ন্যানোর জগতে রঙের আঁচড় দিয়ে রসায়নে নোবেল জয়

আলেক্সি ইয়াকিমভ, মুঙ্গি বাওয়েন্ডি ও লুই ব্রুস

ন্যানোর জগতে সব কিছু আমাদের চেনা-পরিচিত জগতের তুলনায় ভিন্ন আচরণ করে। যে মুহূর্তে এক মিলিমিটারের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ আকারের কোনো কিছু মাপা হয়, অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন কোয়ান্টাম প্রভাব। এসব প্রভাব আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাকে চ্যালেঞ্জ করে।

এ বছরের রসায়নে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের কাজ সেই ন্যানোর জগৎ নিয়ে। ন্যানোপ্রযুক্তিতে মৌলিক অবদান রেখেছেন তাঁরা। ন্যানোর জগতের উদ্ভট ঘটনাগুলো বোঝার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন অগ্রপথিক হিসাবে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে লুই ব্রুস ও আলেক্সি একিমভ আলাদা আলাদাভাবে কোয়ান্টাম ডট তৈরি করেন। এগুলো অতিক্ষুদ্র ন্যানো কণা। এত ক্ষুদ্র যে এদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় কোয়ান্টাম প্রভাবের মাধ্যমে। এককথায় বলা যায়, যেসব ন্যানোকণা আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব দেখায়, সেগুলোই কোয়ান্টাম ডট।

এদিকে ১৯৯৩ সালে মুঙ্গি বাওয়েন্ডি এই কোয়ান্টাম ডট তৈরির প্রক্রিয়ায় বিপ্লব নিয়ে আসেন। ফলে এগুলোর গুণগত মান অনেক উন্নত হয়। আজকের দিনের ন্যানোপ্রযুক্তিতে ব্যবহারের জন্য এ উন্নতি খুব জরুরি ছিল।

এবারের নোবেলজয়ীদের কল্যাণে মানুষ এখন ন্যানোজগতের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলোকে কাজে লাগাতে পারছে। বর্তমানে কোয়ান্টাম ডট ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিক অনেক পণ্যে। ব্যবহৃত হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে।

কিন্তু তাঁরা আসলে কীভাবে কী করলেন? আসুন, একটু পেছনে ফেরা যাক। জানা যাক তাঁদের গবেষণা কথা।

২.

তাত্ত্বিকভাবে বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোয়ান্টাম ডট বানানো সম্ভব। তাঁরা জানতেন, এগুলোর বৈশিষ্ট্য হবে অত্যন্ত অদ্ভুত। ১৯৩৭ সালে পদার্থবিদ হারবার্ট ফ্রোলিখ অনুমান করেন, ন্যানোকণার বৈশিষ্ট্য অন্য সাধারণ কণার মতো হবে না। তিনি তাত্ত্বিকভাবে এসব কণার বৈশিষ্ট্য কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য আরউইন শ্রোডিঙ্গারের কোয়ান্টাম সূত্রের কথা বলেন। তিনি বলেন, কণা যখন খুবই ছোট হয়ে যাবে আকারে, তখন ইলেকট্রনের জন্য জায়গা কমে যাবে। ফলে ইলেকট্রনকে অবস্থান করতে হবে খুব অল্প জায়গায়। অন্যান্য অতিপারমাণবিক কণার মতো ইলেকট্রনও একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গের ধর্ম দেখায়। ফলে ফ্রোলিখ ভাবলেন, এরকম অল্প জায়গায় এগুলোকে আটকে রাখলে তাদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাবে।

গবেষকরা এ কথা শুনে কাজে লেগে পড়লেন। গাণিতিকভাবে তাঁরা বিভিন্ন আকারের কণার জন্য কোয়ান্টাম প্রভাব কেমন হতে পারে, সে অনুমান করলেন। কিন্তু বাস্তবে এগুলো করে দেখতে গিয়ে দেখা গেল, বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়। স্বাভাবিক। যে জিনিস বানাতে হবে, তার আকার তো একটা আলপিনের মাথার চেয়ে এক লাখ গুণ ছোট!

