নোবেল ২০২৩
নোবেল মেডেলের রসায়ন
প্রতিবছরের মতো এবারও পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে। চলতি বছরের নোবেল পুরস্কারের পর্দা নামছে আজ ২ অক্টোবর ২০২৩। বিজয়ী বিজ্ঞানীরা অর্থমূল্যের সঙ্গে স্বীকৃতি হিসেবে পাবেন একটি করে মেডেল। কী দিয়ে তৈরি এই মেডেল? নোবেল মেডেলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ…
‘আরে, তোকে তো নোবেল দেওয়া উচিত,’ আমরা অনেক সময় মশকরা করে এ কথা বলে থাকি। তবে আমাকে যদি কেউ এ কথা বলে, আমি তাকে বলব, যেন ১৯৮০ সালের আগের মেডেল দেয়।
আমার এ রকম বলার কারণ কি কেউ বুঝতে পেরেছেন? হয়তো হ্যাঁ। তবে যাঁরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, তাঁদের জন্য মজার একটা তথ্য দিই। নোবেল প্রাইজ যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত, সেহেতু আমরা ধরেই নিই যে নোবেল লরিয়েটদের যে মেডেল দেওয়া হয়, সেটি হয়তো একদম বিশুদ্ধ স্বর্ণের তৈরি। প্রকৃতপক্ষে, কখনোই একদম বিশুদ্ধ ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে এই মেডেল তৈরি করা হয়নি। ১৯৮০ সালের আগপর্যন্ত ২৩ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে নোবেল প্রাইজের মেডেল তৈরি করা হতো, কিন্তু এর পর থেকে ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হয়। ১৮ ক্যারেটের মেডেলের ওপরে অবশ্য ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়, যেন দেখতে একদম বিশুদ্ধ স্বর্ণেরই মনে হয়। ক্যারেট হচ্ছে স্বর্ণের বিশুদ্ধতার মানদণ্ড। স্বর্ণের অলংকার বা বিভিন্ন বস্তু বানানোর জন্য এর সঙ্গে অন্য ধাতুর ভেজাল যোগ করা হয়। এক ক্যারেট বলতে বোঝায়, কোনো একটি বস্তুর মোট ভরের ২৪ ভাগের ১ ভাগ হচ্ছে স্বর্ণ ও বাকি ২৩ ভাগ অন্য ধাতুর অংশ। তাহলে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের তৈরি বলতে বোঝানো হয়, বস্তুটির ভরের ২৪ ভাগের ১৮ ভাগ স্বর্ণের ভর আর বাকি ৬ ভাগ অন্য ধাতুর ভেজাল।
১৯৮০ সালের পর থেকে যে নোবেল প্রাইজ মেডেলের বিশুদ্ধতাই কমেছে তা নয়, এর ভরও কমেছে। ১৯৮০–এর আগের মেডেলগুলোর ভর হতো ২০০ গ্রাম আর এখন হয় ১৭৫ গ্রাম।
অক্টোবর মাস মানেই নোবেলজয়ীদের তালিকায় আরও কিছু নাম যুক্ত হওয়া। আর প্রতিটি নোবেল প্রাইজ জেতার সঙ্গে থাকে মজার মজার সব গল্প। আজ তেমনই এক নোবেল প্রাইজ মেডেলের বিখ্যাত গল্প বলব, যেটিকে রসায়নের জাদু ব্যবহার করে উধাও করে দেওয়া হয়েছিল।
দুজন জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স ভন লু ক্রিস্টালের মাধ্যমে এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন আবিষ্কার করার জন্য ১৯১৪ সালে ও জেমস ফ্রাঙ্ক ইলেকট্রন ও পরমাণুর মিথস্ক্রিয়া নিয়ে কাজ করে ১৯২৫ সালে নোবেল প্রাইজ অর্জন করেন। তাঁদের একজন ছিলেন নাৎসি বাহিনীর বিরোধিতাকারী ও অন্যজন ইহুদি সম্প্রদায়ের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি বাহিনী জার্মানি থেকে কোনো স্বর্ণ বা এ–জাতীয় সম্পদ বাইরে যেতে দিত না। ম্যাক্স ভন ও জেমস ফ্রাঙ্ক তাঁদের মেডেল নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ডেনমার্কে আরেক নোবেলজয়ী নীলস বোরের কাছে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন নাৎসি বাহিনী ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন দখল করে নেয়। নীলস বোরের ল্যাব বেশ কিছু ইহুদি বিজ্ঞানীর আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত ছিল এবং নাৎসিদের কাছে তথ্য ছিল যে তাদের দেশের দুটি মেডেল এখানে আছে। তাই তারা দ্রুত প্রমাণ সংগ্রহের জন্য সেদিকে অগ্রসর হয়। যদি ম্যাক্স ভন ও জেমস ফ্রাঙ্কের নামখচিত মেডেলগুলো নাৎসি বাহিনী পায়, তা গুরুতর অপরাধ হিসেবে ধরা হবে এবং কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সুতরাং, নীলস বোরকে নাৎসি বাহিনী পৌঁছানোর আগেই মেডেলগুলো ছু মন্তর ছু করে উধাও করে দিতে হবে। আরেক বিজ্ঞানী জর্জ দ্য হিভসি পরামর্শ দেন যে মেডেলগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলতে, কিন্তু বোর তা নাকচ করে দেন। কারণ, ২৩ ক্যারেটের এ চকচকে স্বর্ণের মেডেল খুব সহজেই খুঁজে পাবে নাৎসি বাহিনী। তাতে হিভসির মাথায় আরেকটি বুদ্ধি আসে আর তা হলো, মেডেলগুলো দ্রবীভূত করে ফেলা। কিন্তু সমস্যা হলো, স্বর্ণ খুবই নিষ্ক্রিয় একটি মৌল ও সহজে কোনো কিছুতে দ্রবীভূত হতে চায় না। তিনি তখন মেডেল দুটি ‘অ্যাকুয়া রেজিয়া’র (Royal water) মধ্যে ডুবিয়ে ফেলেন। অ্যাকুয়া রেজিয়া হলো হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিডের ৩:১ মোলার অনুপাতে তৈরি মিশ্রণ। এককভাবে দুটি অ্যাসিডের কোনোটিই স্বর্ণকে দ্রবীভূত করতে পারে না, কিন্তু এদের মিশ্রণ পারে। এর কারণ হলো নাইট্রিক অ্যাসিড অল্প পরিমাণ স্বর্ণকে অক্সিডাইজ করে স্বর্ণের আয়ন তৈরি করে এবং হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তখন ক্লোরাইড আয়ন প্রদান করে, যা স্বর্ণের আয়নগুলোর সঙ্গে বিক্রিয়া করে। এতে দ্রবণে স্বর্ণের আয়ন কমে গিয়ে নাইট্রিক অ্যাসিডকে আরও কিছু আয়ন তৈরি করার সুযোগ দেয়। এভাবে শেষে ক্লোরোঅরিক অ্যাসিডের কমলা রঙের দ্রবণ তৈরি হয়। ফলে নাৎসিরা চিরুনি অভিযান চালিয়েও মেডেলগুলো খুঁজে পায় না। এভাবে হিভসির রসায়নের কৌশল ব্যবহার করে তাঁরা রক্ষা পান। আনন্দের বিষয় হলো, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ক্লোরোঅরিকঅ্যাসিডের সঙ্গে সোডিয়াম বাইসালফেট বিক্রিয়া করিয়ে আবার স্বর্ণ পুনরুদ্ধার করে তাঁদের মেডেলগুলো আবার বানানো হয়েছিল। এই চমকপ্রদ কৌশলের বুদ্ধিদাতা হিভসিও কিন্তু পরবর্তী সময়ে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, যদিও তা এই বুদ্ধির জন্য নয়।
গ্রন্থনা: মো. অর্ক অয়ন চৌধুরী, শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: কম্পাউন্ড কেমেস্ট্রি, ব্রিটানিকা