স্টেইনলেস স্টিলে জং ধরে না কেন

স্টেইনলেস স্টিলের পরোক্ষ স্তরটি মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার পুরু। প্রায় অদৃশ্য বলা যায়

লোহার মতো শক্ত—কথাটা দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। কোনো মানুষের ব্যক্তিত্ব খুব দৃঢ় হলে বলি লৌহমানব। এসবের কারণ একটাই। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যত ধরনের ধাতব পদার্থ ব্যবহার করি, তার মধ্যে শক্তির দিক থেকে লোহা অন্যতম। একে বাঁকানো যায়, ইচ্ছামতো গঠন তৈরি করা যায়। অনেক বেশি ঘাত সহ্য করার ক্ষমতা লোহার ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুণ। 

২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত এক আর্টিকেলে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীর খনি থেকে তোলা ধাতব পদার্থের ৯১ শতাংশই লোহার আকরিক।’ অর্থাৎ, অন্য যেকোনো ধাতুর চেয়ে লোহা প্রকৃতিতে সহজলভ্য। সমস্যা একটাই। শক্তিশালী এ ধাতু বাতাস বা পানির সংস্পর্শে এসে ভেঙে পড়ে। কারণ, অক্সিজেনের সঙ্গে লোহার সম্পর্কটা দা-কুমড়ার মতো। সংস্পর্শে এলেই দুটোর মাঝে রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে অক্সিডাইজেশন বা জারণ। এ বিক্রিয়ার ফলে লোহার অণুগুলো ইলেকট্রন ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ লোহার অণু ভাঙতে শুরু করে। তৈরি হয় লালচে হাইড্রাইড ফেরাস অক্সাইড (Fe2O3) বা মরিচার আস্তরণ। শুধু লোহা কেন! লোহা ও কার্বনের মিশ্রণে তৈরি অ্যালয় বা সংকর ধাতু স্টিল বা ইস্পাতেও মরিচা পড়ে। সেদিক থেকে বলা যায়, ভবন, স্থাপনা, যানবাহন বা এসব ধাতুর তৈরি নিত্য ব্যবহার্য কোনোকিছুই মরিচা ধরার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়।

মরিচা শুধু লোহা বা স্টিলের ক্ষয় করে, বিষয়টা তা নয়। মানবদেহেরও ক্ষতি করে। পাশাপাশি সৌন্দর্য নষ্টের দিকটা তো আছেই। এসব সমস্যা এড়িয়ে লোহার ভালো দিকগুলো কাজে লাগানো যায় স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহারের মাধ্যমে। চমৎকার এই সংকর ধাতুতে মরিচা পড়ে না। অবশ্য নাম শুনলেই তা বোঝা যায়। স্টেইনলেস মানে দাগমুক্ত। এর গুণের বর্ণনা করতেই যে এমন নাম, তা বলা বাহুল্য। প্রশ্ন হলো, স্টেইনলেস স্টিলের বিশেষত্বটা কী? কোন জাদুমন্ত্রের কারণে মরিচা ধরে না এতে?

বাতাস কিংবা পানির নিচে সঠিক পরিবেশে ক্রোমিয়াম অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। ধাতুর ওপর তৈরি হয় ক্রোমিয়াম অক্সাইডের (Cr2O3) পরোক্ষ স্তর। লোহার সঙ্গে অক্সিজেনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ স্তর। ফলে স্টিল বা ইস্পাতে থাকা লোহা পর্যন্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না।
মরিচা শুধু লোহা বা স্টিলের ক্ষয় করে, বিষয়টা তা নয়। মানবদেহেরও ক্ষতি করে

সহজভাবে চিন্তা করলে দেখব, এতে এমন কিছু একটা ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্টিল বা লোহাকে অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে বাধা দেয়। ফলে জারণ প্রক্রিয়া আর ঘটে না। আসুন, সাধারণ স্টিল ও স্টেইনলেস স্টিলের মধ্যে পার্থক্যটা একবার দেখা যাক।

সাধারণ স্টিলে ৯৯ শতাংশ লোহা এবং ০.২ থেকে ১ শতাংশ কার্বনের তৈরি সংকর ধাতু থাকে। অন্যদিকে স্টেইনলেস স্টিল তৈরি হয় ৬২ থেকে ৭৫ শতাংশ লোহা, সর্বোচ্চ ১ শতাংশ কার্বন এবং সাড়ে ১০ শতাংশের বেশি ক্রোমিয়াম দিয়ে। স্টেইনলেস স্টিলে এ ছাড়াও থাকে সামান্য কিছু নিকেল। ফলে পুরো বস্তুটি যেমন শক্ত হয়, তেমনি একে নানা আকৃতি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা যায় সহজে। 

ওয়ার্ল্ড স্টিল অ্যাসোসিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপের সঙ্গে জোটবদ্ধ বেলজিয়াম-ভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ওয়ার্ল্ডস্টেইনলেসের মহাসচিব ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্ট বা বস্তুবিদ টিম কলিন্স। তাঁর মতে, ‘স্টেইনলেস স্টিলে মরিচা না ধরার মূল কারণ ক্রোমিয়াম।