তবু ১৯৭০ দশকে এসে গবেষকরা এ ধরনের ন্যানোকাঠামো ঠিকই বানিয়ে ফেলেন। একধরনের আণবিক রশ্মি ব্যবহার করে তাঁরা বিভিন্ন পদার্থের ওপর পাতলা ন্যানো-আবরণ দেওয়ার উপায় বের করে ফেলেন। দেখা গেল, আবরণ কত পাতলা, তার ওপর এগুলোর আলোকবৈশিষ্ট্য (অপটিক্যাল প্রোপার্টি) নির্ভর করে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনুমানের সঙ্গে এ পর্যবেক্ষণ মিলে গেল।

বড় সাফল্য নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই পরীক্ষণের জন্য প্রয়োজন বেশ উন্নত প্রযুক্তি। গবেষকদের এ জন্য একদিকে প্রয়োজন ছিল অতিউচ্চ মানের ভ্যাকুয়াম এবং পরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা। কাজেই বেশিরভাগ মানুষ ধারণা করলেন, এসব কোয়ান্টাম বলবিদ্যাগত ঘটনা বাস্তবে তেমন কোনো কাজে লাগবে না।

কিন্তু বিজ্ঞানে বড় বড় বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে অপ্রত্যাশিতভাবে। এ ক্ষেত্রেও তাই হলো। ন্যানোগবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দিল প্রাচীন এক উদ্ভাবন—কালারড গ্লাস বা রঙিন কাচ।

১৯৭০-এর দশকে বিজ্ঞানের জ্ঞানের পরিধি ছিল এইটুকু। এরপর মঞ্চে এলেন চলতি বছরের নোবেলজয়ী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানী আলেক্সি এমিকভ।

৩.

প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে রঙিন কাচের শেকড় খুঁজে পাওয়া যায় কয়েক হাজার বছর আগে। কাচের কারিগররা চেষ্টা করেছিলেন রংধনুর বিভিন্ন রঙে কাচ বানানোর। সে জন্য তারা রূপা, স্বর্ণ, ক্যাডমিয়াম একসঙ্গে মিশিয়েছেন, তারপর বিভিন্ন তাপমাত্রায় চেষ্টা করেছেন এগুলোতে নানা রং ও শেড দিতে।

১৯ ও ২০ শতকে বিজ্ঞানীরা যখন আলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন সেই কাচের কারিগরদের জ্ঞান তাঁদের কাজে এল। পদার্থবিজ্ঞানীরা এরকম বর্ণিল কাচ ব্যবহার করে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ফিল্টার করতে পারতেন। এই পরীক্ষণ আরও কার্যকর করতে তাঁরা নিজেরাই কাচ বানাতে শুরু করেন। এতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস জানা গেল। যেমন তাঁরা জানতে পারলেন, শুধু একটি বস্তু বা পদার্থের ভিন্নতার জন্য গোটা কাচের রং বদলে যেতে পারে। উদাহরণ দিই। ক্যাডমিয়াম সেলেনাইড ও ক্যাডমিয়াম সালফাইডের মেশালে কাচ হলুদ বা লাল রং ধারণ করে। কাচ এই দুটোর কোন রঙের হবে, তা নির্ভর করে গলিত কাচ কত তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হচ্ছে এবং পরে কীভাবে ঠান্ডা করা হচ্ছে, তার ওপর। একসময় তাঁরা বুঝতে পারলেন, এই রং আসলে আসে কাচের ভেতরে সৃষ্ট কণা থেকে। আর কাচের রং নির্ভর করে কণার আকারের ওপর।

১৯৭০-এর দশকে বিজ্ঞানের জ্ঞানের পরিধি ছিল এইটুকু। এরপর মঞ্চে এলেন চলতি বছরের নোবেলজয়ী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানী আলেক্সি এমিকভ। সম্প্রতি পিএইচডি শেষ করে তখন সদ্য এস আই ভাভিলভ স্টেট অপটিক্যাল ইনস্টিটিউটে যোগ দেন আলেক্সি একিমভ। একটি বস্তুই যে কাচের রং বদলে দিতে পারে, এটা তাঁকে খুব আকর্ষিত করে।

পরমাণু সংকুচিত হলে কোয়ান্টাম প্রভাব তৈরি হয়
বিশেষ ধরনের আলোকপদ্ধতি ব্যবহার করে সেমিকন্ডাকটরের মান যাচাই করা হয়। গবেষকরা পদার্থের ওপর আলো ফেলেন, তারপর আলো শোষণের পরিমাণ মেপে দেখেন। তখন বোঝা যায় এ জিনিস কী দিয়ে তৈরি এবং কেলাসের গঠন কতটা ভালোভাবে সজ্জিত।

৪.

এই আকর্ষণের কারণ আছে। বিষয়টা আসলে যৌক্তিক নয়। আপনি যদি একটা ছবিকে ক্যাডমিয়ামের লালে রাঙিয়ে দেন, তাহলে তার রং সেটাই থাকে। অন্য কোনো রঞ্জক কণা, অর্থাৎ রঙের কণা না মেশালে এই রং কখনো বদলাবে না। তাহলে, শুধু একটা বস্তু বদলে দিলে গোটা কাচের রং বদলে যাচ্ছে কেন?

পিএইচডির সময় সেমিকন্ডাকটর নিয়ে গবেষণা করেছেন একিমভ। আমাদের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সব ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রেই এর ব্যবহার আছে। বাংলায় এগুলোকে বলে অর্ধ-পরিবাহী। অর্থাৎ পুরোপুরি পরিবাহী না, আবার একদম অপরিবাহী না। একাধিক মৌল মিশিয়ে তৈরি করা হয় এসব অর্ধ-পরিবাহী। এর মধ্য দিয়ে তাই বিদ্যুতের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

বিশেষ ধরনের আলোকপদ্ধতি ব্যবহার করে সেমিকন্ডাকটরের মান যাচাই করা হয়। গবেষকরা পদার্থের ওপর আলো ফেলেন, তারপর আলো শোষণের পরিমাণ মেপে দেখেন। তখন বোঝা যায় এ জিনিস কী দিয়ে তৈরি এবং কেলাসের গঠন কতটা ভালোভাবে সজ্জিত।

একিমভ এই পদ্ধতি জানতেন। তিনি এ পদ্ধতি ব্যবহার করে রঙিন কাচের রং পরীক্ষা করলেন। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, একদম নিয়ম মেনে কাচ বানাবেন। এই কাচে মেশানো থাকবে কপার ক্লোরাইড। গলিত অবস্থায় এই কাচের মণ্ডকে তিনি ৫০০ থেকে ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাপ দিলেন। তাপ দেওয়ার সময়কালেও ছিল ভিন্নতা। ১ থেকে ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত তাপ দিয়ে এই পরীক্ষা চালালেন তিনি। তারপর ওটা ঠান্ডা হয়ে জমাট বাঁধার পর এক্স-রে করে দেখলেন। বিক্ষিপ্ত আলো থেকে দেখা গেল, কপার ক্লোরাইডের ক্ষুদ্র কেলাস তৈরি হয়েছে কাচের ভেতর। আর, উৎপাদন প্রক্রিয়া এসব কণার আকারে প্রভাব ফেলেছে। কোনো কোনোটিতে কণার আকার শুধু ২ ন্যানোমিটার, আবার কোনোটিতে ৩০ ন্যানোমিটার।

মজার বিষয় হলো, তিনি দেখলেন, আলোর শোষণ ও বিক্ষেপণ প্রভাবিত হচ্ছে কণাদের আকারের কারণে। সবচেয়ে বড় কণাগুলো সাধারণ কপার ক্লোরাইডের মতোই আলো শুষে নিচ্ছে। কিন্তু কণা যত ছোট, দেখা গেল, সেগুলো তত বেশি নীল আলো শুষে নিচ্ছে। একিমভ জাত পদার্থবিজ্ঞানী। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নাড়ি-নক্ষত্র তাঁর জানা। তিনি বুঝলেন, আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন।

সেই প্রথম কেউ কোয়ান্টাম ডট—অর্থাৎ আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব দেখায়, এমন ন্যানোকণা—তৈরি করল। ১৯৮১ সালে একিমভ তাঁর এই গবেষণা সোভিয়েত এক জার্নালে প্রকাশ করলেন। কিন্তু সেসময় সোভিয়েত আর মার্কিন বলয়ের মধ্যে চলছিল শীতল যুদ্ধ। সোভিয়েত যুগের যে লৌহবলয় পশ্চিমাবিশ্বকে আলাদা করে রেখেছিল, এর কারণে বাইরের গবেষকরা এর খোঁজ পাননি। এ কারণেই এ বছর রসায়নে আরেক নোবেলজয়ী লুই ব্রুস একিমভের এ কাজের কথা জানতেন না। ১৯৮৩ সালে তিনি পৃথিবীর প্রথম গবেষক হিসাবে আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব দেখায়, এমন ন্যানোকণা আবিষ্কার করেন একটি দ্রবণে ভাসমান অবস্থায়।

মুঙ্গি বাওয়েন্ডি যেভাবে কোয়ান্টাম ডট তৈরি করেন
যেকোনো পদার্থের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় তার ইলেকট্রনের জন্য। ইলেকট্রনই ঠিক করে দেয়, একটি বিক্রিয়ায় কোনো পদার্থ কেমন আচরণ করবে।

৫.

ব্রুস কাজ করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরিতে। তাঁর লক্ষ্য ছিল, সৌর শক্তি ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো। এ জন্য ক্যাডমিয়াম সালফাইডের কণা ব্যবহার করছিলেন তিনি। এ কণা আলো ধরে রাখতে পারে। পরে সেই শক্তি ব্যবহার করে ঘটাতে পারে বিক্রিয়া। এসব কণা ছিল একটি দ্রবণে। ব্রুস এগুলো খুব ছোট করেই বানিয়েছিলেন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ব্যবহারের মতো করে।

এসব ক্ষুদ্র কণা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ব্রুস অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটতে দেখলেন। এগুলোকে কিছুক্ষণ ল্যাবের বেঞ্চে ফেলে রাখতে তাদের আলোকবৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে। তিনি অনুমান করলেন, এর কারণ এগুলোর আকার। নিশ্চিত হতে তিনি সাড়ে চার ন্যানোমিটার ব্যাসের ক্যাডমিয়াম সালফাইড কণা বানালেন। তারপর আরও বড় কণা—সাড়ে ১২ ন্যানোমিটার ব্যাসের কণার সঙ্গে তুলনা করে দেখলেন, বড় কণাগুলো সাধারণ ক্যাডমিয়াম সালফাইডের মতোই আচরণ করছে। কিন্তু ছোট কণাগুলো নীলচে আলো শোষণ করে নিচ্ছে অনেক বেশি।

একিমভের মতোই এ সময় ব্রুসও বুঝলেন, আকারনির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। অর্থাৎ তিনি কোয়ান্টাম ডট বানিয়ে ফেলেছেন! ১৯৮৩ সালে তিনি এ গবেষণা প্রকাশ করেন।

এই পর্যায়ে এসে আপনি যদি ভাবতে থাকেন, কোনো কণা যদি একটু বেশি নীল আলো শুষেও নেয়, তাতে কী যায় আসে?

