রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়ামের আবিষ্কর্তা মেরি কুরি ও তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি। পিচব্লেন্ড খনিজ থেকে ইউরেনিয়াম আলাদা করার পরও তাতে তেজস্ক্রিয় ধর্ম দেখতে পান কুরি দম্পতি। ১৯৯৮ সালের ২১ ডিসেম্বর এই মৌল আবিষ্কার করেন তাঁরা। এর পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমিতে এই আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছিলেন কুরি দম্পতি। প্রায় এক বছর পর মৌলটির নামকরণ করা হয় রেডিয়াম। শব্দটির উত্স ল্যাটিন রেডিয়াস (রশ্মি) থেকে। রশ্মিরূপে মৌলটি শক্তি নিঃসরণ করতে পারে বলেই এমন নামকরণ।
রেডিয়াম পানিতে মেশালে তা অন্ধকারে জ্বলতে থাকে। মৌলটি আবিষ্কারের পর একে বেশ কিছু রোগ নিরাময়ের অলৌকিক টনিক হিসেবে ভাবা হয়েছিল। সে কারণেই বিশ শতকের শুরুর দিকে আশ্চর্য ওষুধের উপাদান হিসেবে রেডিয়াম ব্যবহার করা হতো। হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে এটি তাই মহৌষধ ছিল। এ সময়েই রেডিয়াম চকলেট, রেডিয়াম ওয়াটার, রেডিয়াম ব্রেড নামের নিত্যনতুন পণ্যে বাজার ছেয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল রেডিঅ্যান্ডোক্রিনেটর নামের একটি যন্ত্র। যৌবন ধরে রাখতে, সতেজ জীবন লাভের আশায় অনেকেই এই দামি যন্ত্রটি পেটের নিচে বেঁধে রাতে ঘুমাত। প্রায় ক্রেডিট কার্ডের সমান এই যন্ত্রে অনেকখানি রেডিয়াম ব্যবহার করা হতো। তাতে এটি বানানোর খরচও ছিল বেশি। তাই দামটাও অনেক বেশি হওয়ায় এর প্রধান ক্রেতা ছিল মূলত বিত্তবানেরা। অন্যদিকে সাধারণের জন্য সস্তায় কিছু ভুয়া রেডিঅ্যান্ডোক্রিনেটর যন্ত্রও বাজারে পাওয়া যেত। এগুলোতে রেডিয়াম থাকত খুব অল্প কিংবা কোনো কোনোটাতে থাকতই না। এই সস্তা যন্ত্রগুলোর স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতা ছিল যৌবন ধরে রাখতে আগ্রহী গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি। মজার ব্যাপার হলো, এই দরিদ্ররাই ছিল ভাগ্যবান। কারণ, তাদের যন্ত্রে রেডিয়াম কম থাকায় তাদের দেহে ক্ষতির পরিমাণও ছিল অনেক কম।
আবার অন্ধকারে ঘড়ি দেখার সুবিধার্থে সে সময় ঘড়ির ডায়ালে রেডিয়াম মিশ্রিত রং ব্যবহার করা হতো। এসব রঙে প্রায় এক মাইক্রোগ্রাম রেডিয়াম থাকত। আর এসব কাজে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি কারখানায় তরুণ নারী কর্মীদের নিয়োগ করা হয়েছিল। ঘড়ির ডায়ালে রেডিয়াম–মিশ্রিত আলোকপ্রভাযুক্ত রঙে রাঙাতে বিশেষ ধরনের ব্রাশ ব্যবহার করা হতো। ব্রাশগুলোর ডগা ঠিক রাখতে ঠোঁট দিয়ে চাটার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ওই মেয়েদের। ইতিহাসে রেডিয়াম গার্ল নামে পরিচিত এই মেয়েদের বলা হয়েছিল রেডিয়াম ক্ষতিকর নয়। তাই অনেকে ফ্যাশন হিসেবেও রেডিয়াম ব্যবহার শুরু করছিল। এর অংশ হিসেবে অনেকেই চুলে, চোখের পাতায়, নখে, ঠোঁটে রেডিয়ামের প্রলেপ লাগাত। এমনকি দাঁতেও রেডিয়াম লাগাত অনেকে, যাতে অন্ধকারে সেখান থেকে প্রভা ছড়ায়। কিছুদিন পরই এর ফলাফল হাতে হাতে পেয়েছিল রেডিয়াম ব্যবহারকারীরা। শুরুতেই অনেকের দাঁত পড়ে গেল, দেহে রক্তশূন্যতা দেখা দিল। এ ছাড়া চোয়ালে পচন, তারপর ক্যানসার ধরা পড়ল। নিউ জার্সির একটি কারখানায় এভাবেই শতাধিক মেয়ে মারা গিয়েছিল। অনেক পরে রেডিয়ামের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়েছিল।