রসায়নের শত গল্প

প্রকৃতির সবখানেই রসায়ন। আমাদের দেহের কথাই বলি কিংবা চারপাশ ঘিরে থাকা বাতাস, ফুলের ঘ্রাণ—সবকিছুতেই আছে রসায়ন। এর মূল কথাগুলো সহজে জানা সম্ভব? মহাবিশ্বের মতো বিপুল রসায়নের জগতের মূল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় তুলে আনার সেই চেষ্টা করেছেন লেভ ভ্লাসভ ও দ্‌মিত্রিই ত্রিফোনভ। বাংলায় অনূদিত হয়েছে সরাসরি রুশ থেকে, রসায়নের শত গল্প নামে।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কোয় ছিল প্রগতি প্রকাশন। সেখান থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। সেটা ১৯৭৮ সালের কথা। অনুবাদ করেন দ্বিজেন শর্মা। অঙ্গসজ্জা করেছেন লেওনিদ লাম। ক্লাসিক এই বইটি এতদিন পরও প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে।

'রসায়
'রসায়নের শতগল্প' বইয়ের প্রচ্ছদ

মুখবন্ধের বিকল্প

একদা প্রাচ্যের এক প্রাজ্ঞ শাসক পৃথিবীবাসী সব মানুষের সম্পূর্ণ বিবরণ জানতে চান। তিনি তাঁর উজিরদের তলব করে বলেন, ‘আমার জন্য পৃথিবীর সব জাতির একটি ইতিহাস রচনার ব্যবস্থা করুন। আমি জানতে চাই, তারা আগে কেমন ছিল আর এখন কেমন আছে। তারা কী করে, কোন কোন যুদ্ধ করেছে এবং এখন করছে। আর বিভিন্ন দেশে কী কী শিল্পবাণিজ্য ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে।’

এ জন্য তিনি সময় বরাদ্দ করেন পাঁচ বছর। উজিররা নীরবে কুর্নিশ সেরে বিদায় নিলেন। অতঃপর তাঁরা রাজ্যের প্রাজ্ঞতম ব্যক্তিদের আহ্বান করলেন ও তাঁদের শাসকের ইচ্ছার কথা জানালেন। শোনা যায়, এর পর পরই পার্চমেন্ট শিল্পের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল...

পাঁচ বছর পর উজিররা আবার প্রাসাদে মিলিত হলেন। ‘জাঁহাপনা, আপনার ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছে। জানালা দিয়ে তাকান, দেখুন আপনার ঈপ্সিত...’

শাসক বিস্ময়ে চোখ ঘষলেন। প্রাসাদের সামনে উটের কাফেলা, আর তার শেষ প্রান্ত দিগন্তে অদৃশ্য। প্রতিটি উটের পিঠে দুটি বিশাল বোঝা। প্রতি বোঝায় মরক্কো বাঁধাই দশ খণ্ড বিপুলাকার গ্রন্থ।

‘এসব কী?’ সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন।

‘বিশ্ব ইতিহাস,’ জবাব দিলেন উজিরবৃন্দ। ‘আপনার আদেশে প্রাজ্ঞতমরা পাঁচ বছর এ জন্য দিনরাত শ্রম করেছেন!’

‘আমার সঙ্গে তামাশা?’ গর্জন করলেন সম্রাট। ‘সারা জীবনে আমি এর এক দশমাংশও পড়তে পারব না! তারা আমার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখুক। কিন্তু এতে সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী থাকা চাই।’

তিনি তাঁদের আরও এক বছর সময় মঞ্জুর করলেন। বছর শেষ হলো। প্রাসাদের সামনে আবার একটি কাফেলা। এবার উটের সংখ্যা দশ এবং উটপ্রতি বোঝা ও বইয়ের পরিমাণ আগের মতোই।

সম্রাট রেগে আগুন। ‘সর্বকালে সর্বজাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীই শুধু এরা লিখুক। কত সময় চাই তোমাদের?’

প্রাজ্ঞতমদের প্রধান এগিয়ে এসে বললেন, ‘জাঁহাপনা, শুধু একদিন, আগামীকালই আপনার আজ্ঞা পালিত হবে!’

‘আগামীকাল?’ বিস্মত সম্রাটের মুখে তাই প্রতিধ্বনিত হলো, ‘বহুৎ আচ্ছা, আমাকে ঠকানোর চেষ্টায় কিন্তু গর্দান নিশ্চিত।’

সবেমাত্র নীলাকাশে সূর্য উঠেছে, আর ফুলকুড়ির ঘুম টুটেছে। ঠিক তখনই সম্রাট প্রাজ্ঞতমকে তলব করলেন। প্রাজ্ঞতম ঘরে এলেন। হাতে তাঁর ছোট একটি চন্দনপেটিকা।

‘জাহাঁপনা, এরই মধ্যে সর্বকালে সর্বজাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী পাবেন,’ নত প্রাজ্ঞ বললেন।

সম্রাট বাক্সটি খুললেন। মখমলের গদিতে ছোট এক টুকরা কাগজ। এতে লেখা শুধু একটি বাক্যাংশ: ‘তারা জন্মেছিল, বেঁচেছিল এবং প্রয়াত হয়েছিল।’

এভাবেই প্রাচীন কাহিনীটি প্রচারিত। আর আমাদের যখন সীমিত পরিমাণ কাগজে (অর্থাৎ বইয়ের আয়তন সীমিত করে) রসায়ন সম্পর্কে একটি আকর্ষী বই লিখতে বলা হলো, তখন কাহিনীটি স্মরণ না করে উপায় ছিল না। এর অর্থ, আমরা সেরা ঘটনাগুলোই শুধু লিখতে পারব। কিন্তু রসায়নের সেরা বিষয় কোনগুলো?

‘রসায়ন—বস্তু ও তাদের রূপান্তরের বিজ্ঞান।’

জীবনের প্রতিটি অভিব্যক্তিই অজস্র রাসায়নিক প্রক্রিয়ালগ্ন। রসায়ন ও তার নিয়মাবলী ব্যতিরেকে জীবনের কর্মকাণ্ড অনুধাবন অসম্ভব। রসায়ন আমাদের খাদ্য, বস্ত্র ও পাদুকার জোগানদার। আধুনিক সভ্য সমাজ-জীবনের অপরিহার্য সবকিছুই তো রসায়নপ্রদত্ত।
আরও পড়ুন

চন্দনপেটিকার সেই কাগজটুকরোর উদ্ধৃতিটি স্মরণ করুন। আমরা মাথা চুলকেছি, মস্তিষ্ক নিংড়েছি এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে রসায়নের সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। এর কোনোটি ব্যক্তিবিশেষের কাছে কম বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অজৈব রসায়নবিদের কাছে অজৈব রসায়নই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সারাৎসার। কিন্তু জৈব রসায়নবিদ বলবেন ঠিক উল্টো কথা। এ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো ঐক্যমত অসম্ভব।

‘সভ্যতা’ ধারণাটি বহুবিধ আনুষঙ্গিকের সমাহার এবং এর মধ্যে রসায়নই সর্বপ্রধান। মানুষ রসায়নের সাহায্যে আকরিক ও খনিজ থেকে ধাতু নিষ্কাশন করে। রসায়ন ব্যতীত আধুনিক ধাতুশিল্প সম্ভব হতো না। রসায়নের সাহায্যেই উদ্ভিদ, প্রাণী ও খনিজ থেকে ক্রমান্বয়ে আশ্চর্য থেকে আশ্চর্যতর সামগ্রী উৎপন্ন হচ্ছে। রসায়ন শুধু প্রকৃতিকে অবিকল অনুকরণ বা নকল করে না, বরং একে বছরের পর বছর ক্রমাগত নানাভাবে অতিক্রম করে যায়। হাজার হাজার পদার্থ উৎপন্ন হয়েছে যা প্রকৃতির রাজ্যে অনুপস্থিত, অথচ মানুষের জীবন ও কর্মের পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। রসায়নের শতকার্যের তালিকা বস্তুত অন্তহীন।

