ডালিয়ার রং রহস্য

শীতকালীন মৌসুমি ফুলের মধ্যে ডালিয়াই সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় বর্ণিল ফুল। লাল, হলুদ, কমলা ও গোলাপি রং পাপড়িগুলোর সঙ্গে মিলে জটিল জ্যামিতিক বিন্যাস তৈরি করে। কিন্তু নীল ডালিয়া কেন প্রকৃতিতে এত বিরল?

প্রথমে শুরু করা যাক, কী কারণে আমরা ডালিয়ার রং দেখতে পাই, তা দিয়ে। মূলত এটি রাসায়নিকভাবে সম্পর্কিত রঞ্জকগুলোর জটিল আন্তক্রিয়ার কারণে হয়। চ্যালকোন, অরোন ও অ্যান্থোসায়ানিন—এগুলো সব উদ্ভিদে উত্পাদিত যৌগে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এরা আন্তসংযুক্ত রাসায়নিক, একে অন্যকে প্রভাবিত করে। চ্যালকোনের প্রতিক্রিয়া অরোন ও অ্যান্থোসায়ানিন, দুটোকেই প্রভাবিত করতে পারে।

হলুদ ও কমলা ডালিয়া ফুলে চ্যালকোন ও অরোন থেকে তৈরি যৌগগুলো বড় ভূমিকা পালন করে। অরোনের উপজাতগুলো তাদের চ্যালকোন উপজাতগুলোর তুলনায় আরও তীব্র হলুদ রং তৈরি করে। কমলা ফুলে রঞ্জকের আরেকটি জাতও অবদান রাখে। এর নাম অ্যান্থোসায়ানিন। বিভিন্ন চিনির অণু অ্যান্থোসায়ানিন পেলারগোনিডিন ও সায়ানিডিনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। ফলে কমলা, লাল ও গোলাপি রং তৈরি হয়।

ভিন্ন ভিন্ন এসব রঞ্জক ডালিয়ার পাপড়িতে থাকে। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক, নীল ফুল তৈরি হওয়া খুব বড় কোনো সমস্যা না।

অন্যান্য বর্ণহীন যৌগও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন ফ্ল্যাভোনস। যদিও তারা নিজে রঙিন নয়, কিন্তু এগুলো অ্যান্থোসায়ানিন রঞ্জকগুলোর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে ও তাদের স্থিতিশীল করে তোলে। এই রঞ্জকগুলো অন্যথায় উদ্ভিদের জারণ বা অন্যান্য রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অস্থিরতা সৃষ্টি করত। স্থিতিশীল হয়ে গেলে তা হয় না।

ভিন্ন ভিন্ন এসব রঞ্জক ডালিয়ার পাপড়িতে থাকে। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক, নীল ফুল তৈরি হওয়া খুব বড় কোনো সমস্যা না। কিন্তু এখানে একটি বিশাল জেনেটিক বাধা আছে। ডালিয়ায় ফ্ল্যাভোনয়েড 3’5’H-হাইড্রোক্সিলেস (সংক্ষেপে F3′5′H) নামে একটি এনজাইমের অভাব রয়েছে।

বিষয়টা হলো, ফ্ল্যাভোনয়েড 3‌’5’H-হাইড্রোক্সিলেস বা F3‌’5’H এনজাইম অ্যান্থোসায়ানিডিন ডেলফিনিডিন যে রাসায়নিক থেকে উৎপন্ন হয়, সেটি তৈরি করে। আর ডেলফিনিডিন থেকে উৎপন্ন অ্যান্থোসায়ানিন নীল বর্ণের জন্য দায়ী। ডালিয়া F3‌’5’H এনজাইম তৈরি করতে পারে না। তাই ডালিয়ার রং নীল হওয়া সম্ভব নয়।

শুধু ডালিয়াই নয়, অনেক ফুলেই এটির অভাব আছে। যেমন গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা ও অন্যান্য শোভাময় উদ্ভিদেও এই এনজাইম অনুপস্থিত। তাহলে কি ফটোশপের জাদু ছাড়া নীল গোলাপ বা নীল ডালিয়া দেখা অসম্ভব?

স্বাভাবিকভাবেই এর জবাব, হ্যাঁ। কিন্তু গবেষকেরা এই ফুলগুলোকে নীল করার প্রচেষ্টায় রঞ্জক উৎপাদনের উপায় খুঁজে পেয়েছেন। ‘প্রচেষ্টায়’ বলার কারণ, এটি গাছগুলোতে ডেলফিনিডিন তৈরি করার মতো সহজ নয়। ডেলফিনিডিন তৈরির অংশটি যথেষ্ট সহজ তুলনামূলকভাবে, যেহেতু F3′5′H-এর জিনটি জিনপ্রকৌশলের মাধ্যমে সন্নিবেশ করা যেতে পারে।

নীল ফুলের রহস্য শুধু ডেলফিনিডিন তৈরি করাই নয়। অন্য কারণগুলো ডেলফিনিডিনের রংকে প্রভাবিত করতে পারে এটি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও।

একটি জাপানি কোম্পানি ২০০৭ সালে গোলাপ দিয়ে এটি করতে সফল হয়েছিল। একটি ‘নীল’ (ফিকে বেগুনি ধরনের নীল) বৈচিত্র্য তৈরি করেছিল তারা, যা গোলাপের পাপড়িতে ডেলফিনিডিন জমা করে। ডেলফিনিডিন উৎপাদন ও জমা করার ক্ষমতা এই গোলাপ থেকে অন্যান্য গোলাপেও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। 

দেখা যাচ্ছে, নীল ফুলের রহস্য শুধু ডেলফিনিডিন তৈরি করাই নয়। অন্য কারণগুলো ডেলফিনিডিনের রংকে প্রভাবিত করতে পারে এটি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও। যেমন: ফ্ল্যাভোন রঞ্জক; পাপড়ির কোষের অম্লতা, যেখানে ডেলফিনিডিন তৈরি হয়; এমনকি পাপড়িতে উপস্থিত ধাতব আয়নগুলোও প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং, যদিও জাপানে তৈরি এই ফিকে বেগুনি গোলাপগুলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি চিত্তাকর্ষক কৃতিত্ব, সত্যিকারের নীল গোলাপ (ও ডালিয়া) ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়।

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত