ব্যথানাশক অণুর অণুকথা

রসায়নবিজ্ঞানীদের অবদান চোখের সামনে দেখেও বুঝতে পারি না আমরা। তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান ব্যথানাশক রাসায়নিক উদ্ভাবন। উইলোগাছের নির্যাস থেকে এ ব্যথানাশক তৈরিকে রাসায়নিক বিপ্লবও বলা চলে। সেই বিপ্লবের অগ্রপথিকদের কথা ও ইতিহাস…

Roel Smart

ইউরোপের মানুষেরা একসময় জ্বর, সর্দি-কাশি হলে উইলোগাছের (Willow Tree) ছাল খেত। কিংবা ছাল থেকে সংগৃহীত নির্যাস পান করত। কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই উইলোগাছের ঔষধি গুণের কথা জানা ছিল মানুষের। ইউরোপ ছাড়াও মেসোপটেমিয়া, আসিরিয়া ইত্যাদি সভ্যতাতেও উইলোগাছের ভেষজগুণের কথা প্রচলিত ছিল। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস উইলোগাছের ঔষধি গুণের কথা লিখেছেন তাঁর বইয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ গাছের পাতা ও ছাল ব্যবহার করেছে।

কিন্তু উইলোগাছের বাকলে কোন কোন রাসায়নিক যৌগ আছে, সেসব যৌগের গঠনই–বা কেমন, এ সম্পর্কে মানুষের জানা ছিল না। উনিশ শতকে ইউরোপিয়ান কেমিস্টদের মধ্যে একটা নবজাগরণের সূচনা হয়। বিভিন্ন উদ্ভিদের নির্যাস থেকে তাঁরা রাসায়নিক যৌগ আলাদা করার চেষ্টা শুরু করেন। একটা গাছের নির্যাসে অনেক রাসায়নিক যৌগ থাকে। সেসব যৌগের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা যৌগ মানুষের রোগ প্রশমনে সাহায্য করে। নির্দিষ্ট সেই যৌগকে বলা হয় অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (API)। উনিশ শতকে সেসব যৌগের পৃথক্‌করণ (Isolation) ও রাসায়নিক গঠন নির্ণয় করা ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য। কিন্তু মেধাবী রসায়নবিজ্ঞানীরা তাঁদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।

জার্মান রসায়নবিদ ইয়োহান আন্দ্রিয়াস বাকনারম

১৮২৮ সালে ইয়োহান আন্দ্রিয়াস বাকনার নামের এক জার্মান রসায়নবিদ উইলোগাছ থেকে একটি রাসায়নিক যৌগ পৃথক করেন। সেটার নাম দেওয়া হয় স্যালিসিন (Salicin)। উইলোগাছের লাতিন নাম স্যালিক্স থেকে দেওয়া হয় এ নাম। স্যালিসিন নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশের রসায়নবিজ্ঞানীদের মধ্যে তখন খুব উত্তেজনা। তাঁরা স্যালিসিন নিয়ে আরও গবেষণা করতে লাগলেন। স্যালিসিনকে বিভিন্ন রোগের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয় তখন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৮ সালে ইতালিয়ান রসায়নবিদ রাফায়েল পিরিয়া (Raffaele Piria) স্যালিসিন থেকে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড পৃথক করেন। রসায়নবিদেরা বুঝতে পারলেন, স্যালিসাইলিক অ্যাসিডই সেই জাদুকরি যৌগ, যেটা উইলোগাছের নির্যাসে ছিল। ফলে এ নির্যাস জ্বর নিরাময়ে সাহায্য করত।

বহু রসায়নবিদ সে সময় চিন্তা করলেন, হয়তো এই স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের কোনো জাদুকরি ওষুধ। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, উনিশ শতকের সে সময়ে কিন্তু সারা দুনিয়ার মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য প্রকৃতির ওপরই প্রধানত নির্ভরশীল ছিল। বিভিন্ন উদ্ভিদই ছিল ভরসা। ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ওষুধ আবিষ্কারের স্বপ্ন বহু রসায়নবিদই দেখেছেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই উনিশ শতকের সে সময়ে বহু রসায়নবিদ সেই প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার নেশায় কাজ করছিলেন।

স্যালিসাইলিক অ্যাসিড আলাদা করার পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়তে লাগল। কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্টরা তাঁদের অর্থনৈতিক ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য স্যালিসাইলিক অ্যাসিড তৈরির সহজ রাসায়নিক উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। কারণ, শুধু উইলোগাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড পাওয়া সম্ভব ছিল না। বহু রোগী উইলোগাছের নির্যাস পান না করে সরাসরি স্যালিসাইলিক অ্যাসিড সেবন করতে লাগলেন। রোগীরা অভিযোগ করলেন, স্যালিসাইলিক অ্যাসিড সেবনে জ্বর উপশম হয়, কিন্তু পাকস্থলীতে খুব জ্বালাপোড়া করে। সুতরাং এই সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।

জার্মান রসায়নবিদ ফেলিক্স হফম্যান

জার্মানির বিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বেয়ার (Bayer) তখন স্যালিসাইলিক অ্যাসিডকে কাজে লাগানোর কথা ভাবতে লাগল। বেয়ার কোম্পানিতে তখন জার্মানির মেধাবী বেশ কজন রসায়নবিজ্ঞানী কাজ করতেন। তাঁদের একজনের নাম আর্থার আইকেনগ্রুন। আইকেনগ্রুনের অধীনে কাজ করতেন ফেলিক্স হফম্যান নামের এক তরুণ রসায়নবিদ। আইকেনগ্রুন তাঁকে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড থেকে অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিড (ASA) তৈরির নির্দেশ দেন। ফেলিক্স হফম্যান সেই যৌগ তৈরি করেন। একটা যৌগকে রাসায়নিকভাবে অন্য যৌগে রূপান্তর করাকে রাসায়নিক রূপান্তর (Chemical transformation) বলা হয়। অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের নাম দেওয়া হলো অ্যাসপিরিন (Aspirin)। ১৮৯৭ সালের ঘটনা সেটা।

মজার বিষয় হলো, বেয়ারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা শুরুতে অ্যাসপিরিনকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁদের ধারণা ছিল, অ্যাসপিরিন তেমন কোনো পরিবর্তন আনবে না। সেটা স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের মতোই কাজ করবে। আইকেনগ্রুন খুবই বিস্মিত হন। তিনি বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি। ফলে তিনি গোপনে নিজের পরিচিত চিকিৎসকদের অ্যাসপিরিন জোগান দেন এবং রোগীদের অ্যাসপিরিন দিতে অনুরোধ করেন। চিকিৎসকেরা তাঁদের রোগীদের অ্যাসপিরিন দেন। পরে আইকেনগ্রুনকে রিপোর্ট করেন যে অ্যাসপিরিন ব্যথানাশক (Analgesic) হিসেবেও দারুণ কাজ করছে। স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে না, কিন্তু স্যালিসাইলিক অ্যাসিড থেকে তৈরি অ্যাসপিরিন ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করছে। আইকেনগ্রুন এই ফলাফলে খুবই বিস্মিত হন এবং সিনিয়র সহকর্মীদের জানান। দুই বছরের মাথায়, ১৮৯৯ সালে বেয়ার কোম্পানি অ্যাসপিরিন রেজিস্টার্ড করে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাসপিরিন। বিশ শতকের শুরুতে মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে এ ওষুধ। অ্যাসপিরিন ছিল গবেষণাগারে তৈরি প্রথম ওষুধ, যেটা সারা দুনিয়ায় বিক্রি করা হয়। প্রচুর লাভবান হয় বেয়ার কোম্পানি। আজকের দিনেও অ্যাসপিরিন পৃথিবীর অন্যতম বহুল ব্যবহৃত এবং বিক্রীত এক ওষুধ।

সহস্র বছর ধরে যে উইলোগাছের বাকল খেয়ে মানুষ জ্বর-সর্দি থেকে সেরে উঠেছে, সেই বাকল থেকে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড আলাদা করে, শনাক্ত করে সেটাকে রাসায়নিক রূপান্তরের মাধ্যমে আরও উপযোগী ওষুধে পরিণত করেছেন রসায়নবিজ্ঞানীরা। গাছের ওপর নির্ভরশীল না থেকে ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড তৈরি করে সেটা থেকে অ্যাসপিরিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। মানবসভ্যতায় মেধাবীদের অবদান এমনই। মেধাবীরা আমাদের চারপাশ থেকে অনেক কিছু উদ্‌ঘাটন করেন। সেটাকে নতুন রূপ দেন। সংজ্ঞায়িত করেন নতুন করে। তারপর সেটা ব্যবহার করেন মানুষের কল্যাণে। অ্যাসপিরিন তেমনই এক গল্প। সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষকে সুস্থ‍ রাখছে এ ওষুধ।

ছবি ২: স্যালিসাইলিক অ্যাসিড (বাঁয়ে) ও অ্যাসপিরিনের (ডানে) পার্থক্য হলো স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের কার্যকর গ্রুপ অ্যালকোহলকে (OH) রূপান্তরিত করা হয়েছে এস্টার (Ester) গ্রুপে।

ছবি ২-এর বাঁয়ের অণুটি হলো স্যালিসাইলিক অ্যাসিড। ডানেরটি অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিড বা অ্যাসপিরিন। পার্থক্যটা হলো, স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের কার্যকর গ্রুপ অ্যালকোহলকে (OH) রূপান্তরিত করা হয়েছে এস্টার (Ester) গ্রুপে। আর এ সামান্য পরিবর্তনই যৌগটির মধ্যে নতুন ঔষধি গুণের জন্ম দিয়েছে। সারা পৃথিবীতে বহু রসায়নবিজ্ঞানী এভাবে অসংখ্য রাসায়নিক যৌগ তৈরি করেন এবং রাসায়নিক রূপান্তর করে থাকেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বেড়ান কাঙ্ক্ষিত যৌগ, যেটি হয়তো ভিন্ন রোগের জন্য ওষুধ হয়ে ওঠে।

রসায়নবিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক, চেতনানাশক, ম্যালেরিয়া নিরামকসহ বহু ওষুধ। তাহলে রসায়নবিজ্ঞানীরা ছাড়া পৃথিবীটা কেমন হতো—যন্ত্রণাময় কাতরানো এক মৃত্যুপুরী!

নোট: ১. উইলোগাছ সাধারণত শীতপ্রধান অঞ্চলে জন্মায়।

২. ফেলিক্স হফম্যানকে অ্যাসপিরিন তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তবে সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক লেখক দাবি করেছেন, আইকেনগ্রুনের অধীনে হফম্যান কাজ করতেন। ফলে আইকেনগ্রুনের নির্দেশনাতেই হফম্যান অ্যাসপিরিন তৈরি করেছিলেন।

৩. ১৮৫৩ সালে একজন ফরাসি রসায়নবিজ্ঞানী অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিড তৈরি করেন। কিন্তু সে যৌগ বিশুদ্ধ ছিল না। রসায়নে বিশুদ্ধ যৌগ পৃথক্‌করণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সে যৌগের ঔষধি গুণাবলি আছে কি না, সেটা তখন পরীক্ষাও করা হয়নি।

লেখক: সিনিয়র সায়েন্টিস্ট (মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি), পিটিসি থেরাপিউটিকস, নিউ জার্সি, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০২৩ বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত