শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে ১৫তম বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন

আ ফ ম ইউসুফ হায়দার বলেন, ‘সারা দেশের ১০ হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে তোমরা মাত্র ১ হাজার ৪০০ জন ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বে অংশগ্রহণের গৌরব অর্জন করেছ। তোমাদের অভিনন্দন। নিজেদের মধ্যে সব সময় নতুন কিছু জানার আগ্রহ রাখবে।’

অধ্যাপক আরশাদ মোমেন বলেন, ‘আশা করি, প্রশ্ন বেশি কঠিন ছিল না। আমরা প্রতি বছর চেষ্টা করি সহজ প্রশ্ন রাখতে, কিন্তু এখন প্রশ্নপত্রের ভাণ্ডারে কেবল কঠিন প্রশ্নগুলোই অবশিষ্ট আছে। কখনো নিরাশ হবে না। একসময় জয়যুক্ত হবে।’

অতিথিরা দাঁড়িয়ে, বক্তব্য দিচ্ছেন অধ্যাপক আরশাদ মোমেন

পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে মুনির হাসান বলেন, ‘তোমরা নিজেদের তিনটি প্রশ্ন করবে। প্রথমটি হলো, তোমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় কোনটি? এর উত্তর—বর্তমান। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, তোমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে? এর উত্তর—তোমার পাশে যে মানুষটি আছে, সে। আর শেষ প্রশ্নটি হলো, তোমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিৎ? এর উত্তর—যে তোমার পাশে আছে, সেই মানুষটির জন্য ভালো কিছু করা। এই তিনটি কথা মনে রাখলে জীবন হবে সহজ ও সুন্দর।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের বক্তব্যের পর তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বের স্মারক। এরপর অতিথিরা শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে ১৫তম বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের পরীক্ষার্থীদের একাংশ

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সমাপ্তির পর বিরতি শেষে দুপুর ২টায় শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। চলে এক ঘণ্টা। পর্বটি অনুষ্ঠিত হয় এআইইউবির মুক্ত মঞ্চে। এ পর্বে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেন আইইউবির অধ্যাপক আরশাদ মোমেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। আরও ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ডেটা অ্যান্ড সায়েন্সেসের ডিন অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করে, ‘আমরা কখনো আইনস্টাইনের মতো থিওরি তৈরি করতে পারব?’ ‘আমরা কখনো থিওরি অব এভরিথিং পাব কি?’—এরকম একের পর এক প্রশ্ন করে চলে শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ আবার কাগজে লিখে প্রশ্ন জমা দেয়।

এরপর শিক্ষার্থীরা উপভোগ করে চমৎকার সব ম্যাজিক। ম্যাজিক শো শেষে জাদুকর শিক্ষার্থীদের দুটি ম্যাজিকও শিখিয়ে দেন। এরপর হারমোনিয়াম ও গিটারের তালে কিছু গান উপভোগ করে শিক্ষার্থীরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে বিকেলে শুরু হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বহুল প্রতীক্ষিত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অতিথিরা

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও পদার্থবিদ এম আমিনুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার, অধ্যাপক আরশাদ মোমেন এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। এই পর্বে সভাপতিত্ব করেন এআইইউবির ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক শফিউল ইসলাম।

ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর মাসুদ সমাপনী অনুষ্ঠানে পরবর্তী ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বের ভেন্যু ঘোষণা করেন। জানা যায়, এটি অনুষ্ঠিত হবে কক্সবাজার। এরপর তিনি ৫৪তম আন্তর্জাতিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে রৌপ্যসহ দুই পদক প্রাপ্ত পাঁচজনকে মঞ্চে ডেকে নেন। অতিথিদের কাছ থেকে মেডেল গ্রহণ করেন তাঁরা।

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বক্তৃতা করছেন

এরপর শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের অতিথিদের বক্তব্য। প্রথমে বক্তব্য রাখেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। তিনি অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মজার কৌতুক বলে নিজের বক্তব্য শুরু করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘তোমরা সেই সকালবেলা এসেছ পরীক্ষা দিতে। দীর্ঘসময় ধরে তোমরা বিজয়ীদের নাম শোনার অপেক্ষায় রয়েছে। তোমরা কারা কারা কিশোর আলো পড়ো?’ প্রশ্ন শুনে সব শিক্ষার্থী হাত তোলে। এরপর আনিসুল হক শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের স্থাপত্যবিজ্ঞানী ফজলুর রহমান খানকে (এফ আর খান) নিয়ে কিছু কথা বলেন।

অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার বলেন, ‘আমি এবারই প্রথম ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বে এসেছি। তোমাদের দেখে খুব ভালো লাগছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা হলো গণিত। তাই তোমাদের সেদিকেও খানিকটা মনোযোগ দিতে হবে।’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও পদার্থবিদ এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘দেশ তোমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। দেশের জন্য এবার তোমাদের কিছু করার পালা। দেশের জন্য তোমাদের ভালোবাসা থাকতে হবে। তোমরা যেখানে যে যেই অবস্থায় আছ, নিজের সাধ্যের মধ্যে কাজ করো। যে যেই ফিল্ডে কাজ করবে, সেখানে তোমাকে সেরা হয়ে উঠতে হবে।’

মেডেল প্রস্তুত

প্রধান অতিথির বক্তব্যের পর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। একে একে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। মঞ্চে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ হয় ১৫তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্ব।

এরপর জাতীয় উৎসবের বিজয়ীদের নিয়ে ক্যাম্প আয়োজন করা হবে। কয়েক ধাপের ক্যাম্প শেষে বাছাইকৃতদের নিয়ে গঠিত হবে ৫ সদস্যের বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দল। এই দল আগামী জুলাইয়ে ফ্রান্সে অনুষ্ঠেয় ৫৫তম আন্তর্জাতিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।

মাঠে সার বেঁধে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের একাংশ

দেশের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষ করে তুলতে ২০১১ সাল থেকে আয়োজিত হচ্ছে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। প্রথমে অনলাইনে বাছাইপর্ব শেষে আয়োজিত হয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের আঞ্চলিক পর্ব। ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, কক্সবাজার, বগুড়া ও কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ীদের নিয়ে আয়োজিত হয় জাতীয় পর্ব। এ অলিম্পিয়াড আয়োজন করে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটি।

ফিজিক্স অলিম্পিয়াড সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে bdpho.org ওয়েবসাইটে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