মহাবিশ্বের মাত্র ১% রাসায়নিক আবিষ্কৃত, বাকিগুলো কোথায়

মহাবিশ্বের মাত্র এক শতাংশ রাসায়নিক যৌগের কথা শুধু জানি আমরা। বেশির ভাগ যৌগ এখনো রয়ে গেছে অনাবিষ্কৃত, অজানা। এরকম কত যৌগ থাকতে পারে মহাবিশ্বে?

পর্যায় সারণির একাংশছবি: সংগৃহীত

মহাবিশ্বজুড়ে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন রাসায়নিক। কোনো কোনোটির কাজ অনেক, কোনোটির কাজ নিতান্ত অল্প। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, এতসব রাসায়নিকের মধ্যে আমরা মাত্র এক শতাংশের খোঁজ পেয়েছি। তাঁরা মনে করেন, অনাবিষ্কৃত রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কারের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে গ্রিনহাউস গ্যাস সমস্যা। কিংবা পেনিসিলিনের মতো কোনো বিপ্লব ঘটতে পারে এর ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে।

কথা হলো, এসব রাসায়নিক তাহলে আবিষ্কৃত হয়নি কেন? সে বিষয়টা বুঝতে হলে প্রথমে পর্যায় সারণির কথা জানা প্রয়োজন। মৌলদের এই সারণিতে রয়েছে আমাদের জানা সব মৌলের তালিকা। ১৯৬৯ সালে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিভ এই তালিকা আবিষ্কার করেন। এতে ধারাবাহিকভাবে, পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজানো আছে মৌলগুলো। তালিকাটির বিশেষত্ব, এতে একই কলামে ও সারিতে থাকা মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্য একইরকম। শুধু তা-ই নয়, এ তালিকার মাধ্যমে বলে দেওয়া যায় কোন মৌল কোথায় বসবে। যেমন মেন্ডেলিভ এই তালিকা যখন প্রণয়ন করেন, তখন এতে মৌলের সংখ্যা ছিল ৬৩টি। পরে গড়ে প্রতি দুই থেকে তিন বছরে একটি করে মৌল আবিষ্কৃত হয়। মেন্ডেলিভ এরকম কিছু মৌলের ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। সেগুলোর খোঁজ পাওয়া গেছে ধীরে ধীরে।

বর্তমানে পর্যায় সারণিতে মৌলের সংখ্যা ১১৮। ১১৮তম মৌলটির নাম অগানেসন। প্রশ্ন আসতে পারে, এমন কত মৌল থাকতে পারে পর্যায় সারণিতে? এর কি কোনো শেষ আছে? সব রসায়নবিদেরাই এ বিষয়ে একমত। তাঁরা মনে করেন, এর শেষ আছে। এরপর আর নতুন কোনো মৌল পাওয়া যাবে না। এর পেছনে যুক্তি হলো, অনেক বেশি ইলেকট্রন যখন একটা নিউক্লিয়াসের চারপাশে থাকবে, তখন একসময় দেখা যাবে ইলেকট্রনগুলো আর ওই নিউক্লিয়াসের আকর্ষণে বাঁধা থাকছে না। তখন আসলে ওই মৌলের আর অস্তিত্বই থাকবে না।

এ ব্যাপারে রিচার্ড ফাইনম্যানের হিসাব হলো, ১৩৭ নম্বর পর্যন্ত  মৌল আবিষ্কার করা সম্ভব। এর পরে আর নিরপেক্ষ মৌল সম্ভব নয় ইলেকট্রনের সংখ্যাধিক্যের কারণে। এ হিসাব তিনি করেছেন রিলেটিভিস্টিক ডিরাক সমীকরণ ব্যবহার করে। কিন্তু পরে কোয়ান্টাম ইলেকট্রডাইনামিকস ব্যবহার করে দেখা গেছে, এই সংখ্যাটা হবে ১৭৩। এটা আরও নিখুঁত হিসাব। তবে অনেকের ধারণা, ১৩৭ নম্বর পরমাণুই হলো পর্যায় সারণির সর্বোচ্চ সীমা।

এতসব রাসায়নিকের মধ্যে বিজ্ঞানীরা মাত্র এক শতাংশের খোঁজ পেয়েছেন
ছবি: সংগৃহীত

পর্যায় সারণির শেষ মানে মৌলের শেষ। তবে এটি রাসায়নিকের শেষ নয়। কারণ, মহাবিশ্বের মৌলের সংখ্যা অল্প হতে পারে, তবে রাসায়নিক যৌগের সংখ্যা অনেক। অনেক মানে অনেক।

এবারে একটু যৌগের বিষয়টা বোঝা যাক। একাধিক মৌলের পরমাণু একসঙ্গে মিলে কোনো যৌগের অণু তৈরি করে। যেমন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলে তৈরি করে পানি। যৌগের আরেকটি বিষয় হলো, কিছু যৌগ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। কিছু যৌগ আবার তৈরি করা হয় কৃত্রিমভাবে, গবেষণাগারে। যেমন নাইলন। এটি আবিষ্কৃত হয়েছে গবেষণাগারে, বর্তমানে তৈরি করা হয় কারখানায়।

তার মানে, সব যৌগই দুই বা আরও বেশি মৌলের পরমাণু মিলে তৈরি করে। তাহলে, এরকম কত রাসায়নিক যৌগ থাকতে পারে মহাবিশ্বে? আমরা ১৭৩ বা ১৩৭ ধরে হিসাব করব না। তারচেয়ে বরং ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত মৌলের সংখ্যা—১১৮ ধরেই হিসাবটা করা যাক।

২.