ঘটনা হলো, যেকোনো পদার্থের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় তার ইলেকট্রনের জন্য। ইলেকট্রনই ঠিক করে দেয়, একটি বিক্রিয়ায় কোনো পদার্থ কেমন আচরণ করবে। কিন্তু গবেষকরা যখন দেখলেন, পদার্থ না বদলে শুধু আকার বদলাতেই আচরণ বদলে যাচ্ছে, তাঁরা বুঝলেন, এগুলো আসলে নতুন ধরনের পদার্থের মতো আচরণ করছে।

এতদিন বিজ্ঞানীরা জানতেন, পদার্থের আচরণ এর ইলেকট্রন সংখ্যা এবং একদম বাইরের স্তরে কয়টি ইলেকট্রন আছে—শুধু এর ওপর নির্ভর করে। এখন তাতে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হলো। বোঝা গেল, ন্যানোজগতে পদার্থের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তা নির্ধারিত হবে এর আকার দিয়ে।

একটাই সমস্যা। ব্রুসের কাজের ফলে গড়পড়তা একই আকারের ন্যানোকণা বানানো যায় বটে, তবে সবগুলোর আকার একদম এক হয় না। কাজেই, একই আকারের ন্যানোকণা চাইলে, গড়ে নির্দিষ্ট আকারে কণা বানানোর পর সেখান থেকে একই আকারের কণাগুলোকে আবার বেছে আলাদা করে নিতে হয়।

এই সমস্যার সমাধান করেন এবারের তৃতীয় নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী, মুঙ্গি বাওয়েন্ডি।

ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডকে উত্তপ্ত দ্রাবকে পরিণত করে। তাৎক্ষণিক ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডের কেলাস বা ন্যানোকণা তৈরি হয়। এ সময় ইনজেকশন ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় বিক্রিয়া থেমে যায়।

৬.

বাওয়েন্ডি কাজ শুরু করেছিলেন লুই ব্রুসের গবেষণাগারেই, ১৯৮৮ সালে। ১৯৯৩ পর্যন্ত ব্রুসের গবেষণাগারের কেউ এই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। ৯৩ সালে বাওয়েন্ডি যখন এ সমস্যার সমাধান করেন, ততদিনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটিতে যোগ দিয়েছেন।

খুব যত্ন করে বাছাই করা বিশেষ একধরনের পদার্থ ইনজেকশন দিয়ে ইনজেকট করলেন তিনি বিশেষ দ্রবণে। এটি ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডকে উত্তপ্ত দ্রাবকে পরিণত করে। তাৎক্ষণিক ক্যাডমিয়াম সেলেনাইডের কেলাস বা ন্যানোকণা তৈরি হয়। এ সময় ইনজেকশন ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় বিক্রিয়া থেমে যায়। তাপমাত্রা বাড়ালে আবার শুরু হয় বিক্রিয়ে। এভাবে তিনি দেখলেন, এ পদ্ধতিতে তাপমাত্রা যত বাড়ানো হয়, তত বড় আকারের ন্যানোকণা তৈরি করা যায়। এর মাধ্যমে বাওয়েন্ডি একই আকারের ন্যানোকণা বানানোর পদ্ধতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এলেন।

৩০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, এসব কণা, অর্থাৎ কোয়ান্টাম ডট বিভিন্ন ব্যবহারিক কাজে লাগছে। এসব কণার আকার পরিবর্তন করে রং বদলে দেওয়া যায়। বর্তমানে কম্পিউটার বা টিভির পর্দায়, এলইডি বাতি বা মানবদেহে টিউমার টিস্যু পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে আরও নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে কোয়ান্টাম ডট। গবেষকদের বিশ্বাস, বাঁকানো যায়, এমন বৈদ্যুতিক যন্ত্র কিংবা খুদে সৌরকোষ থেকে এনক্রিপ্ট করা কোয়ান্টাম যোগাযোগের জন্য—সবখানেই ব্যবহৃত হবে কোয়ান্টাম ডট।

আমাদের চারপাশের রঙিন জগৎটিকে নতুন মাত্রা দেওয়া এই গবেষকদের হাতেই সে জন্য উঠেছে এ বছরের রসায়নে নোবেল।

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ

রসায়ন: সহজ পাঠ; মূল: পিটার অ্যাটকিনস, অনুবাদ: উচ্ছ্বাস তৌসিফ, প্রথমা, ২০২৩