জীবনের প্রতিটি অভিব্যক্তিই অজস্র রাসায়নিক প্রক্রিয়ালগ্ন। রসায়ন ও তার নিয়মাবলী ব্যতিরেকে জীবনের কর্মকাণ্ড অনুধাবন অসম্ভব। রসায়ন আমাদের খাদ্য, বস্ত্র ও পাদুকার জোগানদার। আধুনিক সভ্য সমাজ-জীবনের অপরিহার্য সবকিছুই তো রসায়নপ্রদত্ত।

ভূ-মহাকর্ষ অতিক্রম করে রকেটগুলো চন্দ্র, মঙ্গল, শুক্র ও বুধে পৌঁছেছে। তাদের মোটরের জন্য জ্বালানি এবং কাঠামোর জন্য তাপসহিষ্ণু উপাদান এল রসায়ন থেকে।

যদি কেউ রসায়নের সবকিছু, এর বহুবিধ পর্যায় এবং সমৃদ্ধির কাহিনী লেখেন, তা হলে অত্যুন্নত যেকোনো দেশের কাগজসম্ভারে অবশ্যই টান পড়বে। সৌভাগ্যবশত, এমন চিন্তা আজও কারো মাথায় আসেনি। কিন্তু আমাদের কাজটা অনেকটা এ ধরনের।

সেই পুরানো উভয়সঙ্কট থেকে উদ্ধারের একটি পথ আমরা খুঁজে পেয়েছি। আমরা বহুবিধ বিষয় সম্পর্কে অল্প করে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য কী সম্পর্কে লিখব, সে আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। অন্য লেখক সম্ভবত অন্য বিষয়াদি সম্পর্কে লিখতেন, তৃতীয়জন ভিন্নতর বিষয়ে বেছে নিতেন। কিন্তু বইটি আমাদের, আর এ জন্যই তা আমাদের পছন্দমতো লেখা। তাই হুবহু আপনার ইচ্ছাপূরণ না হলে আমাদের ওপর দয়া করে ক্ষুদ্ধ হবেন না।

মেন্দেলিভের সারণীতে বিস্ময়ের কী আছে? শুরুতেই বলা যায় এর পর্যায়সমূহ, অর্থাৎ তলাগুলো বিভিন্নভাবে পরিকল্পিত। ওপর তলা অথবা মেন্দেলিভের সারণীর প্রথম পর্যায়ে ঘর বা কোঠার সংখ্যা মাত্র দুটি। দ্বিতীয় ও তৃতীয়ের প্রত্যেকটিতে আটটি এবং পরের দুটি তলায় (চতুর্থ ও পঞ্চম) আঠারোটি করে। এটি যেন এক হোটেল। এর নিচের দুটিতে (ষষ্ঠ ও সপ্তম) ঘরের সংখ্যা আরও বেশি, প্রতিটিতে ৩২টি।
আরও পড়ুন
মেন্দেলিভের পর্যায়বৃত্ত সারণী

বড় বাড়ির বাসিন্দারা

এক নজরে পর্যায়বৃত্ত

এক নজরে দেখা, অস্পষ্ট ধারণা সাধারণত মূল্যহীন। দর্শক এতে কখনও উদাসীন থাকেন, কখনো বা বিস্মিত হন। দৈবাৎ জিরাফের সামনে অভিভূত বিখ্যাত সেই কাহিনীর নায়কের মতো তাঁর বিমুগ্ধ উক্তি শোনা যায়,—‘এ সত্য হতেই পারে না!’

কিন্তু প্রথম পরিচয়ে, এক নজর কোনো বস্তু বা প্রক্রিয়া দেখলে, হয়ত কখনো এতে আপনার কিছু উপকারও হতে পারে। মেন্দেলিভের করা মৌলের পর্যায়বৃত্তকে কোনো বস্তু বা প্রক্রিয়া বলা দুষ্কর। একে বরং আয়না বলাই ভালো। এতে প্রতিফলিত প্রকৃতির অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ম—পর্যায়বৃত্তের সারমর্ম। পৃথিবীজাত অথবা মানুষের তৈরি শতাধিক মৌলিক পদার্থ এরই অনুবর্তী, যেন রাসায়নিক মৌলের বড় বাড়ির অবশ্যপালনীয় একপ্রস্থ নিয়ম।

বাড়িটির দিকে বারেক তাকালেই অনেক কিছু বোঝা সম্ভব। এই প্রথম অনুভূতিটিই বিস্ময়ের। বাড়িটি যেন স্বাভাবিক আকারের বড় প্যানেলের দালানকোঠার মাঝে উদ্ভট অথচ আকর্ষী স্থাপত্যের একটি নির্দশন।

মেন্দেলিভের সারণীতে বিস্ময়ের কী আছে? শুরুতেই বলা যায় এর পর্যায়সমূহ, অর্থাৎ তলাগুলো বিভিন্নভাবে পরিকল্পিত। ওপর তলা অথবা মেন্দেলিভের সারণীর প্রথম পর্যায়ে ঘর বা কোঠার সংখ্যা মাত্র দুটি। দ্বিতীয় ও তৃতীয়ের প্রত্যেকটিতে আটটি এবং পরের দুটি তলায় (চতুর্থ ও পঞ্চম) আঠারোটি করে। এটি যেন এক হোটেল। এর নিচের দুটিতে (ষষ্ঠ ও সপ্তম) ঘরের সংখ্যা আরও বেশি, প্রতিটিতে ৩২টি। এমন কোনো দালান দেখেছেন কখনও?

তবু এটিই রাসায়নিক পদার্থদের বড় বাড়ি, তথা পর্যায়বৃত্ত। স্থপতির খেয়াল? মোটেই না। জানেন তো, যেকোনো দালান তৈরির জন্য পদার্থবিদ্যার নিয়ম অবশ্য পালনীয়। অন্যথা আলতো হাওয়ার তোড়েই তার দফা শেষ।

পর্যায়বৃত্তের গঠনশৈলীর অন্তর্গত ভৌত নিয়মাবলির শাসনও অনুরূপ কঠোর এবং মেন্দেলিভের সারণীর প্রতিটি পর্যায়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক মৌলিক পদার্থের অবস্থিতি এই নিয়মেই নির্ধারিত। দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রথম পর্যায়টি উল্লেখ্য। এখানে দুটি মৌলের অবস্থান নির্দিষ্ট, এর কমও নয় বেশিও নয়।

পদার্থবিদ সমর্থিত এই প্রত্যয় সম্পর্কে রসায়নবিদরাও অভিন্নমত।

মেন্দেলিভের আগেও তৎকালে জ্ঞাত ষাটের বেশি সংখ্যক মৌলকে শ্রেণীবদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। সম্ভবত নিউল্যাণ্ডস নামে জনৈক ব্রিটিশ সত্যের সর্বাধিক সমীপবর্তী ছিলেন। তিনি ‘অষ্টক সূত্রের’ সুপারিশকারী।
আরও পড়ুন

কিন্তু অন্যথাও ছিল। একসময় পদার্থবিদরা চুপই ছিলেন, কারণ পর্যায়বৃত্ত তখনো তাঁদের বিব্রত করতে শুরু করেনি। কিন্তু রসায়নবিদরা প্রায় প্রতি বছরই নতুন মৌল খুঁজে পাচ্ছিলেন, আর এই নবাগতদের জায়গা দেওয়ার সমস্যা নিয়ে ভাবনায় পড়েছিলেন। মাঝে মাঝে আবার বেজায় বিদঘুটে সমস্যাও দেখা দিত যখন সারণীর একই কোঠায় জায়গা নেওয়ার জন্য দাবিদাররা লাইন দিয়ে দাঁড়াত।

সন্দেহবাদী বিজ্ঞানীদের সংখ্যাও তখন কম ছিল না। তাঁরা পর্যাপ্ত গাম্ভীর্যে ঘোষণা করলেন যে মেন্দেলিভ-সারণীর প্রাসাদটি বালুর ওপর তৈরি। তাঁদেরই একজন ছিলেন জার্মান রসায়নবিদ বুনসেন, যিনি তাঁর বন্ধু কারশফের সঙ্গে বর্ণালীগত বিশ্লেষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি পর্যায়বৃত্তে প্রযুক্ত হলে, বুনসেন বৈজ্ঞানিক অদূরদর্শিতার এক বিস্ময়কর নজির সৃষ্টি করলেন। একসময় চটে গিয়ে বললেন, ‘এ তো মুদ্রা বাজারের কাগজপত্রের অঙ্কে নিয়মানুবর্তিতা সন্ধান!’

