রসায়ন
রসায়নের ৫টি অবিশ্বাস্য ও মজার তথ্য
রসায়ন শুনলেই অনেকে মনে করেন কঠিন সব সূত্র, ক্লান্তিকর পরীক্ষানিরীক্ষা এবং আরও হাজারটা ঝামেলা। আসলে কিন্তু রসায়ন মোটেই বিরক্তিকর নয়। আমাদের চারপাশের সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে রসায়নের কারিকুরি। এসব কারিকুরির কথা ভাবলে হয়তো বদলে যাবে রসায়ন নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি। এরকম ৫টি মজার ও অবিশ্বাস্য তথ্য নিয়েই আজকের এ আয়োজন।
১. পেন্সিলের শিস এবং হীরা—একই বস্তুর ভিন্ন রূপ
হীরা এবং গ্রাফাইট—দুটি আসলে একই জিনিসের ভিন্ন রূপ। অথচ বৈশিষ্ট্য এবং বাজার মূল্যের দিক দিয়ে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত। হীরা খুবই শক্ত, মূল্যের দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম দামী রত্ন। আর গ্রাফাইট নরম, কালো পদার্থ। এটা পেন্সিলের শিস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আগেই বলেছি, দুটি একই মূল উপাদান দিয়ে তৈরি—কার্বন। হীরার কার্বন পরমাণু টেট্রাহেড্রাল কাঠামো তৈরি করে। টেট্রা মানে চার, আর হেড্রাল মানে কঠিন মুখাবয়ব; ইংরেজিতে বলে সলিড ফেইসেস। এককথায় বললে, টেট্রাহেড্রাল কাঠামো মানে, কার্বনের প্রতিটি প্রতিটি পরমাণু আরও চারটি পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কঠিন অবকাঠামো তৈরি করে। এই শক্ত কাঠামো হীরাকে অত্যন্ত শক্ত এবং দ্যুতিমান করে তোলে। আর গ্রাফাইটের কার্বন পরমাণু ষড়ভুজাকার স্তরে সাজানো থাকে। এতে প্রতিটি পরমাণু কৌণিকভাবে আরও তিনটি পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই স্তরগুলো একে অপরের ওপর খানিকটা আলগাভাবে থাকে, ফলে গ্রাফাইট নরম এবং ভঙ্গুর হয়। গ্রাফাইট মাটির নিচে বহুকাল জমে থাকলে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে এর রাসায়নিক গঠন বদলে যায়। ফলে এটি পরিণত হয় হীরায়।
২. সূর্যে আসলে আগুন জ্বলছে না
পরিষ্কার দিনে আকাশে তাকালেই দেখা যায় বিশাল এক অগ্নিগোলক। অর্থাৎ আগুনের বিশাল বল—সূর্য। নাসার তোলা সূর্যের ছবি দেখলেই দেখবেন জ্বলন্ত শিখা আর ঘূর্ণমান পৃষ্ঠ। এটিই আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র। সূর্যের ব্যাস প্রায় ৬ লাখ ৯৬ হাজার কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের তুলনায় প্রায় ১০৯ গুণ বেশি। বিশাল এই সূর্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে বলে মনে হলেও এক হিসেবে এটি আসলে ভুল ধারণা। কারণ, আমরা জানি, আগুন জ্বলা মানে অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া। অথচ সূর্য জ্বলছে অক্সিজেন ছাড়াই! কীভাবে?
কাঠকয়লা বা প্রচলিত অর্থে আগুন জ্বলা বলতে আমরা যা বুঝি, সূর্য সেভাবে জ্বলছে না। এর মূল জ্বালানি হাইড্রোজেন। আর এটি জ্বলছে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার কারণে। সূর্যের কেন্দ্রে অক্সিজেন নেই, রয়েছে প্রচুর হাইড্রোজেন। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একীভূত হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় কিছু ভর হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া এই ভর রূপান্তরিত হয় শক্তিতে। আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc² সূত্র অনুযায়ী, এই ভর হারানোই সূর্যের বিপুল শক্তির উৎস। প্রতি মুহূর্তে কোটি কোটি হাইড্রোজেন পরমাণু একই সঙ্গে হিলিয়ামে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই বিশাল রূপান্তর তৈরি করছে অবিশ্বাস্য শক্তি। এই শক্তিই সূর্যকে আলোকিত করে এবং উষ্ণ রাখে আমাদের গ্রহকে।
৩. পরম শূন্য, অর্থাৎ শূন্য কেলভিনে পৌঁছানো অসম্ভব
পদার্থের পরমাণু গতিশীল। যত বেশি ঠান্ডা হয়, পরমাণুর গতি তত ধীর হয়। এই নীতি রসায়নের অন্যতম ভিত্তি, যা বিভিন্ন পদার্থের হিমাঙ্ক ব্যাখ্যা করে। বিশুদ্ধ পানি ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা মাইনাস ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় জমাট বাঁধে। ইথানল মাইনাস ১১৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা মাইনাস ১৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে হিমায়িত হয়। হিসাব করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সম্ভাব্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হতে পারে কেলভিন স্কেলের ০ ডিগ্রি, অর্থাৎ ০ কেলভিন। একে বলা হয় পরম শূন্য। এর মান মাইনাস ৪৫৯.৬৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা -২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সমতূল্য।
