‘প্রম্পট দিলেই ছবি বানিয়ে দিচ্ছে। কীভাবে এ কাজ করছে এআই? যে মানুষের অস্তিত্ব নেই, তার ছবি বানাচ্ছে কীভাবে? বা প্রকৃতির ছবি চাইলে কীভাবে বানাচ্ছে?’ প্রশ্ন করেন সরকারি বাংলা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এমন হাজারও প্রশ্ন রয়েছে আরও অনেকের। তবে এরকম প্রশ্ন করার সুযোগ বারবার আসে না। আজ এসেছে। এই প্রশ্নোত্তর যেখানে চলছে, সেখানে মূলত কথা শুনতে, জানতেই এসেছে মানুষ।
ঘটনাস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে। সময়রেখা ধরে খানিকটা পেছনে ফিরে বরং ঘটনার শুরুতে যাওয়া যাক।
বিজ্ঞান বক্তৃতা শুনতে একদল মানুষ চলে এসেছে সময়ের আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে পা রেখে চমকে যেতে হয়। দিনটা বৃহস্পতিবার, কর্মদিবস। পড়ন্ত বিকেল। বক্তৃতা শুরু হবে বিকেল চারটায়। অথচ মিলনায়তনটি প্রায় ভরে গেছে। উপস্থিত কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে আলাপ করছে, হাসতে দেখা যাচ্ছে কাউকে কাউকে। প্রায় সবার হাতেই দেখা গেল ম্যাগাজিন। কেউ কেউ পাতা উল্টেপাল্টে দেখছেন মনোযোগ দিয়ে। ম্যাগাজিনটির নাম: বিজ্ঞানচিন্তা।
হ্যাঁ, আজকের এই বিজ্ঞান বক্তৃতা আয়োজন করেছে বিজ্ঞানচিন্তা। বক্তৃতা নিয়ে এত আগ্রহের কারণটি অবশ্য শুধু বিজ্ঞানবিষয়ক বক্তৃতা বা বিজ্ঞানায়োজন নয়। কারণ—এটি বিজ্ঞানে নোবেল বক্তৃতা। নোবেল লেকচার। প্রায় আট বছর ধরে নোবেল পুরস্কারের পরপর বিজ্ঞানচিন্তা এই আয়োজন করে। প্রতিবারই দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ—সবাই এসেছেন। নানা বয়সী মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন বিজ্ঞানের কথা শুনতে। এ মঞ্চে বক্তব্য রাখবেন খ্যাতনামা গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা। সে জন্যই এত আগ্রহ, এত উদ্দীপনা।
কদিন আগেই এ বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে। বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্ব। গোটা পৃথিবীর মানুষকে চমকে দিয়ে এবারে এর মধ্যে দুটি, অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর গবেষণার জন্য। স্বাভাবিকভাবে এ নিয়ে মানুষের অনেক প্রশ্ন, অনেক আগ্রহ। এরকমই একটি প্রশ্নের কথা বলেছি শুরুতেই।
অনুষ্ঠান শুরু হলো ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক চারটায়। বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ শুভেচ্ছা জানালেন সবাইকে, ধন্যবাদ জানালেন বিজ্ঞান বক্তৃতা এত আগ্রহ নিয়ে শুনতে আসার জন্য। তারপর মঞ্চে আসতে অনুরোধ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনপ্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুশতাক ইবনে আয়ূবকে।
এলেন তিনি। বললেন চিকিৎসা ও শারীরতত্ত্বে নোবেলের খুঁটিনাটি। এ শাখায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুনকে, মাইক্রোআরএনএ গবেষণার জন্য। জিন থেকে তৈরি হয় আরএনএ, আরএনএ থেকে প্রোটিন। ঠিক এ জায়গাতেই মাইক্রোআরএনএর কারিকুরি। বহুকোষী প্রাণীর দেহে কীভাবে জিন নিয়ন্ত্রণ হয়, সে বিষয়ক ধারণার খোলনলচে বদলে দিয়েছে তাঁদের গবেষণা।
এই কারিকুরির আদ্যোপান্ত বলে যান মুশতাক ইবনে আয়ূব। বলেন মাইক্রোআরএনএ কীভাবে বদলে দিচ্ছে টিকা তৈরিসহ আরও নানা ধরনের গবেষণা। ‘মাইক্রোআরএনএ ক্যান্সার চিকিৎসার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। এটি মূলত জিন থেকে আরএনএ তৈরির পর, আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির কাজে বার্তাবাহক ও নিয়ন্ত্রকের কাজ করে। ফলে মাইক্রোআরএনএ ব্যবহার করে চাইলে কোষের বৃদ্ধি থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। এর মানেই হলো, এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ক্যান্সারের মতো রোগ। আবার উল্টোভাবে নির্দিষ্ট কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ বা বাড়িয়ে তোলাও সম্ভব এর মাধ্যমে। ডায়াবেটিসসহ প্রাণঘাতি বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে আজ মাইক্রোআরএনএ ব্যবহৃত হচ্ছে। করোনার টিকা এর আদর্শ উদাহরণ।’