মেন্দেলিভের আগেও তৎকালে জ্ঞাত ষাটের বেশি সংখ্যক মৌলকে শ্রেণীবদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। সম্ভবত নিউল্যাণ্ডস নামে জনৈক ব্রিটিশ সত্যের সর্বাধিক সমীপবর্তী ছিলেন। তিনি ‘অষ্টক সূত্রের’ সুপারিশকারী। বর্ধমান পারমাণবিক ভর অনুসারে মৌল বিন্যাসের চেষ্টায় নিউল্যাণ্ডস দেখলেন, সঙ্গীতে যেমন উচ্চপর্যায়ে প্রতিবারই অষ্টম সুরে প্রথম সুরের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তেমনি প্রতিটি অষ্টম মৌলেও প্রথম মৌলের সদৃশ ধর্মই প্রকটিত হয়। কিন্তু নিউল্যান্ডসের আবিষ্কারটি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ার অভিব্যক্তি হলো, ‘আপনি কেন বর্ণানুক্রমিকভাবে মৌলগুলো বিন্যস্ত করেননি? এভাবেও তো একটি নিয়মানুবর্তিতা সন্ধান সম্ভব!’

এই ভেংচিমুখো প্রতিদ্বন্দ্বীদের কী জবাব দেবেন বেচারা নিউল্যান্ডস? মেন্দেলিভের সারণীও শুরুতে সুঅভ্যর্থিত হয়নি। এর ‘স্থাপত্য’ তীব্র আক্রমণের মুখোমুখি হয়। এর অনেক কিছুই তখনো অস্পষ্ট এবং তাই ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। আধ ডজন নতুন মৌল আবিষ্কারের চেয়ে সারণীতে তাদের যথাস্থানে স্থাপন অনেক বেশি কঠিন।

কেবল এক তলার ব্যাপারটি বোধ হয় সন্তোষজনক ছিল। ওখানে অপ্রত্যাশিত আবাসিকদের ঢুকে পড়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এখন এক তলায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের বাস। এগুলোর পরমাণুর নিউক্লীয় আধান যথাক্রমে ধনাত্মক ১ ও ২। এটা স্পষ্ট যে, এগুলোর মাঝামাঝি অন্যতর কোনো মৌলের অস্তিত্ব অসম্ভব। প্রকৃতির রাজ্যে এমন কোনো নিউক্লিয়াস বা কণা নেই, যাদের আধান ভগ্নাংশসংখ্যক। (অথচ ইদানীং তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা কোয়ার্কের অস্তিত্বের সমস্যা নিয়ে আলোচনারত।* নামটি প্রাথমিক মৌলিক কণার বেলায় প্রযুক্ত। এতদ্বারা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের উপকরণ প্রোটন ও নিউট্রনসহ বাকি সবকিছুই নির্মাণ সম্ভব। মনে করা হয় যে কোয়ার্ক ধনাত্মক ১/৩ ও ঋণাত্মক ১/৩, ইত্যাকার ভগ্ন আধানযুক্ত। যদি সত্যিই কোয়ার্ক বলে কিছু থাকে, তা হলে মহাজগতের ‘বন্ধু-বিন্যাস’ নতুনভাবে আমাদের সামনে প্রকটিত হবে।)

* কোয়ার্ক যে আসলেই আছে, তা এখন প্রমাণিত। ১৯৬৪ সালে মারে গেলম্যান কোয়ার্ক মডেল প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টারে আপ, ডাউন এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়। পরে আরও তিনটি কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়েছে—টপ, বট এবং চার্ম কোয়ার্ক।