মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণি

১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৯। উশকোখুশকো চুল, লম্বা দাঁড়ি। তরুণ মানুষটি ৬৩টা কার্ড নিয়ে বসেছেন। মেলাতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাল খুঁজে পাচ্ছেন না। কেবল নাস্তা করেছেন তিনি। একটুপর ট্রেন ধরতে হবে। সময় কাটাতে কার্ড নিয়ে বসেছেন। এই কার্ডগুলো তিনি বানিয়েছেন সলিটেয়ার গেমটার অনুকরণে। এই খেলায় তাসের কার্ডগুলোকে সাজাতে হয় নির্দিষ্ট বিন্যাসে। তিনিও এই কার্ডগুলোকে সাজাতে চান। প্রতিটা কার্ডে বেশ কিছু সংখ্যা ও কিছু অক্ষর হিজিবিজি করে লেখা।

মানুষটির নাম দিমিত্রি মেন্ডেলিভ। কার্ডগুলোতে লেখা আছে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব মৌলের পারমাণবিক ভর ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। নানাভাবে সাজানোর চেষ্টা করে মেন্ডেলিভ টের পেলেন, মৌলগুলোকে পারমাণবিক ভরের ক্রমে সাজাতে গেলে মাঝে কিছু ফাঁকা থেকে যায়। এগুলোই তাঁর সাজানোতে গোল বাঁধাচ্ছে।

রোখ চেপে গেল। মাথা থেকে হারিয়ে গেল ট্রেনের চিন্তা। টানা তিন দিন তিন রাত এ নিয়েই পড়ে রইলেন মানুষটি। তারপর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন।

স্বপ্নে দেখলেন একটা সারণি (Table)। কার্ডগুলো তাতে খোপে খোপে বসে আছে। মাঝে মাঝে কিছু ফাঁকা ঘর। এসব ঘরে বসানোর মতো কার্ড তাঁর কাছে নেই। ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দ্রুত সারণিটা আঁকলেন একটা খাতায়। পৃষ্ঠার ওপরে বড় বড় করে লিখলেন, পিরিয়ডিক টেবল অব দ্য এলিমেন্টস। মৌলের পর্যায় সারণি।

যে মানুষটি এই পথ দেখিয়ে গেছেন, তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি! ভাবলে অবাক লাগে না? কারণটা বোঝা অবশ্য খুব কঠিন নয়। আলবার্ট আইনস্টাইন যেমন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য নোবেল পাননি, মেন্ডেলিভও তেমন পাননি পর্যায় সারণির জন্য। কারণ দুক্ষেত্রে মোটামুটি একই—এর প্রমাণ ও প্রয়োগ সে কালে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি মানুষ

দুই

পর্যায় সারণির নাম শোনেননি, এমন কাউকে বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকে বলেন, এক পৃষ্ঠায় এটি সমগ্র রসায়নকে ধারণ করে। কথাটি শতভাগ সত্য নয়, বলা বাহুল্য। রসায়ন মানে শুধু মৌলদের সারিবদ্ধ তালিকা নয়। শক্তির বিষয় আছে, বিক্রিয়ার নানা ধরন আছে, এনট্রপির বাড়া-কমা আছে, আছে আরও অনেক কিছু। তবে পর্যায় সারণিও আসলে শুধু মৌলদের তালিকা না। এর ক্রমবিন্যাস, ডানে-বাঁয়ে ও মাঝে বসানো মৌলগুলোর ধর্মের পর্যায়বৃত্ততা, ওপর-নিচ অনুযায়ী তাদের ধর্মের কমা-বাড়া—এককথায় একে বলতে হয় জিনিয়াস! মানুষের মেধার অন্যতম সর্বোচ্চ প্রয়োগ। পদার্থবিজ্ঞানীরা যেমন সবকিছুকে এক সুতোয় গাঁথার জন্য থিওরি অব এভরিথিং বা সবকিছুর তত্ত্ব খুঁজছেন, বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানের যেমন রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল; রসায়নের জন্য সেই কাজটি করে ফেলেছেন দিমিত্রি মেন্ডেলিভ। এক পৃষ্ঠায় তিনি সব মৌলকে সাজিয়ে ফেলেছেন। এই একটি পৃষ্ঠা অনেক, অনেক কিছু বলতে পারে যেকোনো রসায়নবিদকে।

যে মানুষটি এই পথ দেখিয়ে গেছেন, তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি! ভাবলে অবাক লাগে না? কারণটা বোঝা অবশ্য খুব কঠিন নয়। আলবার্ট আইনস্টাইন যেমন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য নোবেল পাননি, মেন্ডেলিভও তেমন পাননি পর্যায় সারণির জন্য। কারণ দুক্ষেত্রে মোটামুটি একই—এর প্রমাণ ও প্রয়োগ সে কালে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি মানুষ। কেউ কেউ এও বলতে পারেন, মেন্ডেলিভ রাশান বলে নোবেল পাননি। তবে সে প্রসঙ্গটা আপাতত তোলা থাকুক।

মেধাবীদের যে ছবি আমাদের মনে গাঁথা, মেন্ডেলিভ ঠিক তা-ই। আদর্শ মেধাবী! তাঁর গল্পটা জানা থাকলেই বুঝে যাবেন, বাড়িয়ে বলছি না একবিন্দুও।

১৮৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় জন্ম। পুরো নাম, দিমিত্রি ইভানোভিস মেন্ডেলিভ। বাবা ইভান মেন্ডেলিভ ছিলেন শরীরচর্চার শিক্ষক। মা মারিয়া মেন্ডেলিভ গৃহিণী। বাবা-মায়ের ১৩তম সন্তান তিনি।

তাঁর জন্মের বছরই বাবা অন্ধ হয়ে যান। বাধ্য হয়ে তাঁর মা কাজ নেন একটি কাচ কারখানায়। কয়েক বছর এভাবে টেনে চলল। তারপর, ১৮৪৭ সালে মারা গেলেন তাঁর বাবা। পরের বছর, ১৮৪৮ সালে পুড়ে গেল সেই কারখানা, যেখানে তাঁর মা কাজ করতেন। পড়াশোনার সব দ্বার প্রায় বন্ধ হয় হয়। মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। বাধ্য হয়ে পাড়ি জমান রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে। না, আশপাশের শহর না, প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরে। সেখানে মেন্ডেলিভ ভর্তি হন একটি স্কুলে। ভাগ্য তখন চূড়ান্ত আঘাত হানে। মেন্ডেলিভ স্কুলে ভর্তি হওয়ার ঠিক ১০ দিন পর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাঁর মা।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কেউ কেউ থমকে যান। মেন্ডেলিভ থমকে গেলেন না। শুরু করলেন যুদ্ধ। জীবনযুদ্ধ।

দিমিত্রি মেন্ডেলিভ

১৮৫৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে শিক্ষকতা শুরু করলেন ক্রিমিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানে। দুমাস চাকরি করলেন, তারপর আবার ফিরে গেলেন সেন্ট পিটার্সবার্গে। সেখানে ভর্তি হলেন জৈবরসায়নে, মাস্টার্সে। একমনে পড়াশোনা শেষে ডিগ্রি ও বৃত্তি নিয়ে তারপর পাড়ি জমালেন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

১৮৬১ সালে আবার ফিরলেন রাশিয়া। সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন অধ্যাপনায়। উশকো-খুশকো চুল, লম্বা দাঁড়ি—পাগলাটে দেখতে মানুষটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। ততদিনে বিশ্ব-রসায়ন খেই হারিয়ে পথ খুঁজছে। রসায়নবিজ্ঞানীরা অনেকগুলো মৌল আবিষ্কার করেছেন বটে, কিন্তু এগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক বা সাধারণ নাম নিয়ে একমত ছিলেন না কেউই। ২৭ বছরের তরুণ মেন্ডেলিভ এ অবস্থা পরিবর্তন করতে চান। তবে পর্যায় সারণি বানিয়ে ফেলার পরিকল্পনা তাঁর ঠিক ছিল না।

তিনি একটা বই লিখলেন জৈবরসায়ন নিয়ে। নাম, অর্গানিক কেমিস্ট্রি (১৮৬১)। তাঁর বইটিকে সেকালে লেখা এ বিষয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বই বলে মনে করা হয়। অথচ মেন্ডেলিভ টের পেলেন, এ জিনিস কেউ বুঝতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা খেই হারিয়ে ফিরছে। এ অবস্থার কারণ ওটাই—মৌলগুলোর কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই, নেই কোনো সাধারণ নাম। এদের আচার-আচরণের ধরন-ধারণ নিয়েও একটা ঘোলাটে অবস্থা। অথচ মেন্ডেলিভ বুঝতে পারছেন না, শিক্ষার্থীদের এ সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়।

সমস্যাটা তিনি আরও ভালো টের পেলেন পরের বইটা লিখতে গিয়ে। এবারে লিখছেন মৌলদের নিয়ে। বইয়ের নাম, প্রিন্সিপাল অব কেমিস্ট্রি। তাঁর উদ্দেশ্য, শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান করা। সেজন্য প্রথমে সাধারণ কিছু মৌল নিয়ে লিখলেন। যেমন হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও কার্বন। তারপর লিখলেন হ্যালোজেনদের নিয়ে (বর্তমানে এ মৌলগুলোর অবস্থান আধুনিক পর্যায় সারণির ১৭তম কলামে)। এর মধ্যে রয়েছে ক্লোরিন, ফ্লুরিন ইত্যাদি মৌল। এরা খুব সহজে বিক্রিয়া করে। কিন্তু তিনি এসব মৌলকে সাজাচ্ছেন পারমাণবিক ভর অনুযায়ী। আর সাজাতে গিয়ে বারবার সমস্যায় পড়ছেন। ঝামেলা বাঁধছে একের পর এক। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে থমকে যাচ্ছেন বারবার।

