মাথায় কত প্রশ্ন আসে
মৃত সাগর কেন মৃত
জায়গাটির নাম মৃত সাগর। এখানে কোনো দৃশ্যমান জলজ প্রাণ নেই। তাহলে এটি কি আসলেই মৃত? কেন? মৃত সাগরের রহস্য কী?
পূর্বে জর্ডান, পশ্চিমে ইসরাইল এবং ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীর। মাঝখানে মৃত সাগর। ইংরেজি নাম, ডেড সি। নাম শুনে যা বোঝা যায়, বাস্তবতাও তাই। জলাশয় যেখানে সাধারণত ব্যাপক প্রাণের আধার, সেখানে এই গোটা জলাশয় একদম মৃত। তবে জলাশয়টির নামের ভেতরে একটা সমস্যা আছে। মৃত ‘সাগর’ আসলে সাগর নয়, লেক—বাংলায় যাকে বলে হ্রদ।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে যেমন প্রচণ্ড কৌতূহল অনেকের, তেমনি অনেকেই কৌতূহলী এই মৃত সাগর নিয়ে। প্রশ্ন দুটো—এক, এই হ্রদ কি সত্যিই মৃত? আর দুই, মৃত হলে, কেন মৃত?
শুনে অনেক রহস্যময় মনে হলেও মূল কারণটি কিন্তু খুব সরল। এ সাগরের পানিতে লবণের ঘনত্ব অনেক বেশি। সে জন্যই দৃশ্যমান কোনো প্রাণ এখানে দেখা যায় না। আসলে, সাধারণ জলজ প্রাণ—যেমন মাছ ও জলজ উদ্ভিদ—এখানে বাঁচতেই পারে না প্রচণ্ড ঘন লবণের জন্য। প্রশ্ন আসে, এখানে লবণের ঘনত্ব অন্যান্য সমুদ্র বা লবণাক্ত জলাধারের তুলনায় কত বেশি? গড়ে সমুদ্রের পানিতে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ লবণ থাকে। সহজ করে বললে, ১ লিটার সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত লবণ থাকে মাত্র ৩৫ গ্রাম। আরও ভেঙে বললে, ১ লিটারকে বলতে পারেন ১ হাজার গ্রাম (সমতুল্য)। তার মানে, ১ হাজার গ্রামে মাত্র ৩৫ গ্রাম লবণ থাকে। আর মৃত সাগরে এ লবণের পরিমাণ ৩৪.২ শতাংশ! মানে ১ হাজার গ্রামে প্রায় ৩৪২ গ্রাম! আর সাধারণ সমুদ্রের তুলনায় এখানে পানির উচ্চতাও অনেক কম। সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ৪০০ মিটার নিচে।
শুনে অনেক রহস্যময় মনে হলেও মূল কারণটি কিন্তু খুব সরল। এ সাগরের পানিতে লবণের ঘনত্ব অনেক বেশি। সে জন্যই দৃশ্যমান কোনো প্রাণ এখানে দেখা যায় না। আসলে, সাধারণ জলজ প্রাণ—যেমন মাছ ও জলজ উদ্ভিদ—এখানে বাঁচতেই পারে না প্রচণ্ড ঘন লবণের জন্য
কেমন করে এমন হলো? ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ বছর আগে এ অঞ্চলের টেকটোনিক প্লেট বা মহাদেশীয় পাতগুলো যখন পরস্পর থেকে সরে যেতে শুরু করে, তখন এখানে তৈরি হয় বিশাল খাদ। এই খাদ মেডিটেরেনিয়ান সি বা ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেখান থেকে লবণাক্ত পানি এসে পড়ে খাদে, গড়ে ওঠে মৃত সাগর। তখনো কিন্তু এটি মৃত নয়, সেটা ঘটেছে পরের কয়েক মিলিয়ন বছরে। টেকটোনিক প্লেট বা মহাদেশীয় পাতের কয়েক মিলিয়ন বছরের নড়াচড়ায় ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যায় এ অঞ্চলের ভূমি। ফলে ভূমধ্যসাগর ও অন্যান্য জলাশয় থেকে এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, পরিণত হয় হ্রদে। এখন এর লবণাক্ত পানি এক জায়গায় আবদ্ধ। কিন্তু এ অঞ্চলে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার হার বেশি, বৃষ্টিপাতের হার কম। অর্থাৎ পানি বাষ্পীভূত হয়ে কমে যাচ্ছে দিন দিন, কিন্তু লবণ রয়ে যাচ্ছে নিচে। নতুন পানি আসার পথও নেই। ফলে বাড়তে থাকে লবণের ঘনত্ব। ধীরে ধীরে লবণের ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে স্বল্প পানি পরিণত হয় হাইপারস্যালাইনে, যা মেরে ফেলে এখানকার মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীবদের। এভাবে কালের আবর্তে হ্রদটি পরিণত হয় মৃত সাগরে।
এটা আপনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন দুভাবে। এক, নিজের বাসায় পানিতে মাছ বা জলজ উদ্ভিদ রেখে তাতে প্রচুর লবণ মিশিয়ে দিয়ে (না, সত্যি সত্যি এমন করে কোনো প্রাণকে অকারণে মারবেন না যেন)। তবে এর ব্যতিক্রমও কিন্তু আছে—ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। যেমন সুন্দরবনের গাছপালা। সেগুলো নিয়ে এ পরীক্ষা করলে বিষয়টা বোঝা যাবে না। তবে সাধারণ উদ্ভিদ এত অতিরিক্ত লবণ সহ্য করতে পারে না। মানুষের জন্যও এ কথা সত্যি। দেহে অতিরিক্ত লবণ জমে গেলে আমাদের নানা সমস্যা হয়। যেমন রক্তচাপ বেড়ে যায়, কিডনির ক্ষতি হয় ইত্যাদি। আরও একভাবে বিষয়টা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণকারীরা অনেক সময় মৃত সাগরের পানিতে নামেন। আপনিও নামতে পারেন। দেখবেন, অন্যান্য সমুদ্র বা লবণাক্ত জলাশয়ের তুলনায় এখানে সহজে ভেসে থাকতে পারছেন। কারণটা যে লবণের ঘনত্ব, সে তো খানিকটা পানি মুখে গেলে একদম ‘হাতে-কলমে’ বুঝেই যাবেন!
মৃত সাগর কেন মৃত, তা তো বোঝা গেল। কিন্তু এখানে কি একদম কোনো প্রাণই নেই? আছে, আছে। এককোষী কিছু মাইক্রোঅর্গানিজম বা অণুজীব আছে। সেগুলো এরকম উচ্চ ঘনত্বের লবণাক্ত পানিতে শুধু বেঁচেই থাকে না, দিব্যি আরামে থাকে। এ ধরনের অণুজীবদের বলা হয় হ্যালোফিলিক অর্গানিজম। পর্যায় সারণির সঙ্গে পরিচয় থাকলে নিশ্চয়ই জানেন, সপ্তম কলামটির মৌলগুলোর সাধারণ নাম হ্যালোজেন। এর একটি হলো ক্লোরিন, খাবার লবণ সোডিয়াম ক্লোরাইডের একটি মৌলিক উপাদান। বাকিগুলো—ফ্লোরিন, ব্রোমিন, আয়োডিন ইত্যাদিরও লবণ রয়েছে। একটি হ্যালোজেন আর অন্য একটি মৌল বিক্রিয়া করলে যে যৌগ (পড়ুন, লবণ) তৈরি হয়, সাধারণভাবে তাদের বলা হয় হ্যালাইড।
হ্যালোফিলিক অণুজীবগুলো অন্য রাসায়নিক প্রাণ বা যৌগ থেকে এই হ্যালাইড যৌগ বের করে নিয়ে গ্রহণ করে ও এর মাধ্যমে টিকে থাকে। মৃত সাগরের নমুনায় এমন একটি হ্যালোফিলিক ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। এর বৈজ্ঞানিক নাম হ্যালোব্যাকটেরিয়াম ভলকানি (Halobacterium volcanii)। দেখা গেছে, এটিতে যে প্রোটিন আছে, তা অনেক উচ্চ ঘনত্বের লবণেও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
হ্যাঁ, এর মানে, মৃত সাগর পুরোপুরি মৃত নয়। শুধু বিশেষ ধরনের অণুজীবই এখানে বেঁচে থাকতে পারে।
সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, আর্থ ডট, ইসা ডট ইন্ট, উইকিপিডিয়া