প্রথমে দ্বিপরমাণুক যৌগের কথা ভাবা যেতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে ৬ হাজার ৯০৩টি দুই পরমাণুবিশিষ্ট যৌগ থাকার কথা। এরকম একটি নতুন যৌগের অণু তৈরি করতে কমিয়ে ধরে যদি বলি, ধরুন, হয়তো এক বছরের মতো লাগবে একজন রাসায়নিকের। তাহলে প্রায় ৭ হাজার দ্বিপরমাণুক যৌগ অণু তৈরি করতে যে ম্যানহাটন প্রকল্পের মতো করে আস্ত শহর বানিয়ে রসায়নবিদদের দলকে কাজে নামিয়ে দিতে হবে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

এবারে তিন পরমাণুবিশিষ্ট যৌগের কথা ভাবা যাক। যেমন পানি বা কার্বন ডাই-অক্সাইড। এরকম পরমাণু থাকার কথা, তাত্ত্বিকভাবে, ১.৬ মিলিয়ন। এভাবে ৪ বা ৫ পরমাণুবিশিষ্ট যৌগের অণুতে যখন পৌঁছাব, দেখা যাবে, সেগুলো তৈরি করতে গোটা পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষকেই কাজে নামিয়ে দিতে হচ্ছে। এত সব রাসায়নিক যৌগ বানাতে প্রচুর পরিমাণ পদার্থ রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তুলে আবারও ব্যবহার করতে হবে। এর ঝক্কি আর না বলি!

তবে এ শুধু সরল করে বলা। রাসায়নিক যৌগ টেকসই হবে কি না, তার গঠন কেমন হবে—এ ধরনের বিষয়গুলো নতুন যৌগ আবিষ্কার বা তৈরি করাটা বাস্তবে আরও কঠিন করে তুলবে।

হয়তো ভাবছেন, তাহলে সবচেয়ে বড় কত পরমাণুবিশিষ্ট অণু আবিষ্কার করেছেন রসায়নবিজ্ঞানীরা? উত্তরটা শুনলে আপনি চমকে যেতে পারেন। দানবাকার কোবাল্টিসিয়াম ডেনড্রাইমার (Giant Cobalticinium Dendrimers) নামের এ যৌগের অণুতে পরমাণুর সংখ্যা তিন মিলিয়নের মতো! এটা দিয়ে কী করা যেতে পারে, আমরা এখনো জানি না। কিন্তু একইরকম যৌগের ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানীরা। ক্যানসারের ওষুধ দেহের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে সক্রিয় হওয়ার আগপর্যন্ত এ ধরনের যৌগ ওষুধকে সুরক্ষা দেয়।

আরও পড়ুন
অনেক বিজ্ঞানী এরকম ব্যতিক্রম যৌগ উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাটিয়ে দেন গোটা জীবন। তাঁরা অনেক সময় সফলও হন। তাহলে, প্রশ্ন আসে, কীভাবে অজানা যৌগ খুঁজে ফেরেন বিজ্ঞানীরা?

৩.

নিশ্চয়ই ভাবছেন, এরকম ইচ্ছেমতো এক মৌলের পরমাণুকে অন্য মৌলের সঙ্গে মিশিয়ে বা বিক্রিয়া করিয়ে দিলেই কি হবে? তৈরি হয়ে যাবে যৌগ? আসলে তা নয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ার নিয়ম আছে।

যেমন মৌলগুলো নির্দিষ্ট সংখ্যক পরমাণুর সঙ্গেই যুক্ত হতে পারে। একটা মৌল কয়টা পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তাকে প্রকাশ করা হয় যোজনী সংখ্যা দিয়ে। আসলে, মৌলের পরমাণুতে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে থাকে ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রনগুলো সব একসঙ্গে থাকে না। বিভিন্ন কক্ষপথে থাকে। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের কক্ষপথে থাকতে পারে ২টি ইলেকট্রন। এর পরের কক্ষপথে থাকতে পারে ৮টি ইলেকট্রন। এভাবে কক্ষপথের নম্বর বাড়লে বেশি ইলেকট্রন থাকতে পারে। এটার একটা নিয়ম আছে, তবে এ নিয়ে এখানে আর বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। শুধু বলব, এরকম করে শেষ কক্ষপথে যে কয়টি বিজোড় ইলেকট্রন থাকে, তার ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় একটি মৌলের যোজনী সংখ্যা কত হবে।

তবে সব মৌল আবার বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না। এ ধরনের মৌলগুলোকে বলে নিষ্ক্রিয় মৌল। তবে এগুলো মূলত গ্যাস। এ জন্য এদেরকে নিষ্ক্রিয় গ্যাসও বলা হয়। যেমন নিয়ন, আর্গন, ক্রিপ্টন ইত্যাদি। এর মধ্যে আবার ব্যতিক্রম আছে। যেমন আর্গন হাইড্রাইড (ArH+)। এটা পৃথিবীতে পাওয়া যায় না, তবে মহাকাশে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে গবেষণাগারে মহাকাশের পরিবেশ তৈরি করে এ যৌগ বানাতে পেরেছেন। তার মানে, এ ধরনের পরিবেশের কথা যদি ভাবেন, তবে সম্ভাব্য যৌগের সংখ্যা বেড়ে যায় আরও।

অর্থাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ার যেসব নিয়ম আছে, সেগুলোর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। এ জন্য প্রচলিত একটা কথা বলেন রসায়নের অনেক শিক্ষার্থীই। তাঁদের মুখে শোনা যায়, শিক্ষক বলছেন, ‘রসায়নের অনেক নিয়মই ব্যতিক্রম। সেটা মনে রাখতে হবে!’

অনেক বিজ্ঞানী এরকম ব্যতিক্রম যৌগ উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাটিয়ে দেন গোটা জীবন। তাঁরা অনেক সময় সফলও হন। তাহলে, প্রশ্ন আসে, কীভাবে অজানা যৌগ খুঁজে ফেরেন বিজ্ঞানীরা?

এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যেতে পারে দুই ভাগে। এক, ‘জানা’ অজানার খোঁজ। আর দুই, ‘অজানা’ অজানার খোঁজ।

অনেক সময় বিজ্ঞানীরা জানা কোনো যৌগ নিয়ে তার উপাদান মৌল বদলে দেন। কিংবা বদলে দেন বিক্রিয়ার প্রভাবক বা পরিবেশ। ফলে নতুন যৌগ পাওয়া যায়। আবার অনেক সময় জানা কোনো ধরনের বিক্রিয়া ঘটানো হয় ভিন্ন কোনো মৌল নিয়ে। এই দুই পদ্ধতিতে ‘জানা’ অজানা যৌগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ এসব যৌগ অজানা, তবে তৈরি করা হচ্ছে জানা পদ্ধতিতে।

আরও পড়ুন
এখন অবশ্য এক্স-রে করে দেখা যায়, এমআরআই করা যায়। এভাবে সহজে বের করা যায় জানা যৌগের রাসায়নিক গঠন। আর অজানা যৌগ উদ্ভাবনের জন্য, বিশেষ করে ওষুধ বা এ ধরনের প্রয়োজনীয় যৌগ বানাতে বিজ্ঞানীরা সিমুলেশনের সাহায্য নেন।
অনেক বিজ্ঞানী ব্যতিক্রম যৌগ উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাটিয়ে দেন গোটা জীবন
ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু ‘অজানা’ অজানা যৌগ আবিষ্কারের উপায় কী? উত্তরটা সহজ, যদিও কাজটা কঠিন—চোখ-কান খোলা রাখা। এভাবেই চোখ-কান খোলা রেখে ১৯২৮ সালে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন। এরপর প্রায় এক যুগ লেগে গেছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পেনিসিলিন বানানোর প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে গিয়ে। ১৯৩৯ সালে হাওয়ার্ড ফ্লোরি এই প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। আরও ৬ বছর পর, ১৯৪৫ সালে ডরোথি ক্রফুট হজকিন আবিষ্কার করেন পেনিসিলিনের রাসায়নিক গঠন। অর্থাৎ আবিষ্কৃত একটা যৌগকে জানতেই কত শ্রম দিতে হয়ে তাঁদের, ভাবুন!

এখন অবশ্য এক্স-রে করে দেখা যায়, এমআরআই করা যায়। এভাবে সহজে বের করা যায় জানা যৌগের রাসায়নিক গঠন। আর অজানা যৌগ উদ্ভাবনের জন্য, বিশেষ করে ওষুধ বা এ ধরনের প্রয়োজনীয় যৌগ বানাতে বিজ্ঞানীরা সিমুলেশনের সাহায্য নেন। এর মাধ্যমে তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করেন, কী ধরনের পরিবেশে কী প্রভাবক ব্যবহার করে এই যৌগ বানানো সম্ভব। তবে সেগুলোও সবসময় বাস্তবে কাজ করে না। তখন আবার শুরু করতে হয় নতুন করে।

সে জন্য বিজ্ঞানীরা আজও চোখ-কান খোলা রাখেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতো জ্যোতিঃরসায়নবিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বিশালতায় খুঁজে ফেরেন নতুন যৌগ। আর রসায়নবিদেরা পৃথিবীর কোণে কোণে, খুদে জগতে খুঁজে ফেরেন পেনিসিলিনের মতো নতুন যৌগ। বিপ্লব বা জগৎ বদলে দেওয়া রাসায়নিক কোথায় যে খুঁজে পাওয়া যাবে, তা আসলে কেউ জানে না!

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া,

ইবরাহিম মুদ্দাসসের, পর্যায় সারণি: শেষ কোথায়, বিজ্ঞানচিন্তা