সে সময় মৌলদের সাজানো হতো দুভাবে। এক, পারমাণবিক ভরের ক্রমানুসারে। আর দুই, তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। যেমন ধাতুদের একসঙ্গে রাখা হতো, গ্যাসগুলো থাকত একসঙ্গে। মেন্ডেলিভ খুব চান, সাজানোর এই দুই মূলনীতিকে এক সুতোয় গাঁথতে। কিন্তু সমাধান মিলছে না কিছুতেই।

এ সমাধান মেলাতেই মেন্ডেলিভ বানালেন ওই কার্ডগুলো। যেখানেই যান, ওগুলো সঙ্গে নিয়ে তার। তারপরেই সেই ঘটনা, যেটা শুরুতে বলেছি। ‘স্বপ্নে পাওয়া সমাধান’—অন্তত মেন্ডেলিভের ভাষ্যমতে, বদলে দিল রসায়নের ইতিহাস।

তিন

পর্যায় সারণি বানাতে গিয়ে মেন্ডেলিভ কিছু দারুণ পদক্ষেপ নেন। এই পদক্ষেপগুলোই বদলে দেয় সব। তখনো মানুষ পারমাণবিক সংখ্যার কথা জানে না। মেন্ডেলিভ মৌলগুলোকে সাজালেন ভর হিসেবে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি ভারী মৌলকে পরে বসিয়ে তুলনামূলক হালকা মৌলকে আগে বসান। যেমন টেলুরিয়াম (ভর: ১২৭.৬) আয়োডিনের (১২৬.৯) চেয়ে কিছুটা ভারী। কিন্তু মেন্ডেলিভ টেলুরিয়ামকে আগে বসান, অক্সিজেন যে সারিতে রয়েছে, সে সারিতে। আর আয়োডিনকে বসান পরে। কারণ, টেলুরিয়ামের যোজ্যতা বৈশিষ্ট্য ছিল অক্সিজেনের মতো। এরকম করে বসাতে গিয়ে কিছু ফাঁকা ঘর রয়ে গেল। মেন্ডেলিভ অনুমান করলেন, এসব ঘরে যেসব মৌল বসবে, সেগুলো এখনো আবিষ্কৃত হয়নি! যেমন গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম ও স্ক্যান্ডিয়াম ১৮৭১ সালেও অনাবিষ্কৃত, অজানা। মেন্ডেলিভ এগুলোর ভর ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য অনুমান করেন। বলেন, এ মৌলগুলো এই তিনটি ঘরে বসবে। (পরে দেখা যায়, তাঁর অনুমান একদম কাছাকাছি ছিল।) এ সময় তিনি কিছু মৌলের পারমাণবিক ভর আরও নিখুঁতভাবে বেরও করেন।

আরও পড়ুন

পর্যায় সারণি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি সেভাবে। তবে ১৮৭৫ সালে যখন গ্যালিয়াম আবিষ্কৃত হলো এবং মেন্ডেলিভের বলে দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের নিচের ঘরের ‘ইকা-অ্যালুমিনিয়াম’ বা ‘অ্যালুমিনিয়ামের মতো’ ঘরের অনাবিষ্কৃত মৌলটির সঙ্গে এর সব বৈশিষ্ট্য মিলে গেল, তখন বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করলেন, মেন্ডেলিভ কী করে গেছেন!

এ পর্যায়ে এসে বলা প্রয়োজন, মেন্ডেলিভ একাই একশ ছিলেন, এমন নয়। আইনস্টাইন যেমন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য নির্ভর করেছেন তাঁদের আগের বিজ্ঞানীদের অবদান ও আবিষ্কৃত জ্ঞানের ওপর, মেন্ডেলিভও তা-ই করেছেন। তবে তিনি একা রসায়নকে যতটা এগিয়ে দিয়েছেন, তা অনন্য।

মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণি

চার

প্রায় ৪০০ বই ও অনেক গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন মেন্ডেলিভ। পর্যায় সারণি ছাড়াও রসায়নে তাঁর আরও অনেক অবদান রয়েছে। সংক্ষিপ্ত এ লেখায় ওসব আপাতত থাকুক। পরে কখনো নাহয় আলোচনা করা যাবে।

ততদিনে তাঁর কর্মক্ষেত্রও বদলে গেছে। ১৯৬৫ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগে যোগ দেন মেন্ডেলিভ। ১৮৯০ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন অধ্যাপক হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান এক ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে তিনি এ পদ থেকে ইস্তফা দেন। পরে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। ১৮৯৩ সালে যোগ দেন রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ওয়েট অ্যান্ড মেজার-এ, পরিচালক পদে।

১৯০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মারা যান এ মহান রসায়নবিদ। যতদিনে তাঁর অবদানের মর্ম বুঝেছে বিশ্ব, ততদিনে তাঁকে আর নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানোর উপায় নেই। নোবেলবঞ্চিত রয়ে যান মেন্ডেলিভ। কিন্তু তাঁর নাম হয়ে ওঠে পর্যায় সারণির সমার্থক। রসায়নের ইতিহাসে তিনি অমর, অক্ষয়।

সূত্র: খান একাডেমি, কেমিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ, উইকিপিডিয়া, বিজ্ঞানচিন্তা