এ তাপমাত্রায় যেকোনো পদার্থের পরমাণু সম্পূর্ণ স্থির হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ, পরমাণুর গতির জন্য শক্তি প্রয়োজন। পরম শূন্য তাপমাত্রায় সব শক্তি শূন্য হয়ে যায়। কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থায় পদার্থ জমে কঠিন এবং রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কথা।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি। এ নীতি অনুসারে, একই সঙ্গে একটি কণার অবস্থান ও ভরবেগ সঠিকভাবে জানা অসম্ভব। তাপমাত্রা যখন পরম শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন গ্যাসের কণাগুলো প্রায় নিশ্চল হয়ে পড়ে। শূন্য কেলভিন বা পরম শূন্য তাপমাত্রায় এসব কণার আর কোনো গতি থাকে না। এ অবস্থায় এর অবস্থান ও ভরবেগ—দুটোই স্থিরভাবে জানা সম্ভব। তবে এটি প্রাকৃতিকভাবে সম্ভব নয়। তাই কোনো পদার্থ পরম শূন্যে পৌঁছাতে পারে না।
তাহলে, কতটা হিমায়িত করা সম্ভব কোনো পদার্থকে? বিজ্ঞানীরা ২০২১ সালে এক পরীক্ষণে পদার্থের তাপমাত্রা এক কেলভিনের ০.০০০০০০০০০০৩৮ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
৪. বেশির ভাগ অ্যাসিড কাচ দ্রবীভূত করতে পারে না
কাচ অনন্য রাসায়নিক পদার্থগুলোর একটি। প্রায় ৩ হাজার ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটি আবিষ্কৃত হয়। অনেকের ধারণা, কাচ তরল। তবে এ ধারণা সত্য নয়। কাচের অস্বাভাবিক রসায়নই এই বিভ্রান্তি তৈরি করে। কাচ ভঙ্গুর, তবে এর পারমাণবিক গঠন স্থিতিশীল ও শক্তিশালী। এটি প্রধানত সিলিকন ডাই-অক্সাইড দিয়ে তৈরি, যা শক্তিশালী, স্থিতিশীল রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে। তাই অ্যাসিড প্লাস্টিক ও ধাতু গলাতে সক্ষম হলেও কাচ অ্যাসিড প্রতিরোধী। কারণ, অ্যাসিড কাচের রাসায়নিক বন্ধন ভাঙার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
সালফিউরিক অ্যাসিড এবং অ্যাকুয়া রেজিয়া তথা রাজ অম্ল—মানে নাইট্রিক অ্যাসিড ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের ঘণ মিশ্রণ অত্যন্ত শক্তিশালী। অ্যাকুয়া রেজিয়া স্বর্ণের মতো ধাতুকেও গলিয়ে ফেলতে পারে, তাই একে বলা হয় রাজ অম্ল। এরকম যেসব শক্তিশালী অ্যাসিড বেশির ভাগ ধাতুকে দ্রবীভূত করতে পারে, সেগুলোও কাচের ওপর কাজ করে না। তবে কিছু প্রচণ্ড শক্তিশালী অ্যাসিড আছে। এগুলো দারুণ ক্ষয়কারী। যেমন ফ্লোরিনের অ্যাসিড কাচ দ্রবীভূত করতে পারে। কারণ, ফ্লোরিনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা বা ইলেকট্রনোগেটিভিটি অনেক বেশি। এর মানে, এটি তীব্রভাবে ইলেকট্রনকে আকর্ষণ করে। ফলে এটি কাচ থেকে ইলেকট্রন নিয়ে নেয় এবং রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে কাচকে দ্রবীভূত করে ফেলতে পারে।
৫. বেশির ভাগ হাইড্রোজেনই ১৩ বিলিয়ন বছরেরও বেশি পুরানো
প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল মহাবিশ্বের। এর প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর প্রথম পরমাণু তৈরি হয়েছিল। সেই পরমাণু আর কিছু নয়, হাইড্রোজেন। এটি মহাবিশ্বের সরলতম মৌল। প্রতিটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটি প্রোটন এবং একটি ইলেকট্রন থাকে। মহাবিশ্বের বর্তমান ভরের প্রায় ৭৫ শতাংশই হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেনের পর তৈরি হয় হিলিয়াম, যাতে দুটি প্রোটন এবং দুটি ইলেকট্রন থাকে। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় পর্যায় সারণির ভারী মৌলগুলো। এর অনেকগুলোর জন্ম বিশাল নক্ষত্রের কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লীতে। নক্ষত্রের ভেতরে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হালকা মৌল থেকে তৈরি হয় ভারী মৌল। যেমন কার্বন—পৃথিবীর সব প্রাণই কার্বননির্ভর। তামা ও ম্যাগনেসিয়ামের মতো উপাদানও এভাবেই তৈরি হয়েছিল। এ সব উপাদানের বয়স তাই কয়েক বিলিয়ন বছর। তবে সবচেয়ে পুরাতন ও বয়স্ক বলা যায় হাইড্রোজেনকেই। কারণ, মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারের হিসেবে মহাবিশ্বের জন্মের পরপরই তৈরি হয়েছিল হাইড্রোজেন। এর বয়স ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি বছরেরও বেশি! মানুষের দেহের প্রায় ১০ শতাংশ হাইড্রোজেন। কী, বিস্ময়কর না?