তাঁর কথায় ফুটে ওঠে বিজ্ঞানের নতুনভাবে পথচলার কথা। জানা যায় ক্যান্সারসহ আরও অনেক রোগের পেছনে সিমুলেশনের মতো বিষয়গুলোর ভূমিকা।
এরপর মঞ্চে আসেন অধ্যাপক বিএম মইনুল হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক তিনি। প্রথমেই ধন্যবাদ দেন বিজ্ঞানচিন্তাকে। নিজে থেকেই বলেন, ‘এ আয়োজন তো আমাদের করার কথা, অথচ বিজ্ঞানচিন্তা করছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।’ কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ এআই অলিম্পিয়াড দলের দলনেতা হিসেবে গিয়েছেন সৌদি আরবে। দলের দুই সদস্য পেয়েছে ব্রোঞ্জ, বাকি দুজন পেয়েছে রৌপ্যপদক। দেশের বাইরে যখন বাংলাদেশের পতাকা উঠে আসে পর্দায়, শোনা যায় জাতীয় সঙ্গীত, এ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা—বলেন তিনি। নিজের এ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বহিঃবিশ্বে এআই গবেষণার চাহিদা তুলে ধরেন। শোনান আশার কথা, ‘এখন একটি ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই এআই নিয়ে কাজ করা যায়। বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গের হাতেও আজ এই প্রযুক্তি, আমাদের হাতেও তা-ই। প্রথাগত গবেষণাগারের মতো অনেককিছুর প্রয়োজন হয় না এখানে। তাই এখন আর অজুহাত দেওয়ার সুযোগ নেই। এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।’
তাঁর কথায় উঠে আসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর গবেষণায় নোবেল পুরস্কার প্রদানের কারণ। ‘বুদ্ধিমত্তা এমন এক জিনিস, যেটা কৃত্রিম হলেও আমাদের মেনে নিতে হয়। অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। এআই বা কম্পিউটার কিন্তু এই প্রথম মানুষের চেয়ে ভালো কাজ করছে, তা নয়। আগেও ক্যালকুলেটর মানুষের চেয়ে দ্রুত হিসাব করতে পারত। দিনশেষে এগুলোর সবই মানুষের সহযোগী। একে প্রতিপক্ষ না ভেবে সহযোগী ভেবে এগোতে হবে। এ নিয়ে গবেষণা ও জনসচেতনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।’
তাঁর উপস্থাপনায় সহজভাবে উঠে আসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভেতরের কথা। আগ্রহী দর্শক-শ্রোতা তা শুধু শোনেই না, পাল্টা প্রশ্নও ছুড়ে দিতে চায়। এরকম একটি প্রশ্নের কথা শুরুতে বলেছি, যার উত্তরে অধ্যাপক মইনুল হোসেন বলেন, ‘ক্রিকেট বা ফুটবল গেমগুলো আগে কার্টুনের মতো ছিল। এখন দেখে বোঝার উপায় নেই, এগুলো গেম নাকি বাস্তব খেলার ভিডিও। প্রচুর ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এআইকে। উদাহরণ দেখে সে শেখে। নোম চমস্কির ভাষায়, নকল করে। তার মানে, সব নকল করা আসলে খারাপ নয়! তবে গবেষণায় নকল করা যাবে না।’
‘উদাহরণ দেখে যদি শেখেই, তবে এআই হিউমার বা জোক বোঝে না কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন উন্মাদ-এর লেখক অর্পন দাস গুপ্ত।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রসিকতা না বোঝার কারণ বুঝিয়ে বলেন অধ্যাপক। বলেন, ‘জোক বা রসিকতা বুঝতে সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর বোঝাপড়া থাকতে হয়। এআইয়ের হাতে এখনো পরিস্থিতি ও সংস্কৃতি বোঝার মতো তথ্য নেই।’
গভ. সায়েন্স কলেজের শিক্ষার্থী প্রত্যাশার কন্ঠে ফুটে ওঠে উদ্বেগ। তিনি জানতে চান, ‘এআইয়ের অনেক ভালো দিক আছে, আছে নেতিবাচক দিকও। এই নেতিবাচক দিক এড়িয়ে আমরা কীভাবে ভালো কাজে এটা ব্যবহার করতে পারি?’
কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তরে অধ্যাপক মইনুল হোসেন বলেন, ‘ফেসবুকে আপনি ভুল তথ্য ছড়াতে পারেন, আবার “রক্ত লাগবে” লিখেও পোস্ট করতে পারেন। এর ফলে কারো জীবন বাঁচতে পারে। এআইও সেরকম টুল। আর তাই প্রয়োজন সচেতেনতা গড়ে তোলা। যা দেখবেন, তা-ই বিশ্বাস করা যাবে না। যাচাই করতে হবে। সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই।’
সময় ফুরিয়ে আসে, দর্শকদের প্রশ্ন ফুরোয় না। তবু ইতি টানতে হয় প্রশ্নোত্তর পর্বে। সবার শেষে সভাপতির বক্তব্য দেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বলেন, ’১০-৩৫—সব বয়সীদের জন্যই আমাদের এ ম্যাগাজিন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের তরুণেরা যেন এগোতে পারে, বাকি জীবন চলার পুঁজি যেন অর্জন করে নিতে পারে, সেই চেষ্টাটুকু আমরা করি। আমরা সবার মাঝে বিজ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চাই।’ উপস্থিত দর্শক ও আলোচকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞানের কথা শুনতে যাঁরা এসেছে, তাঁদের ধন্যবাদ। তবু সবাই আরও অনেক কিছু জানতে চান। তাই আমরা আরও বড় পরিসরে এ ধরনের বিশেষ আয়োজন করার চেষ্টা করব।’
শুধু দর্শক প্রশ্ন করবেন, আর অতিথিরা জবাব দেবেন, তা-ই কি হয়? সে জন্য উল্টো পাঠককে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়। ‘কুইজ কুইজ’ নামের এ পর্ব সঞ্চালনা করেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদনা দলের সদস্য শিবলী বিন সারওয়ার। জবাব দিয়ে ১০ জন দর্শক জিতে নেন বিশেষ আকর্ষণীয় পুরস্কার।
তবু দর্শকদের খানিকটা মন খারাপ হয়। স্বাভাবিক। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. নুরুজ্জামান খান যে উপস্থিত হতে পারেননি। শারীরিক অসুস্থতাই এ জন্য দায়ী। সে জন্য দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন সঞ্চালক।
সব শেষে বিজয়ী দর্শকদের নিয়ে ছবি তোলা হয়। তবু মঞ্চে জমজমাট দর্শকেরা। তাঁরা এগিয়ে আসেন, প্রশ্নবাণে জেরবার করেন অতিথিদের। প্রশ্ন করেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদককেও। কবে হবে বড় পরিসরের আলোচনা? এআই নিয়ে বিশেষ আলোচনা আয়োজন করা দরকার। পাঠক-দর্শক-শ্রোতা-অধ্যাপক ও বিজ্ঞানচিন্তার লেখকেরা মিলেমিশে এক হয়ে যান। সবাই এখানে বিজ্ঞানপ্রেমী। তাঁদের হাসি-আলাপে ধীরে ধীরে পর্দা নামে বিজ্ঞান বক্তৃতার। শেষ হয় এক বিকেলে বিজ্ঞানের এই মিলনমেলার।