বাতাস কিংবা পানির নিচে সঠিক পরিবেশে ক্রোমিয়াম অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। ধাতুর ওপর তৈরি হয় ক্রোমিয়াম অক্সাইডের (Cr2O3) পরোক্ষ স্তর। লোহার সঙ্গে অক্সিজেনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ স্তর। ফলে স্টিল বা ইস্পাতে থাকা লোহা পর্যন্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। তাই, মরিচাও ধরে না।

স্টেইনলেস স্টিলের পরোক্ষ স্তরটি মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার পুরু। প্রায় অদৃশ্য বলা যায়। ক্রোমিয়াম অক্সাইডের এ স্তরটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজ থেকে তা সারিয়ে তুলতে পারে। রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় এ যৌগ অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়ায় জড়ায় না। ফলে এটি ক্ষয় হয়ে ধাতুর স্তর বাইরে আসতে পারে না।

দুই

কীভাবে আবিষ্কার হলো এই স্টেইনলেস স্টিল? আধুনিক স্টেইনলেস স্টিলের জন্ম ১৯১২ সালে। ইংরেজ ধাতুবিদ হেনরি বেয়ারলি বন্দুকের নলের ক্ষয়রোধ করার উপায় নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় লোহা, কার্বন, ক্রোমিয়াম এবং নিকেল থেকে একধরনের নতুন সংকর ধাতু তৈরি করেন তিনি। সমস্যা হলো, একে কোনোভাবে বন্দুকের নল বানানোর কাজে  ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। ফলে রাগে দুঃখে নতুন ধাতুটি তিনি ময়লায় ঝুড়িতে ফেলে দেন। এরই মধ্যে কেটে যায় কয়েক সপ্তাহ। কাজের চাপে ময়লার মধ্যে থাকা ধাতব খণ্ডের প্রতি নজর দেওয়া হয়নি। হঠাৎ একদিন কাজের ফাঁকে সেদিকে তাকাতেই দেখেন অবাক কাণ্ড। এতদিন খোলা বাতাসে পড়ে থাকার পরেও এর গায়ে একরত্তি মরিচা ধরেনি। দিব্বি যেন চকচকে শরীর নিয়ে হাসছে। হেনরি বুঝতে পারলেন, নিজের অজান্তেই তিনি এমন এক ধাতু তৈরি করেছেন, যা ইস্পাত ও লোহার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা থেকে মুক্ত। নিজের এই আবিষ্কারকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়ার জন্য পুরোদমে কাজ শুরু করলেন। ১৯১৫ সালে পৃথিবীবাসীর সঙ্গে পরিচয় ঘটল নতুন এই সংকর ধাতুর।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্যবিজ্ঞানী কান্তা শেল বলেন, ‘অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় স্টেইনলেস স্টিলের অনেক সুবিধা আছে। অ্যালুমিনিয়াম বা তামার বাসনকোসন সহজে খাবারের অ্যাসিডের কারণে ক্ষয় হয়। মানব স্বাস্থ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্টেইনলেস স্টিলকে। বস্তুবিদ টম কলিন্সের মতে, বর্তমানে পৃথিবীতে ব্যবহৃত মোট স্টিলের ৪ শতাংশই মরিচারোধী স্টেইনলেস স্টিল। প্রতিবছর প্রায় ২০০ কোটি টন স্টেইনলেস স্টিল উৎপাদিত হয় পৃথিবীজুড়ে। সব ভালোরই কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে। স্টেইনলেস স্টিলও তার ব্যতিক্রম নয়। মরিচারোধী চকচকে এ ধাতু তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল। স্টেইনলেস স্টিল উৎপাদনে সাধারণ ইস্পাতের তুলনায় ৩-৫ গুণ বেশি ব্যয় হয়। এ ছাড়া একে বিশেষ পরিবেশের জন্য উপযোগী করে তুলতে চাইলে খরচ আরও বাড়ে। যেমন পানির নিচে ব্যবহারের জন্য মলিবডেনাম ধাতু মেশাতে হয়।

যেভাবে তৈরি হয় স্টেইনলেস স্টিল

এ কারণে বেশির ভাগ কাজকর্মে এখনও কার্বনমিশ্রিত ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে যেখানে মরিচা ধরার আশঙ্কা কম কিংবা যেখানে স্টিলের ওপর রং বা অন্য কোনো প্রলেপ ব্যবহারের সুযোগ থাকে, সেখানে স্টেইনলেস স্টিলের পরিবর্তে সাধারণ ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে স্টেইনলেস স্টিলের ব্যবহার বেড়েছে। খাদ্য প্রস্তুত শিল্পে এর ব্যাপক ব্যবহার সহজেই চোখে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্যবিজ্ঞানী কান্তা শেল বলেন, ‘অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় স্টেইনলেস স্টিলের অনেক সুবিধা আছে। অ্যালুমিনিয়াম বা তামার বাসনকোসন সহজে খাবারের অ্যাসিডের কারণে ক্ষয় হয়। মানব স্বাস্থ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এর বিপরীতে স্টেইনলেস স্টিলে খাবার খেলে অ্যাসিডের প্রভাবমুক্ত থাকে। সর্বোপরি রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় হওয়ায় এটা খাবারকে দূষিতও করে না।’

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন